নারী নির্যাতন-রুমানা, আপনার জন্য by শম্পা ইফতেখার
নির্যাতিত নারীর তালিকায় যুক্ত হওয়া নতুন নাম রুমানা মঞ্জুর। উজ্জ্বল তার পরিচিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ভদ্র ও মেধাবী অমিত সম্ভাবনাময়ী এ নারী অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কাণ্ডারি হতেন নারী শিক্ষায় ও নেতৃত্বে পিছিয়ে পড়া এ দেশটির; তার মেধার বিচ্ছুরিত আলোয় আলোকিত হতো আরও কিছু মানুষ।
কিন্তু ৫ জুনের বীভৎস সেই ঘটনা তাকে দাঁড় করিয়েছে বিলাসী, হেনা_ অত্যাচারিত হাজারো নারীর কাতারে। বেদনাক্লিষ্ট, যন্ত্রণায় কাতর সেই মুখ পুরুষের নির্মমতা আর নারীর অসহায়ত্বের স্বাক্ষর মাত্র। কিছুদিন আগেই প্রকাশিত রিপোর্টে নারীদের জন্য ভয়ঙ্কর, বিপজ্জনক দেশের তালিকায় কঙ্গো, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নাম উঠে এসেছে। আমাদের দেশেও নারীরা স্বাধীন বা নিরাপদ নয় অনেকার্থে। এখানে পারিবারিক নির্যাতনে কেউবা সন্তানসহ আত্মাহুতি দেয়, কেউবা পুরুষের বিকৃত লালসার শিকার হয়। আবার বহু ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়।
সনজিদার আত্মহত্যা, ইয়াসমিন, হেনা হত্যা সব একসূত্রে গাঁথা_ পুরুষতান্ত্রিক দখলদারিত্ব। রুমানার ঘটনা হয়তো এ তালিকা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; কিন্তু উদ্বেগজনক। কারণ এত শিক্ষিত ও উচ্চবংশীয় পরিবারের এ নির্যাতন সমাজে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি ফেলবে। এ ঘটনা পারিবারিক নির্যাতনের নতুন মাত্রা মাত্র। রুমানার মতো উচ্চশিক্ষিত নারী যদি অত্যাচারিত হন পিতৃগৃহে থেকেও, তাহলে অর্ধশিক্ষিত গৃহবধূদের অবস্থা কী হতে পারে_ তা খুব সহজেই অনুমেয়।
প্রশ্ন এখানেই।
রুমানা আপনাকে বলছি_ আপাতত সুখী চেহারা নিয়ে আপনি ক্লাসে গিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, নিজের পড়ালেখার জন্য কানাডা গেলেন, মাতৃত্বের স্বাদও নিয়েছেন। একই সঙ্গে সহ্য করেছেন আপনার 'হতাশাগ্রস্ত ও বেকার' (মিডিয়ার ভাষায়) স্বামীর। কেন? হয়তো বংশমর্যাদা আর সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু বংশমর্যাদার চেয়ে ব্যক্তিজীবনের সুস্থ বিকাশ মনে হয় অনেক জরুরি। একইভাবে আপনার সন্তান আনুশেহ যখন আপনাকে নির্যাতিত হতে দেখত, তার মানসিক যে কষ্ট তা নিশ্চিতভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়ক নয়। সন্তানের দোহাই দিয়ে স্বামীর অত্যাচার সয়ে যাওয়া তাই খুব একটা বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়; যেখানে আপনার নিজের আয় ছিল, একটি বিশাল পরিচিতিও ছিল।
হাসান সাইদ যথেষ্ট সাবলীলভাবে তার স্বামীত্ব দেখিয়েছেন। ফেসবুকে কাকে বল্পুব্দ রাখবেন, কার সঙ্গে কতক্ষণ আড্ডা দেন_ সব বিষয়ে খবরদারিত্ব দেখিয়েছেন। কী নির্লজ্জ আধিপত্যবোধ! আরও নির্লজ্জ তার দেওয়া অপবাদগুলো। গ্রেফতারের প্রথমদিনই খুব আলাভোলা চেহারা নিয়ে ক্যামেরার সামনে বললেন স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্কের কথা। এ নিয়ে তার হতাশার কথা। মিথ্যাচার তো বটেই; কিন্তু গতানুগতিক এই ধারার দোষারোপ বহুকাল ধরে চলছে। কারণ নারীকে নির্যাতন করা মাত্র পুরুষতান্ত্রিক এ মনোভাব নতুন কিছু নয়। এখানে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞভাবে কানাডায় রুমানার প্রতিবেশী প্রবাসীদের ধন্যবাদ দেব। কারণ তারাই সর্বাগ্রে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এ মিথ্যাচারের। তারা সাক্ষী, কীভাবে রুমানা পড়াশোনার বিশাল চাপে থেকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন মোবাইল ফোনে। তারাই জানান, শুধু পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবেন বলে গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে আসেন তিনি।
