আজম খান স্মরণে-গুরু তোমায় সালাম by আইয়ুব বাচ্চু
আজম খানের (গুরু) সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭৬ সালে, চট্টগ্রাম মুসলিম হল মিলনায়তনে। এর আগে টিভিতে তাঁর অনুষ্ঠান দেখেছি। এবার তিনি আসছেন চট্টগ্রামে, আর আমি তাঁর অনুষ্ঠান দেখতে পারব না! যেভাবেই হোক দেখব। গুরুর দারুণ ভক্ত ছিলাম, এখনো আছি।
এখন যেমন আমাদের শো দেখার জন্য অল্প বয়সী ছেলেরা জোর করে হলে ঢোকার চেষ্টা করে, আমরাও ঠিক তেমনই করেছিলাম। দরজা ধাক্কাধাক্কি করে কয়েকজন বন্ধু ভেতরে ঢুকে গেলাম। মানুষের গায়ের ওপর দিয়ে আমি একেবারে মঞ্চের সামনে চলে যাই। স্যান্ডেল হারিয়েছি, ঘড়ি হারিয়েছি, শার্ট ছিঁড়ে গেছে—এর পরও গুরুর সামনে তো পৌঁছাতে পেরেছি। ব্যাপারটা গুরু মঞ্চ থেকেই খেয়াল করেছেন। অনুষ্ঠানের মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার সময় আয়োজকদের দিয়ে মঞ্চের পেছনে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করো?’
‘গিটার বাজাই।’ আমি বললাম।
হাসিমুখে তিনি বললেন, ‘লেগে থাকো।’
আজও ভেবে অবাক হই, একজন মানুষকে এতগুলো মানুষ একসঙ্গে একই রকম ভালোবাসে—কীভাবে সম্ভব!
১৯৭৮ সালে ফিলিংস এবং ১৯৮০ সালে সোলসে যোগ দিই। ঢাকায় আসি। এদিকে মাথায় ঘুরছে, গুরুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
একদিন এক বন্ধুর সহযোগিতায় ঢাকার কমলাপুরে গুরুর বাসায় যাই। যোগাযোগ শুরু। এরপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি আমাকে যে স্নেহ দিয়েছেন, আদর দিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন, যে মায়া করেছেন—আমি বাবার কাছ থেকেও তা পাইনি। ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করি। তিনি প্রায়ই ফোন করতেন।
একই মঞ্চে গুরুর সঙ্গে অনেক গান করেছি। প্রথম গান করেছিলাম কমলাপুরের এজিবি কলোনিতে। ১৯৯২ সালের গোড়ার দিকের কথা। কয়েকজন ছেলেকে দিয়ে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। রাত তখন দেড়টা। গিয়ে দেখি, ওটা গুরুর শো। বললেন, ‘ওরা সবাই এখন তোমার গান শুনবে।’
সেদিন প্রায় ভোর পর্যন্ত ওই মঞ্চে গান করেছিলাম। গুরুর সঙ্গেও বাজিয়েছি। তিনি আমার গিটার বাজানো খুব পছন্দ করতেন। মনেপ্রাণে ছিলেন রকার। আর ভক্ত ছিলেন নয়ন মুন্সীর। তিনি গুরুর সঙ্গে গিটার বাজাতেন। মাঝে একটা সময় গুরুর ব্যস্ততা একেবারেই কমে যায়। আমি বলব, অনেকেই গুরুকে এড়িয়ে চলেছেন।
তখন একটা সুযোগ আসে, ডি-রকস্টার প্রতিযোগিতা। গুরুকে এই প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে সম্পৃক্ত করা হয়। এরপর তাঁকে বিভিন্ন কনসার্টেও কাছে পাই। ‘এম ফেস্ট’, মিরপুর স্টেডিয়ামে হয়েছিল। দেশি ব্যান্ডের পাশাপাশি ছিল বিদেশি ব্যান্ডও। ওই কনসার্টে গুরু সবাইকে দেখিয়ে দিলেন তাঁর ক্ষমতা! আমিও সেদিন অনুভব করেছিলাম, জীবন্ত কিংবদন্তী কাকে বলে! গুরু ছিলেন বাংলা রক গানের জীবন্ত কিংবদন্তী।
আরও একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে, ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’ অনুষ্ঠান। সময়টা ছিল ২০০১ সাল। গুরুর সঙ্গে সেদিন একই মঞ্চে আমরা অনেকে অংশ নিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের আগে আমাদের স্টুডিওতে তিনি এলেন, প্র্যাকটিস করলেন। ‘আসি আসি বলে তুমি’ আর ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’—মঞ্চে গুরু সেদিন প্রাণ খুলে গেয়েছিলেন আর আমরা বাজিয়েছিলাম।
মঞ্চে আমরা ফিটফাট হয়ে উঠি। কিন্তু গুরু ছিলেন তাঁর উল্টো। সাদামাটা একটা শার্ট আর ট্রাউজার। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটি আমি কখনোই ভুলব না, সেটা খালি পা। মঞ্চে তিনি কখনোই জুতা বা স্যান্ডেল পায়ে উঠতেন না। খালি পায়ে পারফর্ম করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন।
স্বাধীনতার পর তিনিই প্রথম বাংলা রক গান গাওয়া শুরু করলেন। তখন তো ইংরেজি গানের চর্চাই বেশি ছিল। গুরু বাংলা রক গানকে শহরে, হাটে-ঘাটে-মাঠে নিয়ে এলেন। এরই ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। তাঁর দেখিয়ে দেওয়া পথে আমরা সবাই হাঁটছি। আমি এবার একটা দিকে গুরুর পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। গুরুর মৃত্যুর পর গত এক বছরে তাঁর গান একেবারেই শুনিনি। আজম খানের গানকে ছড়িয়ে দিতে হবে। একটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে—গুরুর গানের কথা ও সুর যেন বিকৃত না হয়। গুরুর গান গেয়ে আর তাঁর গান শুনেই তাঁকে সম্মান জানাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
আগামী ৫ জুন আজম খানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গুরু তোমায় সালাম।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করো?’
