আগের মন্ত্রীর সব 'না' বর্তমান মন্ত্রীর 'হ্যাঁ by আশরাফুল হক রাজীব
একই সরকারের আমলে পর পর দুজন মন্ত্রীর অধীনে দুই রকম নীতিতে চলছে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। আগের মন্ত্রীর আমলের সব 'না' অর্থাৎ বাতিল হওয়া সিদ্ধান্তগুলো বর্তমান মন্ত্রীর সময়ে 'হ্যাঁ' হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক সিদ্ধান্তের বদল হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে যেসব সিদ্ধান্তে মন্ত্রণালয় চলেছে, বর্তমানে সেসব সিদ্ধান্ত গতি পরিবর্তন করে উল্টো পথে বাঁক নিচ্ছে। আগের বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের যেসব সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিয়েছিলেন, বর্তমান মন্ত্রী ফারুক খান একের পর এক তা অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ ধরনের নতুন একটি সিদ্ধান্তের সুবাদে মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়রা লাভবান হবেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
বিমানে নতুন করে লোক নিয়োগের বিষয়ে বরাবরই আপত্তি ছিল জি এম কাদেরের। বিমানের অর্গানোগ্রাম হওয়ার আগে কোনো পদে লোক নিয়োগ করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া যেসব পদ থেকে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানো হয়েছে, সেসব পদে নতুন করে লোক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়েরও। এর পরও সেসব পদে এখন লোক নিয়োগ হচ্ছে।
জি এম কাদেরের বক্তব্য ছিল, যেখানে অর্গানোগ্রামই নেই, সেখানে লোক নিয়োগ হতে পারে না। বিমানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে লোক লাগবে, সেটা সাবেক মন্ত্রীও মানতেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, 'যেখানে উদ্বৃত্ত লোক রয়েছে, তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে পাঠান।' সাবেক এই মন্ত্রী ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ট্রাফিক হেলপার পদে লোক নিয়োগে আপত্তি জানিয়েছিলেন। একসময় তিনি বিমানে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ট্রাফিক হেলপার পদে লোক নিয়োগ চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে। শিগগিরই তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। আর কম্পানি হওয়ার পর বিমানের নতুন অর্গানোগ্রাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জানা গেছে, বিমানের চলমান অর্গানোগ্রামে ট্রাফিক হেলপার নামে কোনো পদ নেই।
বিমানের জনবলের প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ এবং সার্ভিস রুলস প্রণয়নের জন্য ভারতের একটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেলেও তারা এখনো অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত করতে পারেনি। এ অবস্থায়ও নতুন লোকবল নিয়োগের বিষয়টি থেমে নেই। বর্তমানে বিমানে অনুমোদিত জনবল রয়েছে তিন হাজার ৪০০ জন। ২০০৭ সালে বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে রূপান্তরের সময় এ জনবল নির্ধারণ করা হয়। তৎকালীন বিমানসচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি বিমানের জনবল কাঠামো ছয় হাজার ৮৩৭ থেকে তিন হাজার ৪০০ জনে নামিয়ে আনার সুপারিশ করে। এ কমিটির সুপারিশই কার্যকর করা হয় বিমানকে পাবলিক কম্পানি করার সময়। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারেনি বিমান। বিমানের বর্তমান জনবল চার হাজার ৬০৪ জন। এর মধ্যে স্থায়ী দুই হাজার ৭৬৫ জন, অস্থায়ী এক হাজার ৪১০ জন এবং চুক্তিভিত্তিক রয়েছেন ৪২৯ জন।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য কানাডিয়ান কম্পানি ভিজুয়াল ডিফেন্স ইনকরপোরেশন (ভিডিআই) প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল জি এম কাদেরের সময়। তারা ২৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ২৫ বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার নামে যাত্রীপ্রতি ৩৫ মার্কিন ডলার (প্রায় আড়াই হাজার টাকা) নিরাপত্তা ফি আদায় করার কথা ছিল ভিডিআইয়ের। কানাডিয়ান ওই কম্পানির প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায়ও অনুমোদন করা হয়েছিল। প্রাথমিক অবস্থায় তাতে সায় ছিল জি এম কাদেরেরও। কিন্তু যখন বুঝতে পারেন ভিডিআই নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাবে, তখন তিনি বাধা দেন। মন্ত্রিসভা অনুমোদনের পর ভিডিআইয়ের ফাইল প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অনুমোদন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অনড় ছিলেন জি এম কাদের। শেষ পর্যন্ত জি এম কাদের ভিডিআই ঠেকাতে পারলেও এবার দৃশ্যপটে এসেছে আরেক কানাডিয়ান কম্পানি এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট কানাডা (ইডিসি)। ইডিসির বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের মতামত নেওয়ার জন্য বিমান ও পর্যটনসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন বর্তমান মন্ত্রী ফারুক খান। বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে মেরামত ও আনুষঙ্গিক কাজের দরপত্র নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় তাতেও সম্মতি দেননি সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী। ১৪০ কোটি টাকার কাজের দর নিয়ে অতিমূল্যায়নের (বেশি দাম) অভিযোগ ছিল। জি এম কাদের থাকা অবস্থায় এ দরপত্রের ব্যাপারে কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। কাজ পায় অভিযুক্ত কম্পানিই।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন বর্তমান বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান। এর ফলে মন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ ও তাদের পুরনো ব্যবসায়িক অংশীদার ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন ইপকো বিমানবন্দর এলাকায় একটি পাঁচ তারা হোটেল ও শপিং আর্কেডসহ একটি তিন তারা হোটেল নির্মাণের অনুমতি পাচ্ছে। অথচ জি এম কাদের চেয়েছিলেন ইপকোর বিষয়ে যেন আদালতেই নিষ্পত্তি হয়। বর্তমান মন্ত্রী আদালতের বাইরে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছেন।
