সমকালীন প্রসঙ্গ-ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তি বৃদ্ধির বিপজ্জনক দিক by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশে এখন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যাতে দেশের অবস্থা যত অবনতির দিকে যাচ্ছে ততই রঙবেরঙের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় যে, বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এইভাবে মাথাচাড়া দেওয়া পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
বাংলাদেশে শাসক-শোষক শ্রেণীর শোষণ-নির্যাতন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, নির্যাতন শুধু সরকার ও তার অধীন বিভিন্ন বাহিনী দ্বারাই যে হচ্ছে তাই নয়, বেসরকারি নানা শক্তিও জনগণের ওপর নির্যাতন বেপরোয়াভাবেই করছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার ব্যাপার এই যে, বাংলাদেশে এখন যে ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটছে এবং জনগণের ওপর যে ধরনের বেসরকারি শক্তির নির্যাতন চলছে, সেটা ঐতিহাসিকভাবে পশ্চাৎপদ দেশেই দেখা যায়।
ফরাসি ইউটোপিয়ান সোশালিস্ট ফুরিয়ার বলেছিলেন যে, কোনো সমাজে মানুষ আসলে যতখানি মুক্ত, তারা কতখানি স্বাধীন। তার মাপকাঠি হলো সেই সমাজে নারীর অধিকার কতখানি স্বীকৃত ও বাস্তবে কার্যকর। এদিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশ যে এখনও পর্যন্ত সামাজিকভাবে অতি পশ্চাৎপদ এ বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। কারণ, এখানে নারী শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেতে থাকা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কিছু সংগঠনের উদ্ভব এবং অল্পবিস্তর সক্রিয়তা সত্ত্বেও একটি আধুনিক সমাজে নারীর যেসব অধিকার তর্কাতীতভাবে স্বীকৃত ও বাস্তবত বলবৎ থাকা দরকার, তার অনেক ঘাটতি আছে। শুধু ঘাটতি আছে বললে কম বলা হয়। নারী অধিকারের বিরুদ্ধে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণার বশবর্তী লোকদের শক্তি এখানে যথেষ্ট। এরা সামাজিক শক্তি হিসেবে এত প্রবল যে, শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোও এদের সঙ্গে সমঝোতা করেই নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি এবং অবস্থান টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
পাকিস্তান আমলে ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধেও পরিচালিত হতো। বলা যেতে পারে যে, এই বিরোধিতার মধ্যেই তৎকালীন গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলোরই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের মতো পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলেরও শক্তি নিহিত ছিল। এ কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং পশ্চাৎপদ ধর্মীয় সমাজনীতি উভয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তখন এ দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলেই শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ হয়ে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
এভাবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের, বিশেষ করে জনগণের সচেতন অংশের, একটা আশা ছিল যে, দেশের জনগণ শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই উন্নত জীবনযাপন করবে তাই নয়, এ দেশে উন্নততর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার দ্রুত বিকাশ ঘটবে। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে তারা বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের জনগণকে আজ কোন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে সেটা এখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতির ভয়াবহ চরিত্রের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায়। বাইরের অনেক চাকচিক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে কত বিপজ্জনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা অন্য বিষয় বাদ দিয়ে ধর্মের সামাজিক শক্তি বৃদ্ধি, ১৯৭১ সালে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া তাদের রাজনৈতিক শক্তির লক্ষণীয় পুনরুত্থানের মধ্যে যেভাবে দেখা যায় এটা রীতিমতো বিস্ময়কর। স্বাধীন বাংলাদেশে যা হওয়ার কথা ছিল তার উল্টোটিই যে এখন এভাবে দেখা যাচ্ছে এ নিয়ে কারও কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি হলো। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী বিভিন্ন মহলে প্রায়ই শোনা যায় পরাজিত শত্রুর মাথাচাড়া দেওয়া ও পুনরুত্থানের কথা এবং এর জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি দোষারোপের কথা। এই চেষ্টা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চালানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ যারা এ কথা বলেন তাদের অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে যে, যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিল তারা তার বিরুদ্ধশক্তির শাসনামলে একেবারে নিশ্চিহ্ন না হয়ে আবার মাথাচাড়া দিল কীভাবে? এভাবে পরাজিত শত্রুর নতুন উত্থানের শক্তির জোগান কোথা থেকে এলো? আওয়ামী লীগের লোকদের মুখে সবসময় শোনা যায়, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যা এবং আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে ও পরের অবস্থানের বর্ণনা এবং মূল্যায়ন এমনভাবে করেন যাতে