চট্টগ্রামের নির্বাচন-কে হারল—ব্যক্তি না দল? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কে হারল—ব্যক্তি মহিউদ্দিন, না তাঁর দল আওয়ামী লীগ? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা জরুরি হয়ে পড়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে। কেননা ১৭ মাসের আওয়ামী লীগ সরকার, না ১৭ বছরের মেয়র মহিউদ্দিন, কার প্রতি অনাস্থা জানালেন চট্টগ্রামের মানুষ—এ তথ্যটা জানা না থাকলে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ তাঁদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে।


একটা সময় ছিল যখন দলকে ছাপিয়ে উঠেছিল মহিউদ্দিনের ভাবমূর্তি। ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে বিএনপি সরকারের আমলে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। প্রতিবাদে শত শত মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়। মিছিল-ভাঙচুর-বিক্ষোভে তখন লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছিল চট্টগ্রাম। মনে পড়ে, দৈনিক ইত্তেফাক সেদিন লাল রঙে বড় বড় হরফে শীর্ষ শিরোনাম করেছিল—‘চট্টগ্রাম জ্বলছে’। এর অল্প কিছুদিন পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির অন্য অনেক কারণের মধ্যে মহিউদ্দিনকে গ্রেপ্তারের এই হঠকারিতারও একটি ভূমিকা আছে বলে মনে করেন অনেকে।
চট্টগ্রাম তথা দেশের উন্নয়নের স্বার্থে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন তিনি। বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকা’র (এসএসএ) সঙ্গে একটি অসম চুক্তির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বেসরকারি কন্টেইনার টার্মিনাল তাদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছিলেন মহিউদ্দিন। নির্মাণের পর ২০০ বছর পর্যন্ত এর মালিকানা এসএসএ ভোগ করবে—এমন চুক্তি সম্পাদিত হতে যাচ্ছিল তখন। কিন্তু আন্দোলনের কারণে পরবর্তীকালে সেই এসএসএ সুরসুর করে ৯৯ বছর, এমনকি শেষ পর্যন্ত ৩৩ বছরের মালিকানা পেলেও সম্মত হয়ে এটাই প্রমাণ করেছিল, জেনে বা না-জেনে কত বড় ভুল করতে যাচ্ছিল তৎকালীন সরকার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আদালতের রায়ে এসএসএর সঙ্গে চুক্তি করার উদ্যোগটিই ভেস্তে যায়।
এভাবে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে দল-মতের ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মহিউদ্দিন। তিন-তিনবার মেয়র নির্বাচিত হয়ে চট্টগ্রামের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতির উন্নয়নে অনেক উল্লেখ করার মতো উদ্যোগ নিয়ে জনসমর্থনের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন তিনি।
আয় করে দায় শোধের একটি পন্থা মহিউদ্দিন বের করেছিলেন তাঁর সৃজনশীলতা দিয়ে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, মানসম্মত স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নগরে প্রথম ও সর্ববৃহৎ সিএনজি স্টেশন, আধুনিক শৌচাগার ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজ পক্ষান্তরে সিটি করপোরেশনের উপার্জনের পথও সুগম করেছে। ফলে সরকারের কাছ থেকে নগরের জন্য যে অপ্রতুল বরাদ্দ পাওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ তিনি ব্যয় করতে পেরেছেন নগরের উন্নয়নে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের নেতা-নেত্রীদের যেখানে সাফল্য, প্রায় সেখানেই তাঁদের সীমাবদ্ধতা।
সিটি করপোরেশনের জন্য অর্থের সংকুলান করতে গিয়ে একসময় এই সেবাপ্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে ফেললেন মহিউদ্দিন। এখান থেকেই নগর পরিকল্পনাবিদ, সুশীল সমাজ ও সচেতন নগরবাসীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের সূচনা। তত দিনে তাঁর চারপাশে গড়ে উঠেছে চাটুকারের মৌচাক। আত্মবিশ্বাসী মহিউদ্দিন ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হলেন দাম্ভিক মহিউদ্দিনে। ইতিমধ্যে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির জন্যও আলোচিত হয়েছেন তিনি। তাঁর স্ত্রী ও জামাতার নানা অপকর্ম নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা আছে সচেতন মহলে।
বিশেষত তৃতীয় দফায় নির্বাচিত হওয়ার পর মহিউদ্দিন হয়ে ওঠেন নিয়ন্ত্রণহীন। চট্টগ্রামে তিনিই দল, তাঁর সিদ্ধান্তই দলের সিদ্ধান্ত। নিজের হাতে তিনি নগর কমিটি গঠন করেন, যাঁকে খুশি দলে জায়গা দেন, বাদও দেন পছন্দমতো। দলে যাঁদের স্থান দিয়েছেন তাঁদের মান দেননি, যাঁদের আত্মসম্মান বোধ আছে তাঁরা থেকেছেন দূরে। নগর আওয়ামী লীগ পরিচালিত হয় তাঁর চশমা হিলের বাসভবন থেকে, এর কোনো প্রকৃত সাংগঠনিক রূপ নেই।
