মানুষের মুখ-সুখেই আছে পলাশ by কিঙ্কর আহসান
রাজু চত্বরের পাশ দিয়ে হাঁটছি। রোদ্দুরে ঘেমে-নেয়ে একাকার। দু-একজন ফুলবালিকা ফুল নিয়ে আসছে বারবার। হাতের টুকরিতে বাসি ফুল। গোলাপের পাপড়িতে পড়েছে কাঁলচে দাগ। ধমক দিলেও শোনে না মেয়েগুলো। না কেনা পর্যন্ত নিস্তার নেই ওদের কাছ থেকে। পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতেই চোখ পড়ে পলাশের ওপর।
আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। বলে, ‘চকলেট ন্যান্ ভাইজান। প্রতিটা এক টাকা।’ কথায় অনুরোধের চেয়ে আদেশের সুরই বেশি। হাতের ঝুড়িতে ওর কমদামি চকলেট। এগুলো বিক্রি করেই দিন চলে ছেলেটার। টিএসসিতে সময় কাটাতে আসা মানুষগুলোর প্রায় সবাই-ই চেনে পলাশকে। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল। মুখে হাসি লেগে থাকে সব সময়। মায়া মায়া দুটো চোখ। পরনে হাফপ্যান্ট। পুরোনো হলেও গায়ের ধোয়া কোর্তা আর সব পথশিশু থেকে আলাদা করেছে তাকে। সারা দিনের বিক্রিতে খুব একটা আয় হয় না। তাতে দুঃখ নেই। গাল টিপে আদর করি ওকে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও একটা চকলেট কিনি। তারপর পাশে বসিয়ে গল্প শুরু করি।
পলাশের বাড়ি ভৈরবে। বাড়ির কথা মনে পড়ে না খুব একটা। থাকে মায়ের সঙ্গে। ছোট্ট একটা বোন ছিল। বড় আদরের বোন। মা কাজে বাইরে গেলে পলাশই সব সময় থাকত বোনকে নিয়ে। বোনটাও ভাই-ন্যাওটা। ঘর বলতে তাদের আছে কোনোরকমের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেখান থেকেই একদিন বোনটাকে চুরি করে নিয়ে যায় কারা যেন। তারপর খোঁজা হয়েছে অনেক। মা আর ছেলে মিলে পথে ঘুরে ঘুরে করেছে বিলাপ। লাভ হয়নি তাতে। পাওয়া যায়নি বোনটাকে। এই নিয়ে কিছুদিন মন খারাপ ছিল পলাশের। যায়নি কাজে। তারপর আবার যেইকে সেই। খেতে তো হবে। কষ্ট ভুলে চকলেটের ঝুড়িটা নিয়ে আসা হয়েছে টিএসসিতে। ভালোই আছে পলাশ। সবাই তাকে ভালোবাসে।
টিএসসিতে অনেকগুলো সংগঠন। সেখানকার বড় ভাই আর আপুগুলো আদর করেন পলাশকে। তাঁদের সঙ্গে দুষ্টুমি করলে কিছু বলেন না। অনেক জ্বালাতনের পর কখনো কখনো কিনেও নেয় দু-একটা চকলেট। বিক্রি হওয়ার পর টাকা তুলে দেয় সে মায়ের হাতে। পলাশের কাছে এটাই জীবন। এর বেশি কিছু ঢোকে না তার মাথায়। ইশকুলের কথা তোলা হয় না আমার। ঠিকমতো খেতেই পায় না যে ছেলেটি ইশকুল তো তার কাছে বিলাসিতার শামিল।
বন্ধুর সংখ্যাও কম নয় পলাশের। সমবয়সী অনেকেই চকলেট আর ফুল বিক্রি করে। তাদের সঙ্গে মজা করে মারামারি করা হয়। কখনো পরিত্যক্ত পলিথিন পেলে তাতে কাগজ ভরে খেলা হয় ফুটবল। ক্যানটিনে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী খেতে এলেই দল মেলে হাত পাতা হয়। কেউ কিছু দেয়, আবার কেউ বা তাড়িয়ে দেয় দূর-দূর করে। তখন মন খারাপ হয়। গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো ধনী মানুষ হতে ইচ্ছে করে। তাদের সঙ্গে নাকি কেউ কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। খাওয়া নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না কখনো। মেজাজ খারাপ থাকলে মাঝেমধ্যে মারেন মা। পেটানোর পর আবার নিজেই কাঁদেন। জড়িয়ে ধরে আদর করেন ছেলেকে। কষ্টে ঘেরা একটা অতীত আছে তাঁর। তবে বর্তমানটাও যে খুব সুখের, তা কিন্তু নয়। ছেলেটাকে নিয়ে কোনোমতে পার করা হয় দিনগুলো। উপোস থাকার ভয় দূর হয় না কিছুতেই। পলাশ অবশ্য এসব নিয়ে ভাবে না তেমন একটা। খুব বেশি খিদে পেলে চুপি চুপি নিজেরই ঝুড়িতে থাকা একটা চকলেটের খোসা খুলে পুরে দেয় মুখে। এতে অবশ্য খিদে দূর হয় না। তবে দুধের স্বাদ ঘোলে কিছুটা হলেও মেটে। রোদ কমে। ধীরে ধীরে বিকেলের মিষ্টি আলোতে ছেয়ে যায় চারপাশটা। আমাদের কথা ফুরায় না। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করার ছিল অনেক কিছুই। কথা বলতে মন্দ লাগছিল না। কিন্তু হাতে সময় নেই। চৌপর দিন আমার সঙ্গে গল্প করলে চকলেটগুলো কে বিক্রি করবে? তাই তো পথে জ্যাম লাগলেই ছুটে যায় পলাশ। ছুটে যায় মানুষের ভিড়ে। আকুতি দেখে তার কেউ হয়তো কিনে নেবে একটা চকলেট। তাতেই খুশি পলাশ। খুশি পলাশের মা। বড্ড বেশি খুশি। তখন অবাক লাগে। কত অল্পতেই-না খুশি হয়ে ওঠে এই মানুষগুলো!