মনে হয়, ওই তারিখের আগে বাংলাদেশ একটি স্বর্গরাজ্য ছিল, সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, হঠাৎ করে ১৫ আগস্টের ঘটনার পর বাংলাদেশ স্বর্গচ্যুত হয়ে নরকে নিক্ষিপ্ত হলো। এভাবে 'নরকে' নিক্ষিপ্ত হওয়ার শর্ত এবং অবস্থা যে ১৯৭৫ সালের আগে বিদ্যমান 'স্বর্গরাজ্যেই' তৈরি হয়েছিল এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিস্থিতি যে কার্যকরণের সম্পর্কে গ্রথিত ছিল এই সত্যের কোনো কিছু তাদের ব্যাখ্যার মধ্যে নেই। এ ধরনের চিন্তা যে নাবালক, অশিক্ষিত মতলববাজিতে পূর্ণ এবং সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক এতে সন্দেহ নেই। নিজেদের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা এবং সে সঙ্গে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা ছাড়া এই অসার ব্যাখ্যার মধ্যে অন্য কিছু নেই। এই ধরনের লোকেরা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ শাসকশ্রেণীর দলগুলোর মধ্যে থেকে ইতিহাস নিয়ে যেসব অশিক্ষিত, অনৈতিহাসিক ও কুৎসিত চিন্তাধারার পরিচয় দেন, তার মধ্যে তাদের নিজেদের শ্রেণী-চরিত্রেরই প্রতিফলন ঘটে, যে শ্রেণী-চরিত্র ১৯৭২ সাল থেকেই গঠিত হয়েছিল ব্যাপক লুটতরাজ, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা আমি আগে করেছি, কাজেই এখানে তার বিস্তার ঘটানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এত কথা বলার প্রয়োজন হলো, শুধু কারা এই পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী তাদের চিহ্নিত করার জন্য নয়। কী প্রক্রিয়ায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে এবং কীভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশকে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ভিত্তির ওপর স্থাপন করা যায়, তার জন্য চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে দাঁড় করানো যায় মূলত তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির উদ্দেশ্যে।
দেশে এখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর যে উত্থান ঘটছে তার মধ্যে সব থেকে পশ্চাৎপদ বিপজ্জনক হলো ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতা সৃষ্টির মধ্যে যে হতাশার জন্ম হয়েছে তার গর্ভেই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার সৃষ্টি। এই হতাশা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরিস্থিতির পরিবর্তনের কোনো পথই যখন মানুষ দেখতে পাচ্ছে না, তখন তারা ইহলোকে প্রাপ্তির সম্ভাবনার অনুপস্থিতিতে তার আশা ছেড়ে দিয়ে, পরলোকের প্রাপ্তির অলীক আশাকেই অবলম্বন করে ধর্মের পথ ধরছে। এই অবস্থায় মসজিদ এখন আর শুধু নামাজ পড়ার স্থান নয়, মাদ্রাসা শুধু শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়। এগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় শক্তির ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ারে। এই দুইকে হাতের মুঠোয় পেয়ে আজ ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংগঠিত করছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, আগে যেখানে শুধু জামায়াতে ইসলামীই প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে সক্রিয় ছিল, এখন এই ধরনের অনেক নতুন শক্তির আবির্ভাব হয়েছে। প্রায়ই এখন নানা নাম দিয়ে ধর্মীয় সংগঠন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠছে।
এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছোট করে দেখার উপায় নেই। তারা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের, বিশেষত উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। অনেকের মতে, এর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ খোঁজার চেষ্টা অবাস্তব, সবকিছুর সঙ্গেই সাম্রাজ্যবাদ জড়িত এমন মনে করার কারণ নেই। এসব কথা আসলে তারাই বলে যারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিত, নানাভাবে ও নানা প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্ট এদের পাতে পড়ে। বাস্তবত যেখানে দেখা যায় পশ্চাৎপদ, অনুন্নত এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকে সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে নিয়ে সবকিছুই করে, সেখানে তাদের এভাবে চিহ্নিত করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা কী বলছে তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে দেশে দেশে এই সন্ত্রাসীদের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করছে, তাদের অস্ত্র ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে, দেশে দেশে আগ্রাসনের অজুহাত সৃষ্টি করছে, তেমনি অন্যদিকে তারা বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সাহায্য-সহযোগিতা করে প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। সাম্রাজ্যবাদীদের এই খেলা নতুন নয়, উপরন্তু অতি পরিচিত। বাংলাদেশেও তারা এই খেলাই খেলছে।
ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থান এখানে কীভাবে হচ্ছে তার এই মুহূর্তের দৃষ্টান্ত হলো, ইসলামী ঐক্যজোট নামক একটি ধর্মীয় সংগঠন কর্তৃক ৪ এপ্রিল দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান। হরতালের ডাক দিয়ে তাদের দ্বারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর কথা ভেবেই অধিকাংশ লোক এই ধরনের হরতালে 'অংশগ্রহণ' করে। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই ধরনের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তি এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার ওপর দাঁড়িয়েই অগ্রসর হচ্ছে। এদের এই এগিয়ে আসা প্রতিরোধ রাজনৈতিকভাবেই, রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে করা ছাড়া অন্য পথ নেই। এভাবে তাদের শক্তির মোকাবেলা করাই এখন বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির রাজনৈতিক কর্তব্য। এ কর্তব্যে অবহেলা দেশের ও জনগণের সর্বনাশই ডেকে আনবে।
৪.৪.২০১১
ফরাসি ইউটোপিয়ান সোশালিস্ট ফুরিয়ার বলেছিলেন যে, কোনো সমাজে মানুষ আসলে যতখানি মুক্ত, তারা কতখানি স্বাধীন। তার মাপকাঠি হলো সেই সমাজে নারীর অধিকার কতখানি স্বীকৃত ও বাস্তবে কার্যকর। এদিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশ যে এখনও পর্যন্ত সামাজিকভাবে অতি পশ্চাৎপদ এ বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। কারণ, এখানে নারী শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেতে থাকা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কিছু সংগঠনের উদ্ভব এবং অল্পবিস্তর সক্রিয়তা সত্ত্বেও একটি আধুনিক সমাজে নারীর যেসব অধিকার তর্কাতীতভাবে স্বীকৃত ও বাস্তবত বলবৎ থাকা দরকার, তার অনেক ঘাটতি আছে। শুধু ঘাটতি আছে বললে কম বলা হয়। নারী অধিকারের বিরুদ্ধে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণার বশবর্তী লোকদের শক্তি এখানে যথেষ্ট। এরা সামাজিক শক্তি হিসেবে এত প্রবল যে, শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোও এদের সঙ্গে সমঝোতা করেই নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি এবং অবস্থান টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
পাকিস্তান আমলে ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধেও পরিচালিত হতো। বলা যেতে পারে যে, এই বিরোধিতার মধ্যেই তৎকালীন গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলোরই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের মতো পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলেরও শক্তি নিহিত ছিল। এ কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং পশ্চাৎপদ ধর্মীয় সমাজনীতি উভয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তখন এ দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলেই শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ হয়ে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
এভাবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের, বিশেষ করে জনগণের সচেতন অংশের, একটা আশা ছিল যে, দেশের জনগণ শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই উন্নত জীবনযাপন করবে তাই নয়, এ দেশে উন্নততর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার দ্রুত বিকাশ ঘটবে। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে তারা বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের জনগণকে আজ কোন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে সেটা এখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতির ভয়াবহ চরিত্রের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায়। বাইরের অনেক চাকচিক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে কত বিপজ্জনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা অন্য বিষয় বাদ দিয়ে ধর্মের সামাজিক শক্তি বৃদ্ধি, ১৯৭১ সালে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া তাদের রাজনৈতিক শক্তির লক্ষণীয় পুনরুত্থানের মধ্যে যেভাবে দেখা যায় এটা রীতিমতো বিস্ময়কর। স্বাধীন বাংলাদেশে যা হওয়ার কথা ছিল তার উল্টোটিই যে এখন এভাবে দেখা যাচ্ছে এ নিয়ে কারও কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি হলো। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী বিভিন্ন মহলে প্রায়ই শোনা যায় পরাজিত শত্রুর মাথাচাড়া দেওয়া ও পুনরুত্থানের কথা এবং এর জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি দোষারোপের কথা। এই চেষ্টা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চালানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ যারা এ কথা বলেন তাদের অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে যে, যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিল তারা তার বিরুদ্ধশক্তির শাসনামলে একেবারে নিশ্চিহ্ন না হয়ে আবার মাথাচাড়া দিল কীভাবে? এভাবে পরাজিত শত্রুর নতুন উত্থানের শক্তির জোগান কোথা থেকে এলো? আওয়ামী লীগের লোকদের মুখে সবসময় শোনা যায়, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যা এবং আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে ও পরের অবস্থানের বর্ণনা এবং মূল্যায়ন এমনভাবে করেন যাতে মনে হয়, ওই তারিখের আগে বাংলাদেশ একটি স্বর্গরাজ্য ছিল, সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, হঠাৎ করে ১৫ আগস্টের ঘটনার পর বাংলাদেশ স্বর্গচ্যুত হয়ে নরকে নিক্ষিপ্ত হলো। এভাবে 'নরকে' নিক্ষিপ্ত হওয়ার শর্ত এবং অবস্থা যে ১৯৭৫ সালের আগে বিদ্যমান 'স্বর্গরাজ্যেই' তৈরি হয়েছিল এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিস্থিতি যে কার্যকরণের সম্পর্কে গ্রথিত ছিল এই সত্যের কোনো কিছু তাদের ব্যাখ্যার মধ্যে নেই। এ ধরনের চিন্তা যে নাবালক, অশিক্ষিত