হাসান সাইদ ঘটনার যে দৃশ্যকল্প সাজিয়েছেন, তা বুদ্ধিদীপ্ত_ অস্বীকার করার জো নেই। স্ত্রীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চশমা খুলে যাওয়া, আঙুল ভেবে নাকে কামড় দেওয়া, কীভাবে রুমানা চোখে আঘাত পান, সে বিষয়ে তার অজ্ঞতা_ আপাতদৃষ্টিতে সম্ভাব্যই মনে হয়। লুকিয়ে থাকা কয়েকটি দিন তিনি যে প্রচুর চিন্তা-ভাবনা করে এ গল্প বানিয়েছেন, তা নিশ্চিত। হাসান সাইদকে বলা হচ্ছে মানসিকভাবে অসুস্থ ও হতাশাগ্রস্ত। এসব বিশেষণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পুরুষতান্ত্রিক সমবেদনা আদায়ের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
রুমানা, আজ আপনি দেশে। আপনার দুটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে; কাজেই আজ পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে লেখা কোনো কলামই আপনি পড়তে পারেননি, পারবেন কি-না জানি না।
আমাদের প্রত্যাশা, উন্নত চিকিৎসার বদৌলতে আজ বা কাল আপনি আপনার হারানো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। নতুনভাবে বাঁচতে শেখাবে এ ঘটনা আপনাকে এবং আমাদের। প্রতিদিন নির্যাতিত হওয়ার চেয়ে রুখে দাঁড়ানো, একা থাকা অনেক ভালো। আমাদের পুরুষনির্ভরশীলতা অনেকাংশে নির্যাতনের জন্য দায়ী। আমার সন্তানকে যদি সুশিক্ষা দিয়ে সুস্থ পরিবেশে একাই বড় করতে পারি, কী দরকার তাহলে অমানুষ, বিকৃত কোনো পুরুষকে স্বামী সাইনবোর্ড দিয়ে পাশে রাখার? এ বদ্ধকূপ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, সাহসী হতে হবে। শুরু করতে হবে নতুন এক অধ্যায়ের।
সন্তান ও পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তায় অত্যাচারিত হওয়া নয়, যথার্থ স্বামী না হলে একাই নিতে হবে সন্তানের দায়িত্ব। আজ আপনি শুরু করুন; দেখবেন, নতুন দিনের শুরুটা আপনার হাত দিয়ে হবে। তথাকথিত নির্বিবাদ ও ভালো সেজে থাকার দিন বোধহয় আর নেই। আপনার জন্য রইল শুভ কামনা।
শম্পা ইফতেখার : শিক্ষক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
সনজিদার আত্মহত্যা, ইয়াসমিন, হেনা হত্যা সব একসূত্রে গাঁথা_ পুরুষতান্ত্রিক দখলদারিত্ব। রুমানার ঘটনা হয়তো এ তালিকা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; কিন্তু উদ্বেগজনক। কারণ এত শিক্ষিত ও উচ্চবংশীয় পরিবারের এ নির্যাতন সমাজে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি ফেলবে। এ ঘটনা পারিবারিক নির্যাতনের নতুন মাত্রা মাত্র। রুমানার মতো উচ্চশিক্ষিত নারী যদি অত্যাচারিত হন পিতৃগৃহে থেকেও, তাহলে অর্ধশিক্ষিত গৃহবধূদের অবস্থা কী হতে পারে_ তা খুব সহজেই অনুমেয়।
প্রশ্ন এখানেই।
রুমানা আপনাকে বলছি_ আপাতত সুখী চেহারা নিয়ে আপনি ক্লাসে গিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, নিজের পড়ালেখার জন্য কানাডা গেলেন, মাতৃত্বের স্বাদও নিয়েছেন। একই সঙ্গে সহ্য করেছেন আপনার 'হতাশাগ্রস্ত ও বেকার' (মিডিয়ার ভাষায়) স্বামীর। কেন? হয়তো বংশমর্যাদা আর সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু বংশমর্যাদার চেয়ে ব্যক্তিজীবনের সুস্থ বিকাশ মনে হয় অনেক জরুরি। একইভাবে আপনার সন্তান আনুশেহ যখন আপনাকে নির্যাতিত হতে দেখত, তার মানসিক যে কষ্ট তা নিশ্চিতভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়ক নয়। সন্তানের দোহাই দিয়ে স্বামীর অত্যাচার সয়ে যাওয়া তাই খুব একটা বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়; যেখানে আপনার নিজের আয় ছিল, একটি বিশাল পরিচিতিও ছিল।
