মুষড়ে পড়েছেন বিচারপ্রার্থী নারী-আট পুলিশ কর্তাকে তলব

স্বামীর নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে আদালত চত্বরে পুলিশের হাতে শ্লীলতাহানির শিকার হওয়ার পর এখন পদে পদে হয়রানিতে পড়ছেন সেই নারী। গণমাধ্যমে এ ঘটনা জেনে শত শত মানুষ ওই নারীর বাড়িতে ভিড় করায় তিনি মুষড়ে পড়েছেন। অন্যদিকে পুলিশের নির্যাতনে আহত সাংবাদিকরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।


এদিকে ওই নারী মামলা করতে গতকাল বুধবার রাত ৮টার দিকে যান পুলিশের লালবাগের ডিসির অফিসে। রাত সাড়ে ১২টায় কালের কণ্ঠকে ওই নারী বলেন, 'মামলা করতে এসেছি, কিন্তু পুলিশ মামলা না নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।'
ঢাকা জজকোর্টে এক নারীর শ্লীলতাহানি ও তাঁর মা-বাবাকে মারধর এবং সাংবাদিক ও আইনজীবী নির্যাতনের ঘটনায় আট পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ৬ জুন তাঁদের আদালতে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গতকাল বুধবার এ আদেশ দেন। ওই ঘটনা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি কে এম সাইফুদ্দিন গতকাল বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আদেশ দেন।
তলব হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন উর রশীদ, সহকারী কমিশনার (এসি) রাজীব আল মাসুদ, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান, দুই উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর ও জামান এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ ক্লাবের সভাপতি।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আলতাফ হোসেন জানান, আদালত এ ছয়জন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আরো দুজন কর্মকর্তাকে আগামী ৬ জুন আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য দুজন হলেন- এসআই নুরুজ্জামান সরকার ও আমিন আফজাল বিপ্লব।
একই সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পুরো ঘটনার বিবরণ, অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের অতীত ঘটনাবলি, সংক্ষিপ্ত জীবনী আদালতে জমা দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংক্ষিপ্ত জীবনীতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ছাত্রজীবনের বর্ণনাও দিতে বলা হয়েছে। 'দায়ী' পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি বা কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, সে-সংক্রান্ত প্রতিবেদনও একই সময়ের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে।
পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে সিএমএম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাধারণ আইনজীবীরা গতকাল দুপুরে র‌্যালি করেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জজকোর্টে আইনজীবী সমিতির সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তাঁরা।
পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী গতকাল দুপুর ২টায় কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা মুখ্য মহানগর হাকিম বিকাশ কুমার সাহার সঙ্গে তাঁর কনফারেন্স রুমে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসেন, ডিসি প্রসিকিউশন আনিছুর রহমান, ডিসি লালবাগ, এসি কোতোয়ালি রাজীব আল মাসুদ, ওসি সালাউদ্দিন, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি বোরহান উদ্দীন, সাধারণ সম্পাদক আলী হোসেন, মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী নজিবুল্লাহ হিরু ও আহত তিন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনার সময় মুখ্য মহানগর হাকিম বিকাশ কুমার জানান, এ ঘটনা নিয়ে হাইকোর্ট আটজনকে তলব করেছেন। এ কারণে তিনি কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারবেন না। তবে ভবিষ্যতে যাতে এ রকম কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে জন্য তিনি পুলিশ কর্তাদের সতর্ক করে দেন। হাকিমের সামনে ভবিষ্যতে এ রকম কিছু না করার অঙ্গীকার করেন লালবাগ বিভাগের ডিসি।
