চারদিক-‘আম-কাঠলি’ by আকমল হোসেন
ফল তো কমবেশি বারো মাসই পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু ফল আছে মেঘ-বাদলার সঙ্গে যাদের ঘোরতর সম্পর্ক। এই ফলগুলো যেন মাস-মৌসুম ঠিক করে একসঙ্গে মিলেমিশে গাছে আসে। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় রং বদলায়, একসঙ্গে পাক ধরে। আম, কাঁঠাল, আনারস, জাম, লিচু—আরও অনেক জাতের স্থানীয়-অস্থানীয় ফল আছে, যা এই মৌসুমে গাছে গাছে তার রূপ-লাবণ্য মেলে ধরে।
ফলের পাকা ঘ্রাণে মথিত হয় বাতাস। দেখতে ও স্বাদে আলাদা হলেও এই ফলের সবাই সবার প্রতিবেশী। জাতপাত যা-ই হোক, তারা পাতে প্রায় একসঙ্গেই ওঠে।
এখন সময় যদিও এই ফল-ফলারির ওপর তার ছোবলটা বেশ ভালোই দিয়েছে। অনেক ফলই আর দেখা যায় না। তবু আম, কাঁঠাল বা আনারস—এগুলো কমবেশি এখনো আছে। উপায় নেই তার থেকে চোখ ফেরানোর। দানাদার, কাঁটাঅলা ও টসটসে ফল দেখা যাবে, আর জিবে জল আসবে না—এটাও ভাবা মুশকিল। কিন্তু এই দেখাদেখি বা ঘরে বসে পরিবার-পরিজন নিয়ে একান্তে ফলভোজন। এর মধ্যেই ফলের মৌসুমটা ফুরিয়ে যেতে পারে না।
আর সম্ভবত একসঙ্গে এত ফল আসে বলেই এই ফলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক পারিবারিক ও সামাজিক পার্বণের। শুধু মৌলভীবাজারই নয়, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অনেক এলাকায় ঘরে ঘরে এখন চলছে ‘আম-কাঠলি’ দেওয়া-নেওয়া। ধনী-দরিদ্র বলে কথা নেই। যাঁর যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী কমবেশি ফল নিয়ে মেয়ের বাড়িতে ছুটছেন সবাই। আম-কাঠলি উপলক্ষে মেয়ের বাড়িতে জমে উঠছে উৎসবের আনন্দ। জ্যৈষ্ঠ বা আষাঢ় মাসে মেয়ের বাড়িতে মৌসুমি ফল দেওয়ার এ রেওয়াজ এই অঞ্চলটিতে যুগযুগের। আর এই রেওয়াজকে পালক দিতেই মৌসুমি ফলের বাজার এখন কেনাবেচায় রমরমা হয়ে উঠেছে।
মৌলভীবাজার শহরে এই সময়ে মৌসুমি ফলের সবচেয়ে বড় বাজার বসে কোর্ট মার্কেটে। শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজার, রবিরবাজার, কমলগঞ্জের আদমপুর, রাজনগরের টেংরাবাজারসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁঠাল ও আনারস নিয়ে আসেন পাইকারেরা। প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার কাঁঠাল ও আনারস বিক্রি হচ্ছে এই খুচরা বাজারে। কোর্ট মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতা-বিক্রেতার হই-হুল্লোড়ে এখন বাজারটি জমজমাট। বাজার ভাসছে পাকা কাঁঠাল ও আনারসের ঘ্রাণে। ছোট ট্রাক, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ঠেলাগাড়িতে বোঝাই করা হচ্ছে কাঁঠাল, আনারস, আম ও খই। এগুলো আম-কাঠলি হিসেবে মেয়ের বাড়িতে পাঠানো হবে।
কেনাকাটায় ব্যস্ত সদর উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের দুঘর গ্রামের সুফিউর রহমান বললেন, ‘আমি মেয়ের বাড়িতে আম-কাঠলি দেব বলে কেনাকাটা করছি। জ্যৈষ্ঠ বা আষাঢ় মাসে এই অঞ্চলের লোকজন মেয়ের বাড়িতে আম-কাঠলি দিয়ে থাকেন। এটা অনেক দিন ধরে চলে আসছে।’ সফিউর রহমান জানান, তিনি মেয়ের বাড়িতে পাঠানোর জন্য কাঁঠাল, আনারস, আম ও খই কিনেছেন। স্থানীয় লোকজন জানালেন, জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই মেয়ের বাড়িতে একধরনের প্রতীক্ষা থাকে বাবার বাড়ি থেকে আম-কাঠলি যাওয়ার। বাবা-মা বা অভিভাবকেরাও মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। মেয়ে নাতি-নাতনি পেয়ে গেলেও বাবার বাড়ি থেকে আম-কাঠলি পাঠানো হয়ে থাকে। তবে নতুন বিয়ে হলে আম-কাঠলি দেওয়ার ধুমধাম বেশি হয়ে থাকে। নতুন মেয়ের বাড়িতে প্রথম আম-কাঠলি পাঠাতে ফলের পরিমাণ বেশিই দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে মিষ্টি। দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজন মেয়ের বাড়িতে ভিড় করে। খানাপিনায় ছোটখাটো বিয়ের মতো হয়ে যায় আয়োজন। কোনো কোনো অভিভাবক আছেন, তাঁরা যে শুধু মেয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে থাকেন, এমন নয়। ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকেও আম-কাঠলি পেয়ে থাকেন। যদিও বিত্তবানদের ক্ষেত্রে এই উৎসব আনন্দেরই। দরিদ্র মানুষের এই প্রথা মানতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়। তবু হাত-পা গুটিয়ে থাকেন না তাঁরাও। মেয়ের মান রাখতে, জামাই, নাতি-নাতনি ও মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের খুশি করতে দু-চারটা কাঁঠাল, দুই-চার হালি আনারস, এক-দুই কেজি আম ও এক কেজি খই নিয়ে হলেও মেয়ের বাড়িতে যান। এটাই নিয়ম, এটাই প্রথা। আম-কাঠলি দিতে না পারলে কোনো কোনো পরিবারে মন কষাকষির ঘটনাও ঘটে।
কোর্ট মার্কেটে প্রায় ১৫ বছর ধরে মৌসুমি ফল বিক্রি করেন ওয়াহিদ মিয়া। তিনি বলেন, কেউ মেয়ের বাড়ি, কেউ বোনের বাড়ি আম-কাঠলি দেওয়ার জন্য গাড়ি ভরে ফল কিনে নিচ্ছেন। সাধারণত গাড়ি দিয়ে যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার ফল কিনছেন। ওয়াহিদ মিয়াসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারা জানান, কোর্ট মার্কেটে এখন প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ জন বিক্রেতা কাঁঠাল ও আনারস নিয়ে বসছেন। প্রতিদিন ছয় থেকে সাত লাখ টাকার আম, কাঁঠাল ও আনারস বিক্রি হচ্ছে। এই মার্কেটের বড় ক্রেতাই হচ্ছেন আম-কাঠলির ক্রেতা। বাজারে থাকতে থাকতেই ছয়-সাতটি গাড়ি আম-কাঠলি নিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে গেল। অভাব-অনটন, টানাপোড়েন যা-ই থাক, আম-কাঠলির পুরোনো এ প্রথাটি এই অঞ্চলে পারিবারিক বন্ধনের সম্পূর্ণ আলাদা এক উচ্ছ্বাস।
No comments