পলাশের বাড়ি ভৈরবে। বাড়ির কথা মনে পড়ে না খুব একটা। থাকে মায়ের সঙ্গে। ছোট্ট একটা বোন ছিল। বড় আদরের বোন। মা কাজে বাইরে গেলে পলাশই সব সময় থাকত বোনকে নিয়ে। বোনটাও ভাই-ন্যাওটা। ঘর বলতে তাদের আছে কোনোরকমের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেখান থেকেই একদিন বোনটাকে চুরি করে নিয়ে যায় কারা যেন। তারপর খোঁজা হয়েছে অনেক। মা আর ছেলে মিলে পথে ঘুরে ঘুরে করেছে বিলাপ। লাভ হয়নি তাতে। পাওয়া যায়নি বোনটাকে। এই নিয়ে কিছুদিন মন খারাপ ছিল পলাশের। যায়নি কাজে। তারপর আবার যেইকে সেই। খেতে তো হবে। কষ্ট ভুলে চকলেটের ঝুড়িটা নিয়ে আসা হয়েছে টিএসসিতে। ভালোই আছে পলাশ। সবাই তাকে ভালোবাসে।
টিএসসিতে অনেকগুলো সংগঠন। সেখানকার বড় ভাই আর আপুগুলো আদর করেন পলাশকে। তাঁদের সঙ্গে দুষ্টুমি করলে কিছু বলেন না। অনেক জ্বালাতনের পর কখনো কখনো কিনেও নেয় দু-একটা চকলেট। বিক্রি হওয়ার পর টাকা তুলে দেয় সে মায়ের হাতে। পলাশের কাছে এটাই জীবন। এর বেশি কিছু ঢোকে না তার মাথায়। ইশকুলের কথা তোলা হয় না আমার। ঠিকমতো খেতেই পায় না যে ছেলেটি ইশকুল তো তার কাছে বিলাসিতার শামিল।
বন্ধুর সংখ্যাও কম নয় পলাশের। সমবয়সী অনেকেই চকলেট আর ফুল বিক্রি করে। তাদের সঙ্গে মজা করে মারামারি করা হয়। কখনো পরিত্যক্ত পলিথিন পেলে তাতে কাগজ ভরে খেলা হয় ফুটবল। ক্যানটিনে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী খেতে এলেই দল মেলে হাত পাতা হয়। কেউ কিছু দেয়, আবার কেউ বা তাড়িয়ে দেয় দূর-দূর করে। তখন মন খারাপ হয়। গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো ধনী মানুষ হতে ইচ্ছে করে। তাদের সঙ্গে নাকি কেউ কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। খাওয়া নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না কখনো। মেজাজ খারাপ থাকলে মাঝেমধ্যে মারেন মা। পেটানোর পর আবার নিজেই কাঁদেন। জড়িয়ে ধরে আদর করেন ছেলেকে। কষ্টে ঘেরা একটা অতীত আছে তাঁর। তবে বর্তমানটাও যে খুব সুখের, তা কিন্তু নয়। ছেলেটাকে নিয়ে কোনোমতে পার করা হয় দিনগুলো। উপোস থাকার ভয় দূর হয় না কিছুতেই। পলাশ অবশ্য এসব নিয়ে ভাবে না তেমন একটা। খুব বেশি খিদে পেলে চুপি চুপি নিজেরই ঝুড়িতে থাকা একটা চকলেটের খোসা খুলে পুরে দেয় মুখে। এতে অবশ্য খিদে দূর হয় না। তবে দুধের স্বাদ ঘোলে কিছুটা হলেও মেটে। রোদ কমে। ধীরে ধীরে বিকেলের মিষ্টি আলোতে ছেয়ে যায় চারপাশটা। আমাদের কথা ফুরায় না। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করার ছিল অনেক কিছুই। কথা বলতে মন্দ লাগছিল না। কিন্তু হাতে সময় নেই। চৌপর দিন আমার সঙ্গে গল্প করলে চকলেটগুলো কে বিক্রি করবে? তাই তো পথে জ্যাম লাগলেই ছুটে যায় পলাশ। ছুটে যায় মানুষের ভিড়ে। আকুতি দেখে তার কেউ হয়তো কিনে নেবে একটা চকলেট। তাতেই খুশি পলাশ। খুশি পলাশের মা। বড্ড বেশি খুশি। তখন অবাক লাগে। কত অল্পতেই-না খুশি হয়ে ওঠে এই মানুষগুলো!
No comments