পুলিশের হামলায় আহত কালের কণ্ঠের আদালত প্রতিবেদক এম এ জলিল উজ্জল জানান, পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রধান এডিসি মারুফ হোসেন সরদার গতকাল বিকেল সোয়া ৫টায় কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে আহত সাংবাদিকদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত-সংলগ্ন পুলিশ ক্লাবে পুলিশের হাতে শ্লীলতাহানির শিকার হন এক নারী। এ খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন কালের কণ্ঠের আদালত প্রতিবেদক এম এ জলিল উজ্জল, বাংলাদেশ প্রতিদিনের আদালত প্রতিবেদক তুহিন হাওলাদার ও প্রথম আলোর আদালত প্রতিবেদক প্রশান্ত কুমার কর্মকার। এ ছাড়া দুই আইনজীবীকে লাঠিপেটার পর পুলিশ ভ্যানে তুলে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই নারীর বাবা ও মাকেও পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। পরে এ খবর পেয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল কোতোয়ালি থানায় যান। রাত ১০টার দিকে তাঁদের মুক্ত করে নিয়ে তবেই ফেরেন তিনি।
মঙ্গলবার রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ঘটনায় দুই এএসআইকে ক্লোজ করা হয়েছে। ওই রাতেই পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মারুফ হোসেন ও সহকারী কমিশনার রাজীব আল মাসুদ। কিন্তু রাজীবের বিরুদ্ধে আইনজীবী পেটানোর অভিযোগ থাকার পরও তাঁকে তদন্ত কমিটিতে রাখায় পুরো তদন্ত নিয়েই অসন্তোষ দেখা দেয় আক্রান্তদের মধ্যে।
অবশেষে গতকাল দুপুরে তদন্ত কমিটি থেকে রাজীবকে বাদ দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন লালবাগ বিভাগের এডিসি মারুফ হোসেন। তিনি একাই তদন্ত করছেন। গত রাত সাড়ে ৮টায় মারুফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্ত প্রতিবেদন রাতেই জমা দেওয়া হবে। কী পাওয়া গেছে, তা তদন্তের স্বার্থে জানানো যাবে না।' সূত্র জানায়, গতকাল রাত ৮টার দিকে তদন্ত কমিটি কথা বলেছে ওই নারী ও তাঁর মা-বাবার সঙ্গে।
যেমন আছেন ওই নারী : যাকে নিয়ে এত ঘটনা, সেই নারী এখন মুষড়ে পড়েছেন। গতকাল তাঁর বাড়িতে যাওয়া একজন মানবাধিকারকর্মী কালের কণ্ঠকে জানান, বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তাঁর বাড়িতে শত শত মানুষ ভিড় করছে। এ অবস্থায় বেশ মুষড়ে পড়েছেন তিনি। তাঁকে পুলিশের তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ডাকা হয়। এ ছাড়া মানবাধিকারকর্মীরাও তদন্ত করছেন। সেসব বিষয় নিয়ে ওই নারী কারো সঙ্গেই আর কথা বলতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, 'আমার বাবাকে পুলিশ নির্যাতন করেছে, সেটার যা করার করেন।' কিন্তু তাঁর শ্লীলতাহানির বিষয়ে আর কাউকে তিনি কিছু বলতে চান না। গতকাল সকাল থেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ওই নারী। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বুঝিয়ে রাজধানীর উত্তরখান চানপাড়া বাজার এলাকার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যায় সাক্ষ্য গ্রহণ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
আদালত চত্বরে নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ক্ষোভ : আদালত চত্বরে পুলিশের হাতে বিচারপ্রার্থী নারীর শ্লীলতাহানি এবং সাংবাদিক ও আইনজীবীদের নির্যাতন-হয়রানির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ৬৭টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের প্লাটফরম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, উইমেন ফর উইমেন, কর্মজীবী নারী, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, গণসাক্ষরতা অভিযান, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, জাতীয় মহিলা সংস্থা, প্রশিকা, বিলস, এডাব, জাতীয় শ্রমিক জোট ও কেয়ার বাংলাদেশ।
রাতে ওই নারী পুলিশের লালবাগ ডিসি অফিসে : রাত ৮টার দিকে ওই নারী মামলা করতে পুলিশের লালবাগের ডিসির অফিসে যান। তাঁর সঙ্গে পরিবারের সদস্য এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের লোকজন রয়েছে বলে জানা গেছে। রাত ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁরা লালবাগের ডিসি অফিসেই অবস্থান করছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.