এই দিনে-সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৫ বছর by সৈয়দা আখতার জাহান
হ্যাঁ, এ যুগের মানুষের কাছে প্রশ্ন করলে তাদের অনেকেই বলতে পারবে না, কী ঘটেছিল ১৮৫৫ সালে। ঘটনাস্থল ভারতের চব্বিশ পরগনা। এখন যার নাম হয়েছে সাঁওতাল পরগনা। এক অসামান্য ঐতিহাসিক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল এখানে। সে কথাই নতুন করে আবার বলছি।
সাঁওতাল সমাজে এই বিদ্রোহ ‘হুল’ নামে পরিচিত। আমাদের ইতিহাসে সেটা মহাজাগরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সাঁওতাল বিদ্রোহ হচ্ছে, জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের সশস্ত্র বিদ্রোহ। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন আশপাশের ৪০০ গ্রামের প্রায় ১০ হাজার লড়াকু মিলে এক গণসমাবেশের আয়োজন করেছিল, সেখান থেকেই সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুলের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সে এক অবিস্মরণীয় দিন; সে এক বীরত্বের জাগরণ। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ভাগনা ডিহি গ্রামের সাঁওতাল পরিবারের সিধো। সঙ্গী ছিলেন সিধোর তিন ভাই কানহো, চাঁদ ও ভায়রো এবং দুই বোন ফুলমণি ও জানমণি। সাঁওতালদের সবাই সেদিন শপথ নেয় অত্যাচারী ও নিপীড়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আর তাদের হারানো জমি উদ্ধার করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার।
সেই সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন সিধো ও কানহো। সমাবেশ থেকে ইংরেজ সরকার, কমিশনার, দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদারদের চরমপত্র পাঠানো হয় এবং ১৫ দিনের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়। কিন্তু ইংরেজরা দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। বিদ্রোহ দমনের নামে যে নৃশংস হত্যাভিযান চালানো হয়েছিল, তা আসলে গণহত্যা। ভাগলপুরে নিহত হন চাঁদ ও ভায়রো। ১৮৫৬ সালের নেতৃস্থানীয় সাঁওতালদের অধিকাংশই ধরা পড়েন। ফেব্রুয়ারি মাসে সিধো ও কানুসহ অন্যদের ফাঁসি দেওয়া হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয় সাঁওতালদের সব কটি গ্রাম। সাঁওতালদের রক্তে সিক্ত হয় রাজমহল পার্বত্য এলাকা। অবসান হয় এই গণবিদ্রোহের। সাঁওতাল বিদ্রোহের পরপরই সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা সৃষ্টি করা হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের মূলে ছিল ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ। সাঁওতালরা সম্পদের প্রথাগত সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করত। তারা মনে করত, যে ব্যক্তি জঙ্গল কেটে জমি চাষের উপযোগী করে, জমির মালিকানা তারই। মোগল সরকার এই ঐতিহ্যকে সম্মান করায় তখন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদারেরা জমির ওপর তাঁদের মালিকানার দাবি নিয়ে হাজির হন। এ ছাড়া মহাজনী শোষণ তো ছিলই। মহাজনী সুদ বাড়ত চক্রবৃদ্ধি হারে। সুদের হার ১০০ থেকে ৫০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। সুদ দিতে না পারলে মহাজনেরা তাদের গরু-মোষ থেকে শুরু করে ভিটেমাটি পর্যন্ত কেড়ে নিতেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাঁওতালরা অধিকার-সচেতন হয়ে ওঠে। তারা সংগঠিত হতে থাকে এবং ১৮১১, ১৮২০ ও ১৮৩১ সালে সাঁওতালদের অভ্যুত্থান ঘটে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ, সুসংগঠিত ও ব্যাপক বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় ১৮৫৫ সালে এবং তা দমন করতে সরকার কয়েক দফা সামরিক অভিযান পরিচালনা করে।
২.
সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৫তম বার্ষিকী আজ। দুই বাংলার সাঁওতালরা এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উদ্যাপন করে। কিন্তু বাংলাদেশে দিনটির নেই কোনো জাতীয় স্বীকৃতি। আদিবাসী ইস্যুকে সামনে আনার এবং আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে আদিবাসীদের সমানভাবে শামিল করার জন্য দিবসটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালিত হওয়া প্রয়োজন। সাঁওতালরাই সর্বপ্রথম নিজেদের এলাকায় সর্বস্তরের মেহনতি মানুষের ঐক্য গড়ে তুলেছিল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিতাড়িত করে এ দেশে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বীজ রোপণ করেছিল।
অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সামাজিক শোষণ, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার শিকার এ দেশের আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। জমি বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, জাল দলিল, জাতিগত বৈষম্য, হয়রানি ইত্যাদি তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। তাদের অস্তিত্ব আজ সংকটাপন্ন। তাদের উন্নয়নের জন্য অদ্যাবধি তেমন আন্তরিক ও জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা কী ধরনের উন্নয়ন চায়, সে ব্যাপারে তাদের অভিমত শোনার প্রয়োজন কখনো বোধ করেনি সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা। ফলে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে তারা অবস্থান করছে। কতকাল পারবে তাও নিশ্চিত নয়।
বাংলাদেশে বসবাসকারী সাঁওতালদের সংখ্যা তিন লাখের ওপরে। কৃষিভিত্তিক সমাজ আদিবাসী সাঁওতালদের—এটাই তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। কিছু কিছু আর্থসামাজিক কারণে বর্তমানে দারিদ্র্য অধিকাংশ সাঁওতালের নিত্যসঙ্গী। অধিকাংশ সাঁওতালই এখন ভূমিহীন কৃষক। সাঁওতালদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে ভূমি সমস্যা। শত শত বছর ধরে আদিবাসীরা যে জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করে আসছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সব ভূমির দলিল তাদের হাতে নেই। তারা ভূমি আইন, ভূমি ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর, খাজনা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন নয়। ফলে তাদের জমি ও বসতবাড়ি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। জমির দলিল জাল করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভয়ভীতি বা হুমকি তো আছেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎই সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ের বর্তমান পরিচয়। এ থেকে তাদের রক্ষা করতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ ভূমি সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
সেই সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন সিধো ও কানহো। সমাবেশ থেকে ইংরেজ সরকার, কমিশনার, দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদারদের চরমপত্র পাঠানো হয় এবং ১৫ দিনের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়। কিন্তু ইংরেজরা দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। বিদ্রোহ দমনের নামে যে নৃশংস হত্যাভিযান চালানো হয়েছিল, তা আসলে গণহত্যা। ভাগলপুরে নিহত হন চাঁদ ও ভায়রো। ১৮৫৬ সালের নেতৃস্থানীয় সাঁওতালদের অধিকাংশই ধরা পড়েন। ফেব্রুয়ারি মাসে সিধো ও কানুসহ অন্যদের ফাঁসি দেওয়া হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয় সাঁওতালদের সব কটি গ্রাম। সাঁওতালদের রক্তে সিক্ত হয় রাজমহল পার্বত্য এলাকা। অবসান হয় এই গণবিদ্রোহের। সাঁওতাল বিদ্রোহের পরপরই সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা সৃষ্টি করা হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের মূলে ছিল ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ। সাঁওতালরা সম্পদের প্রথাগত সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করত। তারা মনে করত, যে ব্যক্তি জঙ্গল কেটে জমি চাষের উপযোগী করে, জমির মালিকানা তারই। মোগল সরকার এই ঐতিহ্যকে সম্মান করায় তখন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদারেরা জমির ওপর তাঁদের মালিকানার দাবি নিয়ে হাজির হন। এ ছাড়া মহাজনী শোষণ তো ছিলই। মহাজনী সুদ বাড়ত চক্রবৃদ্ধি হারে। সুদের হার ১০০ থেকে ৫০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। সুদ দিতে না পারলে মহাজনেরা তাদের গরু-মোষ থেকে শুরু করে ভিটেমাটি পর্যন্ত কেড়ে নিতেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাঁওতালরা অধিকার-সচেতন হয়ে ওঠে। তারা সংগঠিত হতে থাকে এবং ১৮১১, ১৮২০ ও ১৮৩১ সালে সাঁওতালদের অভ্যুত্থান ঘটে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ, সুসংগঠিত ও ব্যাপক বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় ১৮৫৫ সালে এবং তা দমন করতে সরকার কয়েক দফা সামরিক অভিযান পরিচালনা করে।
২.
সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৫তম বার্ষিকী আজ। দুই বাংলার সাঁওতালরা এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উদ্যাপন করে। কিন্তু বাংলাদেশে দিনটির নেই কোনো জাতীয় স্বীকৃতি। আদিবাসী ইস্যুকে সামনে আনার এবং আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে আদিবাসীদের সমানভাবে শামিল করার জন্য দিবসটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালিত হওয়া প্রয়োজন। সাঁওতালরাই সর্বপ্রথম নিজেদের এলাকায় সর্বস্তরের মেহনতি মানুষের ঐক্য গড়ে তুলেছিল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিতাড়িত করে এ দেশে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বীজ রোপণ করেছিল।
অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সামাজিক শোষণ, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার শিকার এ দেশের আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। জমি বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, জাল দলিল, জাতিগত বৈষম্য, হয়রানি ইত্যাদি তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। তাদের অস্তিত্ব আজ সংকটাপন্ন। তাদের উন্নয়নের জন্য অদ্যাবধি তেমন আন্তরিক ও জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা কী ধরনের উন্নয়ন চায়, সে ব্যাপারে তাদের অভিমত শোনার প্রয়োজন কখনো বোধ করেনি সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা। ফলে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে তারা অবস্থান করছে। কতকাল পারবে তাও নিশ্চিত নয়।
বাংলাদেশে বসবাসকারী সাঁওতালদের সংখ্যা তিন লাখের ওপরে। কৃষিভিত্তিক সমাজ আদিবাসী সাঁওতালদের—এটাই তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। কিছু কিছু আর্থসামাজিক কারণে বর্তমানে দারিদ্র্য অধিকাংশ সাঁওতালের নিত্যসঙ্গী। অধিকাংশ সাঁওতালই এখন ভূমিহীন কৃষক। সাঁওতালদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে ভূমি সমস্যা। শত শত বছর ধরে আদিবাসীরা যে জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করে আসছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সব ভূমির দলিল তাদের হাতে নেই। তারা ভূমি আইন, ভূমি ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর, খাজনা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন নয়। ফলে তাদের জমি ও বসতবাড়ি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। জমির দলিল জাল করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভয়ভীতি বা হুমকি তো আছেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎই সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ের বর্তমান পরিচয়। এ থেকে তাদের রক্ষা করতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ ভূমি সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
No comments