বাসের ধাক্কায় ঝরে গেল ১২ প্রাণ-গ্রামে যাওয়ার পথে শেষ চার পরিবার

গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিল ওরা। রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা একসঙ্গে মিলে ভোরেই রওনা হয়েছিল। কথা ছিল গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক উৎসব আমেজে দুই দিন কাটিয়ে শুক্রবার রাজধানীতে ফিরে আসার। কিন্তু মর্মান্তিক একটি দুর্ঘটনা নিঃশেষ করে দিল চারটি পরিবার।


মহাসড়কে বাসের ধাক্কায় শেষ হয়ে গেল একই মাইক্রোবাসে থাকা ১২টি তাজা প্রাণ। গতকাল বুধবার ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কদমপুরে এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই শিশুসহ ১০ জন প্রাণ হারায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যায় আরো দুজন।
পুলিশ ও নিহতদের স্বজনরা জানায়, রাজধানীর রাজাবাজারের বাসা থেকে গতকাল ভোরে গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখীপুরের আরশিনগরে যাচ্ছিল চারটি পরিবারের ১২ জন।
তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি মহাসড়কের কদমপুরে পৌঁছার পর বরিশাল থেকে ঢাকামুখী সাকুরা পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। প্রচণ্ড ধাক্কায় মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে। এতে মাইক্রোবাসের চালকসহ সব আরোহী প্রাণ হারায়। নিহতরা হলেন ভেদরগঞ্জ উপজেলার আরশিনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম এম জাকির হোসেন সর্দারের স্ত্রী বেবী সর্দার (৪৫), মেয়ে লুবাব সর্দার (১২), বোন ফেরদৌসী বেগম মিনা (৪৫), মিনার ছেলে সায়েম হাসান বাবু মোল্লা (২১), জাকিরের আরেক বোন রোজিন বেগম (৩৫), তাঁর স্বামী রেজাউল আমিন লেলিন (৩৮), তাঁদের ছেলে ইয়াশ আমিন (৮) ও মেয়ে ইশরা (১), জাকিরের মেজো বোন রেবার মেয়ে তাজরিয়ান নূর (১২), লেলিনের বাসার গৃহকর্মী খুরশেদা খুশু (১৪), মিনার বাসার গৃহকর্মী কোহিনুর মনি (১৩) ও মাইক্রোবাসচালক সোহেল রানা (৩০)। তাঁদের মধ্যে বেবী ও লুবাবকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ও র‌্যাব দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১০টি মৃতদেহ উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে।
দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসের যাত্রীদের মধ্যে একমাত্র বেঁচে আছে লেলিনের বাসার আরেক গৃহকর্মী স্বপ্না (১৪)। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এ দুর্ঘটনায় বাসের অন্তত ২০ যাত্রী আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে আমিনুল, সেন্টু ও জুলহাস নামের তিনজন মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
মহাসড়কের পাশে খাদে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাস ও বাসটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে ঘাতক বাসের চালক তপু পালিয়ে গেছে। এ ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে।
থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মাইক্রোবাসের (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-২৬৩৪) সঙ্গে সাকুরা পরিবহনের বাসটির (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-২২৪৪) মুখোমুখি সংঘর্ষের পর দুটি গাড়িই উল্টে যায়। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মাইক্রোবাসটি রাস্তার পাশের খাদে পড়ে যায়। মাইক্রোবাস থেকে ১২ জনের মৃতদেহ ও একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। লাশগুলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানোর পর স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়।
বাসটি ছিল 'রং সাইডে' : পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মাওয়ার দিক থেকে আসা বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রং সাইডে যাওয়ার কারণেই এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। রহমত আলী ও জনি নামের দুই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মাইক্রোবাসটি রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে নিয়ম মেনেই যাচ্ছিল। হঠাৎ বাসটি ডানে চেপে গেলে মাইক্রোবাসের সঙ্গে সজোরে সংঘর্ষ হয়। এতে দুটি গাড়িই রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে উল্টে যায়। বাসের যাত্রীরা বেরিয়ে আসতে পারলেও মাইক্রোবাসের ভেতরে থাকা কারো সাড়া ছিল না। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনার পরই বাসচালক ও হেলপার পালিয়ে গেছে। দক্ষিণ কেরানাীগঞ্জ থানার ওসি জানান, নিহতদের স্বজনরা অভিযোগ না দেওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে।
লাশের ভিড় দেখে স্বজনদের বিলাপ : দুর্ঘটনার পর নিহতদের মরদেহ গতকাল সকালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আনা হলে সেখানে ভিড় জমায় স্বজনরা। প্রিয়মুখগুলোর নিথর দেহ চোখের সামনে দেখে অনেকে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অনেকে ভেঙে পড়ে কান্নায়। এ সময় পুরো হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হয় শোকবিধুর পরিবেশ।
স্বজনরা জানায়, রাজাবাজারের কাছাকাছি চারটি বাসায় থাকত দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত চারটি পরিবার। নিহত মিনার ননদ রেহানা বলেন, 'সকালে যখন ওরা রওনা হয়, তখনো কথা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরই পাই এমন মর্মান্তিক খবর। এতগুলো প্রিয় মানুষের এমন অকালমৃত্যু কিভাবে মেনে নিই?'
গতকাল দুপুর সোয়া ২টায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একসঙ্গে নিহত সবার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লাশগুলো স্বজনরা দাফনের জন্য নিয়ে যায়। জাকির সর্দারের ফুফাতো ভাই ড. সোবহান জানান, জাকিরের স্ত্রী বেবী, মেয়ে লুবাব, মেজো বোন রেবার মেয়ে তাজরিয়ান ও দুই গৃহকর্মীর লাশ গতকাল স্বর্ণদ্বীপ-৮ লঞ্চে শরীয়তপুর নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেলে লেলিন, তাঁর স্ত্রী রোজিনা, ছেলে ইয়াশ ও মেয়ে ইশরার লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। মিনা ও তাঁর ছেলে বাবুর লাশ সিএমএইচে হিমাগারে রাখা হয়েছে। তিন দিন পর মিনার আরেক ছেলে দেশে ফিরলে লাশ দুটি দাফন করা হবে। মাইক্রোবাসের চালক সোহেল রানার লাশ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাসচালকের ভাই আবদুর রহমান জানান, তাঁদের বাবার নাম আলী আহমেদ। বাসা নারায়ণগঞ্জে। সোহেল ঢাকা সিটি করপোরেশনের চালক ছিলেন। লেলিনের ভগ্নিপতি ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা। তাঁর মাধ্যমে মাইক্রোবাসটি রিকুইজিশন নিয়েছিলেন লেলিন।
শোক প্রকাশ : যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। এ ছাড়া গতকাল দুপুরে মর্গে নিহতদের মরদেহ দেখতে যান জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী।

No comments

Powered by Blogger.