জাতীয় সম্পদ-লুণ্ঠনজীবী সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের মুখোশ নিজেরাই ছিঁড়ে ফেলছে by বদরুদ্দীন উমর
লিবিয়ার তেল লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক হস্তক্ষেপ ও আক্রমণ থেকে নিয়ে আমাদের দেশের গ্যাস-সম্পদ লুণ্ঠনের দিকে তাকালে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠনজীবী চরিত্রই চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয়।
নিজেদের এই লুণ্ঠনজীবী চরিত্র আড়াল করার উদ্দেশ্যেই এরা লুণ্ঠনকে গণতন্ত্র ও মানবিকতার মোড়কে বিশ্বের জনগণের সামনে উপস্থিত করে। কিন্তু দিনের পর দিন অতিরিক্ত আগ্রাসী চরিত্র পরিগ্রহ করে এরা নিজেদের তৈরি এই মোড়ক নিজেরাই এমনভাবে ছিঁড়ে ফেলছে, যাতে কুৎসিত নিষ্ঠুর লুণ্ঠনজীবী চরিত্র বিষয়ে তাদের তাঁবেদার সরকার ও দেশে দেশে তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা ছাড়া অন্য কারও আর কোনো সন্দেহ নেই
মুয়াম্মার গাদ্দাফির সেনাবাহিনী লিবিয়ায় গণহত্যা করছে, এ অভিযোগ এনে তা বন্ধের জন্য জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাব পাস করেছিল। এ প্রস্তাব অনুযায়ী লিবিয়া সরকারের বিমান যাতে সে দেশের আকাশে উড়তে না পারে, সে জন্য তারা লিবিয়াকে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করেছিল। এ প্রস্তাব পাস করে লিবিয়া সরকারের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোট ন্যাটো লিবিয়ার আকাশ দখল করেছিল। এই দখল কায়েম রেখে কয়েক মাস ধরে ন্যাটোর বিমানবাহিনী লিবিয়ায় প্রায় প্রতিদিন হামলা চালিয়ে সেখানে অগুনতি নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। এই সামরিক হামলার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, গাদ্দাফির সরকার নয়, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীরাই লিবিয়ায় শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে গণহত্যারই এক নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাম্রাজ্যবাদী মিত্ররা বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেও তাদের চেয়ে বড় মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের শত্রু আর কেউ নেই। এ কারণে যখনই কোনো দেশে মানবাধিকারের কথা তারা বলে তখনই বুঝতে হবে, গণহত্যা ও মানবাধিকার নয়, তাদের নিজেদের স্বার্থ সে দেশের শাসকশ্রেণীর দ্বারা ক্ষুণ্ন অথবা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণেই তারা তাদের শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের আগ্রাসন পরিচালনা করছে। আফগানিস্তান, ইরাক ইত্যাদি দেশে অতি সম্প্রতি আমরা এটা দেখেছি এবং এই মুহূর্তে দেখছি লিবিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো এখন লিবিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সে দেশে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করছে, এটা কে বিশ্বাস করবে? কিন্তু দুর্দমনীয় সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যমে এখনও এই মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে পরদেশ আক্রমণ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনের প্রস্তুতিকে আড়াল করার চেষ্টাই চালাচ্ছে।
এটা সবারই জানা যে, এ বছরের গোড়া থেকে তারা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে এবং তা চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও অব্যাহত আছে। এ দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র লিবিয়ায়ই তেলের এক বিশাল মজুদ আছে। শুধু তেল নয়, লিবিয়ার মাটির নিচে মিষ্টি পানির এক বিশাল মজুদ আছে। এ দুইয়ের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা ও লুটপাটের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীরা লিবিয়ায় গাদ্দাফির তথাকথিত গণহত্যা বন্ধের অজুহাত খাড়া করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করে, তারা ভূমিতে অনেক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রাখার সঙ্গে সঙ্গে লিবিয়ার আকাশ দখল করেছে।
