কমিউনিটি রেডিও-প্রান্তিক মানুষের গণমাধ্যম by আশ্রাফ আবির
দেশে অনেক টিভি চ্যানেল, এফএম রেডিও থাকতেও বর্তমান সরকার আরও ১৪টি কমিউনিটি রেডিও স্থাপন ও সম্প্রচারের অনুমতি দিয়েছে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই। দীর্ঘ সময় ধরে যাচাই-বাছাই, এর পর এই অনুমতি। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে আরও একটি নতুন সংযোজন এই কমিউনিটি রেডিও।
সাধারণত কমিউনিটি রেডিও ছোট্ট ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বা আগ্রহীদের ঘিরেই কমিউনিটি রেডিও। বাণিজ্যিক রেডিওগুলো থেকে কমিউনিটি রেডিও একেবারেই আলাদা। বাণিজ্যিক রেডিওগুলোতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ যেখানে খুবই সীমাবদ্ধ, সেখানে কমিউনিটি রেডিও পরিচালিত হয়ই ওই কমিউনিটির অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব ঢং, সংস্কৃতি ও ভাষার সংমিশ্রণে। আনন্দের খবর অবশ্যই।
১৯৬০-এর দশকে বিবিসির স্থানীয় রেডিওর ধারণা দিয়ে শুরু হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই কমিউনিটি রেডিও পূর্ণ ধারণা লাভ করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ১৯৯৭ সালে নেপালে প্রথম কমিউনিটি রেডিও স্থাপিত হয়। এখন পর্যন্ত নেপালের প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ কমিউনিটি রেডিওর আওতায় এসেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৯০ সালে আন্না এফএম নামে প্রথম ক্যাম্পাসভিত্তিক কমিউনিটি রেডিও যাত্রা শুরু করে। পৃথিবীতে কয়েক ধরনের কমিউনিটি রেডিও দেখা যায়। তার মধ্যে কিছু ভৌগোলিক অবস্থানকে ঘিরে, আবার কিছু সংগীত, তথ্য বা ধর্মীয় ক্ষেত্রে সম-আগ্রহী। বিভিন্ন দেশে ক্যাম্পাস রেডিও বা ক্যাম্পাসভিত্তিক কমিউনিটি রেডিও সফলভাবে পরিচালনার নজির ভূরি ভূরি।
আমাদের দেশেও এখন পর্যন্ত সব থেকে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য গণমাধ্যম রেডিও। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে গৃহবধূরাও রেডিও ব্যবহার করে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য বা বিনোদনের জন্য। রাজধানীকেন্দ্রিক গণমাধ্যমগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে প্রান্তিক মানুষকে এড়িয়ে চলে। এগুলো দায়সারা গোছের কিছু কৃষি অনুষ্ঠান, টক শোতেই সীমাবদ্ধ। সারা দেশে যে রেডিও শুনতে পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। রাজনীতিক, বিশেষ করে সরকারদলীয়রা প্রাধান্য পায় বেশি। জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ খুব কম। গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠানের কারণে এর জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে দিন দিন, সেই সঙ্গে মানুষের আগ্রহও। অন্যদিকে, দেশের এফএম রেডিও স্টেশনগুলো সীমিতভাবে শুধু শহুরে এলাকার জন্য প্রচার করছে। তাদের মূল লক্ষ্যই বাণিজ্য। তথ্য থেকে বিনোদনকেই তারা প্রাধান্য দিচ্ছে। গান, বিজ্ঞাপন, আড্ডা আর বেতারের খবর ছাড়া অন্য কিছুতে এই রেডিওগুলোর আগ্রহ একটু কমই। শহুরে এলাকার বাইরে এগুলো শুনতেও পাওয়া যায় না।
কমিউনিটি রেডিওগুলো হবে তথ্যবহুল। নিজের অংশগ্রহণে এই রেডিও হয়ে উঠবে জনপ্রিয়। কমিউনিটির প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার থাকবে। কমিউনিটি রেডিওতে যে অনুষ্ঠানগুলো প্রচার হবে, তার ধরনও হবে আলাদা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলোই এতে প্রাধান্য পাবে। স্থানীয় সরকারকে আরও স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করে তোলার জন্য কমিউনিটি রেডিও ভূমিকা রাখবে। কমিউনিটি রেডিও বা প্রান্তিক মানুষের গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশ গড়ার কাজ এগিয়ে যাবে। এত দিন দুর্বল স্থানীয় গণমাধ্যম বলে যাদের আড়াল করে রাখা হয়েছে, তারাই হয়ে উঠবে শক্তিশালী। তৈরি হবে শক্তিশালী প্রান্তিক গণমাধ্যমকর্মী। সাধারণ মানুষ তার কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে পারবে এই রেডিওতে। স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই কণ্ঠস্বরকে নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। স্থানীয় সরকারও যেকোনো প্রয়োজনে রেডিওকে ব্যবহার করতে পারবে। সালিশ বা স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন বাজেটের প্রচার হতে পারে এর চমৎকার উদাহরণ।