হাসান সাইদ যথেষ্ট সাবলীলভাবে তার স্বামীত্ব দেখিয়েছেন। ফেসবুকে কাকে বল্পুব্দ রাখবেন, কার সঙ্গে কতক্ষণ আড্ডা দেন_ সব বিষয়ে খবরদারিত্ব দেখিয়েছেন। কী নির্লজ্জ আধিপত্যবোধ! আরও নির্লজ্জ তার দেওয়া অপবাদগুলো। গ্রেফতারের প্রথমদিনই খুব আলাভোলা চেহারা নিয়ে ক্যামেরার সামনে বললেন স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্কের কথা। এ নিয়ে তার হতাশার কথা। মিথ্যাচার তো বটেই; কিন্তু গতানুগতিক এই ধারার দোষারোপ বহুকাল ধরে চলছে। কারণ নারীকে নির্যাতন করা মাত্র পুরুষতান্ত্রিক এ মনোভাব নতুন কিছু নয়। এখানে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞভাবে কানাডায় রুমানার প্রতিবেশী প্রবাসীদের ধন্যবাদ দেব। কারণ তারাই সর্বাগ্রে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এ মিথ্যাচারের। তারা সাক্ষী, কীভাবে রুমানা পড়াশোনার বিশাল চাপে থেকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন মোবাইল ফোনে। তারাই জানান, শুধু পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবেন বলে গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে আসেন তিনি।
হাসান সাইদ ঘটনার যে দৃশ্যকল্প সাজিয়েছেন, তা বুদ্ধিদীপ্ত_ অস্বীকার করার জো নেই। স্ত্রীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চশমা খুলে যাওয়া, আঙুল ভেবে নাকে কামড় দেওয়া, কীভাবে রুমানা চোখে আঘাত পান, সে বিষয়ে তার অজ্ঞতা_ আপাতদৃষ্টিতে সম্ভাব্যই মনে হয়। লুকিয়ে থাকা কয়েকটি দিন তিনি যে প্রচুর চিন্তা-ভাবনা করে এ গল্প বানিয়েছেন, তা নিশ্চিত। হাসান সাইদকে বলা হচ্ছে মানসিকভাবে অসুস্থ ও হতাশাগ্রস্ত। এসব বিশেষণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পুরুষতান্ত্রিক সমবেদনা আদায়ের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
রুমানা, আজ আপনি দেশে। আপনার দুটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে; কাজেই আজ পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে লেখা কোনো কলামই আপনি পড়তে পারেননি, পারবেন কি-না জানি না।
আমাদের প্রত্যাশা, উন্নত চিকিৎসার বদৌলতে আজ বা কাল আপনি আপনার হারানো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। নতুনভাবে বাঁচতে শেখাবে এ ঘটনা আপনাকে এবং আমাদের। প্রতিদিন নির্যাতিত হওয়ার চেয়ে রুখে দাঁড়ানো, একা থাকা অনেক ভালো। আমাদের পুরুষনির্ভরশীলতা অনেকাংশে নির্যাতনের জন্য দায়ী। আমার সন্তানকে যদি সুশিক্ষা দিয়ে সুস্থ পরিবেশে একাই বড় করতে পারি, কী দরকার তাহলে অমানুষ, বিকৃত কোনো পুরুষকে স্বামী সাইনবোর্ড দিয়ে পাশে রাখার? এ বদ্ধকূপ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, সাহসী হতে হবে। শুরু করতে হবে নতুন এক অধ্যায়ের।
সন্তান ও পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তায় অত্যাচারিত হওয়া নয়, যথার্থ স্বামী না হলে একাই নিতে হবে সন্তানের দায়িত্ব। আজ আপনি শুরু করুন; দেখবেন, নতুন দিনের শুরুটা আপনার হাত দিয়ে হবে। তথাকথিত নির্বিবাদ ও ভালো সেজে থাকার দিন বোধহয় আর নেই। আপনার জন্য রইল শুভ কামনা।
শম্পা ইফতেখার : শিক্ষক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
No comments