তেল, গ্যাস, ইত্যাদি জ্বালানির জন্য আজ যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে শুধু সামরিক হামলা নয়, অন্য অনেক ধরনের চাল সৃষ্টির মাধ্যমেও দেশে দেশে তেল-গ্যাস লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। অর্থ, অস্ত্র, প্রযুক্তি ইত্যাদির জন্য সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল এসব দেশের দুর্নীতিপরায়ণ শাসকশ্রেণীর ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যক্তিদের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমে তারা 'শান্তিপূর্ণভাবে' তেল-গ্যাসহ অনেক কিছুই লুণ্ঠন করছে। অসম বাণিজ্যও তাদের এ লুণ্ঠনের অন্যতম পদ্ধতি। এর দৃষ্টান্তের জন্য অন্য কোথাও যেতে হবে না। আমাদের দেশেই মার্কিনসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লুণ্ঠনের দিকে তাকালেই এ বিষয়ে সন্দেহের আর কিছুই থাকবে না। এ লুণ্ঠন তারা যে শুধু স্থানীয় সরকারের ব্যক্তিদের সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে করছে তা-ই নয়, অনেকভাবে তাদের হাতে মোচড় দিয়েও তারা এ লুটপাটের ব্যবস্থা করছে।
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সরকার তো দেশের গ্যাসভাণ্ডারের দরজা সাম্রাজ্যবাদী তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর জন্য প্রথম থেকেই খুলে রেখেছে। ১৯৯১ সালের পর সরকার দেশের ভূখণ্ডে ২০টি ব্লক ও বঙ্গোপসাগরে ২৮টি ব্লক চিহ্নিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার ভূখণ্ডের পাঁচটি এবং পরে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার আরও দুটি ব্লক আমেরিকান ও কানাডিয়ান কোম্পানির কাছে এমন শর্তে ইজরা দিয়েছিল, যাতে দেশের কোনো লাভ হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলো তাদের পক্ষে বড় রকম অনুকূল শর্তে আমাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো লুণ্ঠন করে চলেছে। মাগুরছড়া ও ট্যাংরাটিলায় বিস্ফোরণ ঘটে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাছ থেকে এখনও এক টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করাও সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি! উপরন্তু তারা বেশ বুক ফুলিয়ে স্পর্ধার সঙ্গে দেশে বসে আমাদের গ্যাসক্ষেত্র থেকে তেল উঠিয়ে জমজমাট ব্যবসা করছে! কী ধরনের শাসকশ্রেণী দেশে ক্ষমতায় থাকলে এবং তাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র কতখানি অধঃপতিত হলে এটা সম্ভব, এ কথা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না।
গত ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকার মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকো ফিলিপসকে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস উত্তোলনের জন্য ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ইজারা দিয়েছে। এ ইজারার শর্ত হিসেবে উত্তোলিত গ্যাসের ২০ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৮০ শতাংশ আমেরিকান কোম্পানিটি বাইরে রফতানি করবে। আমাদের দেশে যেখানে জ্বালানি সমস্যা এখন সংকটজনক, যেখানে জ্বালানির অভাবে দেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে, সেখানে নিজেদের গ্যাস এভাবে বিদেশি কোম্পানিকে বাইরে রফতানির চুক্তির মধ্যে যে দেশপ্রেমের কোনো ব্যাপার নেই, বরং তার উল্টোটাই আছে, এ নিয়ে কোনো সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরই সন্দেহ থাকার কারণ নেই। কিন্তু সরকার এভাবেই দেশের সম্পদ লুণ্ঠিত হওয়ার ব্যবস্থা করে একেই দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করে বাজিমাত করার চেষ্টায় আছে। প্রধানমন্ত্রী খুব দম্ভের সঙ্গেই বলেছেন, এ দেশে তার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক আর কে আছে! সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলোর কাছে গ্যাসসহ অন্য সম্পদ হস্তান্তর এবং তাদের অন্য হাজার রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীই যে ব্যতিক্রম এমন নয়, এটা বাংলাদেশের সমগ্র শাসকশ্রেণীরই বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই সম্ভবত দেখা যাচ্ছে, আমেরিকান কোম্পানিকে উপরোক্ত শর্তে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দিলেও বিএনপি ও তাদের সভানেত্রী খালেদা জিয়ার কোনো প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধে নেই। দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তারা দিনের পর দিন হরতাল দিতে পারেন, কিন্তু হরতাল দেওয়া তো দূরের কথা, দেশের সম্পদ এভাবে তাদের চিরশত্রু আওয়ামী লীগ সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানির সঙ্গে বন্দোবস্ত করলেও তার বিরুদ্ধে একটি বাক্যও তারা উচ্চারণ করেননি! এর কারণ, তারাও আওয়ামী লীগের মতোই 'দেশপ্রেমিক'!! বাংলাদেশে এখন ফলমূলসহ সব খাদ্যদ্রব্যই ভোজালে ভর্তি। কিন্তু শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, দেশপ্রেমেও এভাবে যে ভেজাল দেখা যাচ্ছে, এর কোনো তুলনা নেই। এই দেশপ্রেমের মতো সর্বনাশা জিনিস আর কী আছে?