‘গিটার বাজাই।’ আমি বললাম।
হাসিমুখে তিনি বললেন, ‘লেগে থাকো।’
আজও ভেবে অবাক হই, একজন মানুষকে এতগুলো মানুষ একসঙ্গে একই রকম ভালোবাসে—কীভাবে সম্ভব!
১৯৭৮ সালে ফিলিংস এবং ১৯৮০ সালে সোলসে যোগ দিই। ঢাকায় আসি। এদিকে মাথায় ঘুরছে, গুরুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।
একদিন এক বন্ধুর সহযোগিতায় ঢাকার কমলাপুরে গুরুর বাসায় যাই। যোগাযোগ শুরু। এরপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি আমাকে যে স্নেহ দিয়েছেন, আদর দিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন, যে মায়া করেছেন—আমি বাবার কাছ থেকেও তা পাইনি। ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করি। তিনি প্রায়ই ফোন করতেন।
একই মঞ্চে গুরুর সঙ্গে অনেক গান করেছি। প্রথম গান করেছিলাম কমলাপুরের এজিবি কলোনিতে। ১৯৯২ সালের গোড়ার দিকের কথা। কয়েকজন ছেলেকে দিয়ে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। রাত তখন দেড়টা। গিয়ে দেখি, ওটা গুরুর শো। বললেন, ‘ওরা সবাই এখন তোমার গান শুনবে।’
সেদিন প্রায় ভোর পর্যন্ত ওই মঞ্চে গান করেছিলাম। গুরুর সঙ্গেও বাজিয়েছি। তিনি আমার গিটার বাজানো খুব পছন্দ করতেন। মনেপ্রাণে ছিলেন রকার। আর ভক্ত ছিলেন নয়ন মুন্সীর। তিনি গুরুর সঙ্গে গিটার বাজাতেন। মাঝে একটা সময় গুরুর ব্যস্ততা একেবারেই কমে যায়। আমি বলব, অনেকেই গুরুকে এড়িয়ে চলেছেন।
তখন একটা সুযোগ আসে, ডি-রকস্টার প্রতিযোগিতা। গুরুকে এই প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে সম্পৃক্ত করা হয়। এরপর তাঁকে বিভিন্ন কনসার্টেও কাছে পাই। ‘এম ফেস্ট’, মিরপুর স্টেডিয়ামে হয়েছিল। দেশি ব্যান্ডের পাশাপাশি ছিল বিদেশি ব্যান্ডও। ওই কনসার্টে গুরু সবাইকে দেখিয়ে দিলেন তাঁর ক্ষমতা! আমিও সেদিন অনুভব করেছিলাম, জীবন্ত কিংবদন্তী কাকে বলে! গুরু ছিলেন বাংলা রক গানের জীবন্ত কিংবদন্তী।
আরও একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে, ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’ অনুষ্ঠান। সময়টা ছিল ২০০১ সাল। গুরুর সঙ্গে সেদিন একই মঞ্চে আমরা অনেকে অংশ নিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের আগে আমাদের স্টুডিওতে তিনি এলেন, প্র্যাকটিস করলেন। ‘আসি আসি বলে তুমি’ আর ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’—মঞ্চে গুরু সেদিন প্রাণ খুলে গেয়েছিলেন আর আমরা বাজিয়েছিলাম।
মঞ্চে আমরা ফিটফাট হয়ে উঠি। কিন্তু গুরু ছিলেন তাঁর উল্টো। সাদামাটা একটা শার্ট আর ট্রাউজার। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটি আমি কখনোই ভুলব না, সেটা খালি পা। মঞ্চে তিনি কখনোই জুতা বা স্যান্ডেল পায়ে উঠতেন না। খালি পায়ে পারফর্ম করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন।
স্বাধীনতার পর তিনিই প্রথম বাংলা রক গান গাওয়া শুরু করলেন। তখন তো ইংরেজি গানের চর্চাই বেশি ছিল। গুরু বাংলা রক গানকে শহরে, হাটে-ঘাটে-মাঠে নিয়ে এলেন। এরই ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। তাঁর দেখিয়ে দেওয়া পথে আমরা সবাই হাঁটছি। আমি এবার একটা দিকে গুরুর পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। গুরুর মৃত্যুর পর গত এক বছরে তাঁর গান একেবারেই শুনিনি। আজম খানের গানকে ছড়িয়ে দিতে হবে। একটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে—গুরুর গানের কথা ও সুর যেন বিকৃত না হয়। গুরুর গান গেয়ে আর তাঁর গান শুনেই তাঁকে সম্মান জানাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
আগামী ৫ জুন আজম খানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গুরু তোমায় সালাম।
No comments