সুতরাং প্রশ্ন যখন ওঠে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল হারল না ব্যক্তি, স্বাভাবিকভাবেই এর উত্তর ‘ব্যক্তি’। কিন্তু এতে দলের কি কোনো দায় নেই? সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামে সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে কি কোনো খোঁজ নিয়েছিল আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড? প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে এখানকার নেতা-কর্মীদের মনোভাবের কি কোনো মূল্যায়ন হয়েছে? কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আগেই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছিলেন মহিউদ্দিন। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ পাওয়ার আগেই নাগরিক কমিটির ব্যানারে প্রচারণায় নামা বা তাঁর পক্ষে ‘গৃহপালিত’ ১৪ দলের সমর্থন নেওয়ার মধ্যে একধরনের ব্ল্যাকমেল করার প্রচেষ্টা ছিল না? আওয়ামী লীগকে কেন অসহায়ের মতো সেই ফাঁদে পা দিতে হলো? দলীয় বিভক্তি এড়াতে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিভক্তি কি এড়ানো সম্ভব হয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় ডেকে নিয়ে গিয়ে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ-অভিযোগ শুনেছেন, তাঁদের সান্ত্বনা দিয়ে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ‘তালগাছ আমার’ অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে শত ক্ষোভ-অভিযোগ থাকলেও তিনিই প্রার্থী থাকবেন—এমন পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত ক্ষোভ নিরসন তো করেই না, বরং নতুন করে হতাশার সৃষ্টি করে। সেই হতাশাই নির্বাচনের দিন দেখা গেছে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর মধ্যে। ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়’—এ যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। নির্বাচনে তার খেসারতই দিতে হয়েছে।
আমাদের ধারণা, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কোনো আধুনিক ধ্যানধারণাসম্পন্ন তরুণকে প্রার্থী করতে পারলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের পথ সুগম হতো। কেননা এখানকার মানুষ ব্যক্তির পরিবর্তন চেয়েছে, দলের নয়। সারা দেশে আওয়ামী লীগ যে কারণে সমালোচিত হচ্ছে—টেন্ডারবাজি, ছাত্রলীগের ঔদ্ধত্য, গ্যাস-বিদ্যুৎ প্রভৃতি সমস্যা চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠেনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ সারা দেশের সমস্যা। দুর্ভোগ সত্ত্বেও তার জন্য সরকারকে আরও কিছু সময় দেওয়ার পক্ষে যুক্তি আছে। টেন্ডারবাজি ও ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো (সম্প্রতি হাটহাজারী কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড অমার্জনীয়) এখানে খুব একটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। বরং গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামুন, দুলু, সুনীল, চন্দন, বাবরের মতো অসংখ্য সন্ত্রাসী যে নগরবাসীর ঘুম হারাম করে রেখেছিল, তারা এখনো প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পায়নি বলে তুলনামূলক ভালো আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এসব কারণেই মনে হয়, দলের দায় কাঁধে নিয়ে নয়, মহিউদ্দিনকে হারতে হয়েছে নিজের কৃতকর্মের জন্য।
আমাদের ধারণা, মহিউদ্দিন এখন ইতিহাসের বিষয়। নির্বাচনী উত্তাপ মিইয়ে যাওয়ার পর নানা কারণে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত নগরবাসী নিশ্চয়ই অনেক কিছু ভুলে যাবে। মহিউদ্দিনের কর্মকাণ্ডে ভরা অতীত, চট্টগ্রামের জন্য তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করবে দীর্ঘকাল। কিন্তু দলীয়ভাবে যে ক্ষতি আওয়ামী লীগের হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে হলে নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন্দলে জর্জরিত, নানা উপদলে বিভক্ত নেতাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেই ভালো। তাঁরা নিজের ও অনুগত ব্যক্তিদের অবস্থান নিয়ে যতটা উদগ্রীব, দল পুনর্গঠনের ব্যাপারে ততটা আন্তরিক বলে মনে হয় না। নতুন রক্ত সঞ্চার করতে পারলেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের সংগঠন ও রাজনীতি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.