মতলববাজিতে পূর্ণ এবং সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক এতে সন্দেহ নেই। নিজেদের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা এবং সে সঙ্গে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা ছাড়া এই অসার ব্যাখ্যার মধ্যে অন্য কিছু নেই। এই ধরনের লোকেরা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ শাসকশ্রেণীর দলগুলোর মধ্যে থেকে ইতিহাস নিয়ে যেসব অশিক্ষিত, অনৈতিহাসিক ও কুৎসিত চিন্তাধারার পরিচয় দেন, তার মধ্যে তাদের নিজেদের শ্রেণী-চরিত্রেরই প্রতিফলন ঘটে, যে শ্রেণী-চরিত্র ১৯৭২ সাল থেকেই গঠিত হয়েছিল ব্যাপক লুটতরাজ, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা আমি আগে করেছি, কাজেই এখানে তার বিস্তার ঘটানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এত কথা বলার প্রয়োজন হলো, শুধু কারা এই পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী তাদের চিহ্নিত করার জন্য নয়। কী প্রক্রিয়ায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে এবং কীভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশকে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ভিত্তির ওপর স্থাপন করা যায়, তার জন্য চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে দাঁড় করানো যায় মূলত তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির উদ্দেশ্যে।
দেশে এখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর যে উত্থান ঘটছে তার মধ্যে সব থেকে পশ্চাৎপদ বিপজ্জনক হলো ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতা সৃষ্টির মধ্যে যে হতাশার জন্ম হয়েছে তার গর্ভেই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার সৃষ্টি। এই হতাশা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরিস্থিতির পরিবর্তনের কোনো পথই যখন মানুষ দেখতে পাচ্ছে না, তখন তারা ইহলোকে প্রাপ্তির সম্ভাবনার অনুপস্থিতিতে তার আশা ছেড়ে দিয়ে, পরলোকের প্রাপ্তির অলীক আশাকেই অবলম্বন করে ধর্মের পথ ধরছে। এই অবস্থায় মসজিদ এখন আর শুধু নামাজ পড়ার স্থান নয়, মাদ্রাসা শুধু শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়। এগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় শক্তির ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ারে। এই দুইকে হাতের মুঠোয় পেয়ে আজ ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংগঠিত করছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, আগে যেখানে শুধু জামায়াতে ইসলামীই প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে সক্রিয় ছিল, এখন এই ধরনের অনেক নতুন শক্তির আবির্ভাব হয়েছে। প্রায়ই এখন নানা নাম দিয়ে ধর্মীয় সংগঠন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠছে।
এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছোট করে দেখার উপায় নেই। তারা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের, বিশেষত উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। অনেকের মতে, এর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ খোঁজার চেষ্টা অবাস্তব, সবকিছুর সঙ্গেই সাম্রাজ্যবাদ জড়িত এমন মনে করার কারণ নেই। এসব কথা আসলে তারাই বলে যারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিত, নানাভাবে ও নানা প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্ট এদের পাতে পড়ে। বাস্তবত যেখানে দেখা যায় পশ্চাৎপদ, অনুন্নত এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকে সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে নিয়ে সবকিছুই করে, সেখানে তাদের এভাবে চিহ্নিত করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা কী বলছে তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে দেশে দেশে এই সন্ত্রাসীদের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করছে, তাদের অস্ত্র ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে, দেশে দেশে আগ্রাসনের অজুহাত সৃষ্টি করছে, তেমনি অন্যদিকে তারা বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সাহায্য-সহযোগিতা করে প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। সাম্রাজ্যবাদীদের এই খেলা নতুন নয়, উপরন্তু অতি পরিচিত। বাংলাদেশেও তারা এই খেলাই খেলছে।
ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থান এখানে কীভাবে হচ্ছে তার এই মুহূর্তের দৃষ্টান্ত হলো, ইসলামী ঐক্যজোট নামক একটি ধর্মীয় সংগঠন কর্তৃক ৪ এপ্রিল দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান। হরতালের ডাক দিয়ে তাদের দ্বারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর কথা ভেবেই অধিকাংশ লোক এই ধরনের হরতালে 'অংশগ্রহণ' করে। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই ধরনের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তি এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার ওপর দাঁড়িয়েই অগ্রসর হচ্ছে। এদের এই এগিয়ে আসা প্রতিরোধ রাজনৈতিকভাবেই, রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে করা ছাড়া অন্য পথ নেই। এভাবে তাদের শক্তির মোকাবেলা করাই এখন বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির রাজনৈতিক কর্তব্য। এ কর্তব্যে অবহেলা দেশের ও জনগণের সর্বনাশই ডেকে আনবে।
৪.৪.২০১১
No comments