ব্যবসায়ীকে খুনিদের হাতে তুলে দিল পুলিশ! by মাসুদ রানা

গ্রেপ্তারের পর বালু ব্যবসায়ী মো. মামুন ভূঁইয়াকে পরানো হয় হাতকড়া। পথে পুলিশ তাঁকে তুলে দেয় সন্ত্রাসীদের হাতে। পুলিশের উপস্থিতিতেই মামুনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে হাতকড়া খুলে লাশ সেখানেই ফেলে রাখে পুলিশ। নিষ্ঠুর এই ঘটনা ঘটেছে গত মঙ্গলবার রাতে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকায়।


তবে কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনায়েত হোসেনের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁর দাবি, থানায় নিয়ে আসার পথে গ্রামবাসী মামুনকে ছিনিয়ে নেয় এবং কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশ ভয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
মামুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের অবহেলার প্রমাণ পেয়েছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হোসেন। দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। মো. মামুন কালীগঞ্জ উপজেলার মুক্তারপুর ইউনিয়নের বড়গাঁও গ্রামের হোসেন আলী ভূঁইয়ার ছেলে। সংসারে মামুনের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, মামুনের সঙ্গে মুক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য হেকিম ফরাজির একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় করা মামলায় জামিনে ছিলেন মামুন। অপর একটি মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে কালীগঞ্জ থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) নৃপেন চন্দ্র দে আরও তিনজন আনসার সদস্য নিয়ে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বড়গাঁও বাজার এলাকা থেকে মামুনকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারের পর বাজারের অনেক লোকের সামনেই তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে একটি অটোরিকশায় (গাজীপুর-ঠ-১১-৪৫৭৯) বসিয়ে থানার দিকে রওনা হন তাঁরা।
মামুনের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, থানায় যাওয়ার পথে উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের গোপাল মাস্টারের পুকুরের কাছে পৌঁছালে অটোরিকশাটি থেমে যায়। ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ইউপি সদস্য হেকিম ফরাজি ও তাঁর ভাতিজা জাহাঙ্গীর ফরাজির নেতৃত্বে সাত-আটজন সন্ত্রাসী। মামুনকে তাঁদের হাতে তুলে দেয় পুলিশ। সন্ত্রাসীরা পুলিশের সামনেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে মামুনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায়। হত্যাকাণ্ডের পরপরই মামুনের হাতকড়া খুলে নেয় পুলিশ।
রাত ১২টার দিকে মামুনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কালীগঞ্জ থানার এসআই মুরাদ আলী শেখ মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মামুনের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাঁর মাথা, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গতকাল বুধবার গাজীপুর সদর হাসপাতালের মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত হয়।
পুলিশের বক্তব্য: কালীগঞ্জ থানার এসআই নৃপেন চন্দ্র দে দাবি করেন, তিনি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে মামুনকে গ্রেপ্তার করতে বড়গাঁও বাজারে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসেন।
এসআই নৃপেনের মাথা খারাপ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন থানার ওসি মো. এনায়েত হোসেন। তিনি দাবি করেন, ‘মামুন একটি মামলার পরোয়ানাভুক্ত আসামি। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে এসআই নৃপেন চন্দ্র দেসহ চারজন পুলিশ সদস্য মামুনকে বড়গাঁও বাজার থেকে গ্রেপ্তার করে। থানায় নিয়ে আসার পথে রাত আটটার দিকে রামচন্দ্রপুরে অনেক লোক হামলা চালিয়ে মামুনকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু রাতে অনেক লোক থাকায় কার না কার গায়ে গুলি লাগে, এই ভয়ে পুলিশ গুলি চালায়নি। পরে রাত ১২টার দিকে মামুনের লাশ উদ্ধার করা হয়।’
গতকাল রামচন্দ্রপুর এলাকায় ঘটনাস্থলে গিয়ে কালীগঞ্জ থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার রাতে তাঁরা চিৎকার ও হইচইয়ের শব্দ শুনেছেন। তবে গ্রামবাসী কারও ওপর হামলা বা কাউকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়নি। এমন কোনো ঘটনাও তাঁরা শোনেননি। গতকাল সকালে তাঁরা জানতে পারেন, মামুন নামের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।
মাতম: বড়গাঁও গ্রামে মামুনদের বাড়িতে চলছিল মাতম। দিনভর বাড়িতে ভিড় করেছিল গ্রামের লোকজন। শোকে পাথর হয়েছিলেন মা মোমেনা বেগম। মামুনের স্ত্রী রেহেনা বেগম শিশু ছেলে ইমনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন। বলছিলেন, ‘আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল, হেরে কুপিয়া মারল। এহন আমার পুলা-মাইয়্যা নিয়ে কই যামু। কেরা আমাগো দেখব।’
মামুনের বাবা হোসেন আলী কাজ করেন পার্শ্ববর্তী ঘোড়াশাল সার কারখানায়। তিনি বলেন, ‘মামুন দীর্ঘদিন বড়গাঁও বাজারে মুদির ব্যবসা করত। পাঁচ-ছয় মাস আগে ওই ব্যবসা ছেড়ে বালুর ব্যবসা শুরু করে। ওর ইচ্ছা ছিল বিদেশে যাবে। তার জন্য পাসপোর্টও করা হয়েছিল।’
প্রতিপক্ষের ক্ষোভের শিকার মামুন: মামুনের ভাতিজা সাইদুল ইসলাম বলেন, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মামুন বর্তমান চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম ওরফে তোরণের প্রতিপক্ষের হয়ে কাজ করেন। এতে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
মামুনের বড় ভাই নাজমুল ভূঁইয়া বলেন, ছয়-সাত মাস আগে একটি মুঠোফোন থেকে মামুনকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কালীগঞ্জ থানায় তখন একাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। জিডিতে মুক্তারপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান শরিফুলের পক্ষের লোক সাবেক ইউপি সদস্য হেকিম ফরাজিসহ কয়েকজনের নামও রয়েছে।
নাজমুল অভিযোগ করেন, প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করে তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে মামুনকে গ্রেপ্তার করায়। পরে মামুনকে তাদের হাতে তুলে দেয় পুলিশ এবং তাদের উপস্থিতিতে মামুনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে গ্রামবাসী ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করেছে বলে মিথ্যা গল্প রচনা করেছে পুলিশ।
অভিযোগ অস্বীকার: মামুন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সাবেক ইউপির সদস্য হেকিম ফরাজি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। আমরা কেউ তাঁকে হত্যা করিনি।’
ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা: মামুন হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের জন্য মঙ্গলবার রাতেই কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের বলেন, ‘কালীগঞ্জে গণপিটুনিতে এক ডাকাত নিহত হয়েছে।’ ডাকাতির সংবাদ হিসেবে প্রচারের জন্য তিনি স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিককে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেন।
পুলিশের অবহেলার প্রমাণ: ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে জানান, ঘটনার তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হোসেনকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন, ‘রামচন্দ্রপুর গ্রামবাসী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে মামুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কালীগঞ্জ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যের অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.