আইন অনুযায়ী ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে কমিউনিটি রেডিও ১৭ কিমির বেশি সম্প্রচার করতে পারবে না। কমিউনিটি রেডিওর জন্য যে টাওয়ারটি বানানো হবে, তারও উচ্চতা ৩২ মিটারের বেশি হবে না। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে অনুষ্ঠান করলে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। বাণিজ্যিক কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। তবে উন্নয়নমূলক সামাজিক গুরুত্ব বা মূল্যবোধ রয়েছে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যেতে পারে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অথবা কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর প্রতি কটাক্ষ হানতে পারে এমন কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। বিদেশি সম্প্রচার সংস্থা/চ্যানেলের সংবাদ ও চলতি ঘটনাভিত্তিক অনুষ্ঠান, আলোচনা ও টক শো সরাসরি বা রেকর্ড করে সম্প্রচার করা যাবে না। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অনুমতিপ্রাপ্তির এক বছরের মধ্যে রেডিওস্টেশন স্থাপন করতে হবে।
অন্যান্য রেডিওর মতো কমিউনিটি রেডিও জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও চলবে। এই রেডিও এমন জায়গায় স্থাপন করতে হবে, যেখানে সাধারণ মানুষের সহজ প্রবেশাধিকার থাকবে। একটি কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের জন্য পাঁচ থেকে ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। পুরোটাই নির্ভর করে কে কেমন ব্যয় করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্টুডিওতে শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করা যায় আবার পাঁচ লাখ টাকাও ব্যয় করা যায়। যেহেতু রেডিওটি টিকে থাকার একটি প্রশ্ন রয়েছে, সেহেতু যতখানি খরচ না করলেই নয় তা-ই করা উচিত। যেহেতু কমিউনিটি রেডিওতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না, তাই রেডিওগুলোর ব্যবস্থাপনা হতে হবে শক্ত। কমিউনিটির মানুষের অংশগ্রহণেই রেডিও স্বাবলম্বী হবে। আয়ের উৎস হতে পারে অনুদান, উন্নয়নমূলক বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। স্টেশনে অন্যান্য সেবা দিয়েও আয় করা যায়। যেমন ইন্টারনেট সেবা, ফটোকপিসহ বিভিন্ন তথ্যসেবা। রেডিওতে বিভিন্ন রকম মিথস্ক্রিয়ামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করেও আয় করা সম্ভব। কমিউনিটি রেডিও ইন্টারনেটেও প্রচার করা যেতে পারে। এতে ওই রেডিও ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। প্রাথমিকভাবে কমিউনিটি রেডিওতে ২৪ ঘণ্টার প্রচার না করে স্টেশনগুলো সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে। খরচ কমানোর পাশাপাশি অন্য সময়গুলোতে স্টুডিও ভাড়া দিয়েও আয় করা সম্ভব।
যেসব প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি রেডিওর লাইসেন্স পেয়েছে, তাদের উচিত বিভিন্ন পর্যায়ে প্রস্তাবিত এলাকার মানুষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দেওয়া, রেডিওর গুরুত্ব বোঝানো, তাদের মধ্য থেকেই রেডিও পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা, স্টেশন চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাদের কাছ থেকেই পরিকল্পনা বের করা, কী করে তাদের রেডিওটি তারা চালাবে।
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা হয়তো অনেক সহজ, কিন্তু তা চালানো কঠিন। ‘আমরা করতে পারি’ এ রকম সুযোগ এখন এসেছে। এই সুযোগ কাজে লাগালে কমিউনিটি রেডিও হবে প্রান্তিক মানুষের হাতিয়ার।
আশ্রাফ আবির: তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী।
ashrafabir@gmail.com
No comments