লিবিয়ার তেল লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে সে দেশে মার্কিনসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক হস্তক্ষেপ ও আক্রমণ থেকে নিয়ে আমাদের দেশের গ্যাস-সম্পদ লুণ্ঠনের দিকে তাকালে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠনজীবী (ঢ়ৎবফধঃড়ৎ) চরিত্রই চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয়। নিজেদের এই লুণ্ঠনজীবী চরিত্র আড়াল করার উদ্দেশ্যেই এরা লুণ্ঠনকে গণতন্ত্র ও মানবিকতার মোড়কে বিশ্বের জনগণের সামনে উপস্থিত করে। কিন্তু দিনের পর দিন অতিরিক্ত আগ্রাসী চরিত্র পরিগ্রহ করে এরা নিজেদের তৈরি এ মোড়ক নিজেরাই এমনভাবে ছিঁড়ে ফেলছে, যাতে কুৎসিত নিষ্ঠুর লুণ্ঠনজীবী চরিত্র বিষয়ে তাদের তাঁবেদার সরকার ও দেশে দেশে তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা ছাড়া অন্য কারও আর কোনো সন্দেহ নেই।
২০-৬-২০১১
মুয়াম্মার গাদ্দাফির সেনাবাহিনী লিবিয়ায় গণহত্যা করছে, এ অভিযোগ এনে তা বন্ধের জন্য জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাব পাস করেছিল। এ প্রস্তাব অনুযায়ী লিবিয়া সরকারের বিমান যাতে সে দেশের আকাশে উড়তে না পারে, সে জন্য তারা লিবিয়াকে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করেছিল। এ প্রস্তাব পাস করে লিবিয়া সরকারের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোট ন্যাটো লিবিয়ার আকাশ দখল করেছিল। এই দখল কায়েম রেখে কয়েক মাস ধরে ন্যাটোর বিমানবাহিনী লিবিয়ায় প্রায় প্রতিদিন হামলা চালিয়ে সেখানে অগুনতি নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। এই সামরিক হামলার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, গাদ্দাফির সরকার নয়, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীরাই লিবিয়ায় শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে গণহত্যারই এক নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাম্রাজ্যবাদী মিত্ররা বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেও তাদের চেয়ে বড় মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের শত্রু আর কেউ নেই। এ কারণে যখনই কোনো দেশে মানবাধিকারের কথা তারা বলে তখনই বুঝতে হবে, গণহত্যা ও মানবাধিকার নয়, তাদের নিজেদের স্বার্থ সে দেশের শাসকশ্রেণীর দ্বারা ক্ষুণ্ন অথবা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণেই তারা তাদের শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের আগ্রাসন পরিচালনা করছে। আফগানিস্তান, ইরাক ইত্যাদি দেশে অতি সম্প্রতি আমরা এটা দেখেছি এবং এই মুহূর্তে দেখছি লিবিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো এখন লিবিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সে দেশে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করছে, এটা কে বিশ্বাস করবে? কিন্তু দুর্দমনীয় সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমাধ্যমে এখনও এই মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে পরদেশ আক্রমণ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনের প্রস্তুতিকে আড়াল করার চেষ্টাই চালাচ্ছে।
এটা সবারই জানা যে, এ বছরের গোড়া থেকে তারা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে এবং তা চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও অব্যাহত আছে। এ দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র লিবিয়ায়ই তেলের এক বিশাল মজুদ আছে। শুধু তেল নয়, লিবিয়ার মাটির নিচে মিষ্টি পানির এক বিশাল মজুদ আছে। এ দুইয়ের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা ও লুটপাটের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীরা লিবিয়ায় গাদ্দাফির তথাকথিত গণহত্যা বন্ধের অজুহাত খাড়া করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করে, তারা ভূমিতে অনেক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রাখার সঙ্গে সঙ্গে লিবিয়ার আকাশ দখল করেছে।
তেল, গ্যাস, ইত্যাদি জ্বালানির জন্য আজ যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে শুধু সামরিক হামলা নয়, অন্য অনেক ধরনের চাল সৃষ্টির মাধ্যমেও দেশে দেশে তেল-গ্যাস লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। অর্থ, অস্ত্র, প্রযুক্তি ইত্যাদির জন্য সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল এসব দেশের দুর্নীতিপরায়ণ শাসকশ্রেণীর ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যক্তিদের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমে তারা 'শান্তিপূর্ণভাবে' তেল-গ্যাসহ অনেক কিছুই লুণ্ঠন করছে। অসম বাণিজ্যও তাদের এ লুণ্ঠনের অন্যতম পদ্ধতি। এর দৃষ্টান্তের জন্য অন্য কোথাও যেতে হবে না। আমাদের দেশেই মার্কিনসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লুণ্ঠনের দিকে তাকালেই এ বিষয়ে সন্দেহের আর কিছুই থাকবে না। এ লুণ্ঠন তারা যে শুধু স্থানীয় সরকারের ব্যক্তিদের সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে করছে তা-ই নয়, অনেকভাবে তাদের হাতে মোচড় দিয়েও তারা এ লুটপাটের ব্যবস্থা করছে।
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সরকার তো দেশের গ্যাসভাণ্ডারের দরজা সাম্রাজ্যবাদী তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর জন্য প্রথম থেকেই খুলে রেখেছে। ১৯৯১ সালের পর সরকার দেশের ভূখণ্ডে ২০টি ব্লক ও বঙ্গোপসাগরে ২৮টি ব্লক চিহ্নিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার ভূখণ্ডের পাঁচটি এবং পরে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার আরও দুটি ব্লক আমেরিকান ও কানাডিয়ান কোম্পানির কাছে এমন শর্তে ইজরা দিয়েছিল, যাতে দেশের কোনো লাভ হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলো তাদের পক্ষে বড় রকম অনুকূল শর্তে আমাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো লুণ্ঠন করে চলেছে। মাগুরছড়া ও ট্যাংরাটিলায় বিস্ফোরণ ঘটে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাছ থেকে এখনও এক টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করাও সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি! উপরন্তু তারা বেশ বুক ফুলিয়ে স্পর্ধার সঙ্গে দেশে বসে আমাদের গ্যাসক্ষেত্র থেকে তেল উঠিয়ে জমজমাট ব্যবসা করছে! কী ধরনের শাসকশ্রেণী দেশে ক্ষমতায় থাকলে এবং তাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র কতখানি অধঃপতিত হলে এটা সম্ভব, এ কথা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না।
গত ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকার মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকো ফিলিপসকে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস উত্তোলনের জন্য ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ইজারা দিয়েছে। এ ইজারার শর্ত হিসেবে উত্তোলিত গ্যাসের ২০ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৮০ শতাংশ আমেরিকান কোম্পানিটি বাইরে রফতানি করবে। আমাদের দেশে যেখানে জ্বালানি সমস্যা এখন সংকটজনক, যেখানে জ্বালানির অভাবে দেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে, সেখানে নিজেদের গ্যাস এভাবে বিদেশি কোম্পানিকে বাইরে রফতানির চুক্তির মধ্যে যে দেশপ্রেমের কোনো ব্যাপার নেই, বরং তার উল্টোটাই আছে, এ নিয়ে কোনো সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরই সন্দেহ থাকার কারণ নেই। কিন্তু সরকার এভাবেই দেশের সম্পদ লুণ্ঠিত হওয়ার ব্যবস্থা করে একেই দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করে বাজিমাত করার চেষ্টায় আছে। প্রধানমন্ত্রী খুব দম্ভের সঙ্গেই বলেছেন, এ দেশে তার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক আর কে আছে! সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলোর কাছে গ্যাসসহ অন্য সম্পদ হস্তান্তর এবং তাদের অন্য হাজার রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীই যে ব্যতিক্রম এমন নয়, এটা বাংলাদেশের সমগ্র শাসকশ্রেণীরই বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই সম্ভবত দেখা যাচ্ছে, আমেরিকান কোম্পানিকে উপরোক্ত শর্তে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দিলেও বিএনপি ও তাদের সভানেত্রী খালেদা জিয়ার কোনো প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধে নেই। দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তারা দিনের পর দিন হরতাল দিতে পারেন, কিন্তু হরতাল দেওয়া তো দূরের কথা, দেশের সম্পদ এভাবে তাদের চিরশত্রু আওয়ামী লীগ সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানির সঙ্গে বন্দোবস্ত করলেও তার বিরুদ্ধে একটি বাক্যও তারা উচ্চারণ করেননি! এর কারণ, তারাও আওয়ামী লীগের মতোই 'দেশপ্রেমিক'!! বাংলাদেশে এখন ফলমূলসহ সব খাদ্যদ্রব্যই ভোজালে ভর্তি। কিন্তু শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, দেশপ্রেমেও এভাবে যে ভেজাল দেখা যাচ্ছে, এর কোনো তুলনা নেই। এই দেশপ্রেমের মতো সর্বনাশা জিনিস আর কী আছে?
লিবিয়ার তেল লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে সে দেশে মার্কিনসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক হস্তক্ষেপ ও আক্রমণ থেকে নিয়ে আমাদের দেশের গ্যাস-সম্পদ লুণ্ঠনের দিকে তাকালে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠনজীবী (ঢ়ৎবফধঃড়ৎ) চরিত্রই চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয়। নিজেদের এই লুণ্ঠনজীবী চরিত্র আড়াল করার উদ্দেশ্যেই এরা লুণ্ঠনকে গণতন্ত্র ও মানবিকতার মোড়কে বিশ্বের জনগণের সামনে উপস্থিত করে। কিন্তু দিনের পর দিন অতিরিক্ত আগ্রাসী চরিত্র পরিগ্রহ করে এরা নিজেদের তৈরি এ মোড়ক নিজেরাই এমনভাবে ছিঁড়ে ফেলছে, যাতে কুৎসিত নিষ্ঠুর লুণ্ঠনজীবী চরিত্র বিষয়ে তাদের তাঁবেদার সরকার ও দেশে দেশে তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা ছাড়া অন্য কারও আর কোনো সন্দেহ নেই।
২০-৬-২০১১
No comments