জানা গেছে, ন্যাম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশপথের ১৪৪ একর বা ৪৩৪ বিঘা জমির ওপর একটি পাঁচ তারা হোটেল, একটি তিন তারা হোটেল, একটি কান্ট্রি ক্লাব এবং এশিয়ার সবচেয়ে বড় গলফ কোর্স নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। একই বছর দরপত্র আহ্বান করা হয়। চুক্তির আওতায় পাঁচ তারা হোটেল নির্মাণের জন্য ইপকো হোটেলস লিমিটেড, তিন তারা হোটেল ও শপিং আর্কেডের জন্য ইপকো ডেভেলপমেন্ট (বিডি) লিমিটেড এবং গলফ কোর্স ও কান্ট্রি ক্লাব নির্মাণের জন্য ইপকো রিসোর্টস লিমিটেড নামের স্বতন্ত্র তিনটি কম্পানি গঠন করা হয়। এ জন্য বেবিচকের সঙ্গে তিনটি বিল্ড অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) চুক্তি ও তিনটি ল্যান্ড লিজ অ্যাগ্রিমেন্ট (এলএলএ) হয়। তবে ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর এলএলএ বাতিল করা হলেও পরে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর চুক্তি বাতিলের আদেশটি প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ইপকো জামানত ও লিজের টাকা জমা দিয়ে হোটেলের নির্মাণকাজ শুরু করে। এ সময় রাজউকের সঙ্গে নকশা নিয়ে জটিলতা দেখা দিলেও পরে তা মিটে যায়। তবে বেবিচকের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। বেবিচক ৬০ বছরের জন্য এ জমি হাতছাড়া করছে। কোনো প্রকার জরিপ, সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা না করে হোটেল ও গলফ ক্লাব নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। হোটেল নির্মাণের কার্যাদেশ পাওয়ার পর বিমানবন্দরে প্রবেশপথের বনজ ও ফলদ গাছগাছালিতে পূর্ণ এলাকাটি টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সব নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও ইপকো তিনটি ভবনের দুই থেকে তিন তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে তা বন্ধ করে দেয়। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশপথে এভাবে কাজ বন্ধ থাকায় পর্যটকদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত।
এমন পরিস্থিতিতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আতাহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে ইপকোর সঙ্গে বেবিচকের বিদ্যমান সমস্যা ও মামলা সম্পর্কে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বেবিচকের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য কর্মকর্তা এবং ইপকোর পক্ষে এর এমডি ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা ও অন্যরা অংশ নেন। ইপকোর প্রতিনিধিরা দাবি করেন, তাঁরা সমস্যাটি সমঝোতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য সব সময়ই আন্তরিক ছিলেন এবং এখনো আছেন। দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা চলতে থাকায় আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি সভাকে অবহিত করে ইপকোর পক্ষ থেকে বলা হয়, জমির দখল হস্তান্তর এবং পাঁচ তারা ও তিন তারা হোটেলের নির্মাণকাজ অনেক দূর অগ্রসর হলেও চলমান বিরোধের আজও সুরাহা হয়নি। ইপকো সরকারকে সহযোগিতা এবং লিজের টাকা পরিশোধ করতে প্রস্তুত জানিয়ে তিনটি ল্যান্ড লিজ অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী সম্পত্তির পরিপূর্ণ দখল বুঝিয়ে দিতে সভায় সভাপতিকে অনুরোধ করে। বেবিচকের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ইপকোর দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের দখল দেওয়া হয়নি এবং সেখানে কোনো নির্মাণকাজও শুরু হয়নি। বৈঠকে বেবিচকের চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমান বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের জন্য কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের নির্ধারিত জায়গা বেবিচকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন। আলোচনার একপর্যায়ে ইপকো কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের দাবি পরিত্যাগ করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। হোটেলের কাজ শুরুর অনুমতিসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানায়। সভায় সুপারিশ করা হয়, বেবিচকের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করে নেবে ইপকো। ইপকো কেবল হোটেল নির্মাণে সম্মতি জানানোর পর বেবিচক কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের চুক্তি বাতিল করবে। এ ছাড়া হোটেলের জায়গা পরিমাপ করে ইপকোকে বুঝিয়ে দেওয়াসহ বিধি মোতাবেক অবশিষ্ট নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেবে বেবিচক। অন্যদিকে ইপকো পরিশোধ করবে যাবতীয় পাওনা।
বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে ইপকোর সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছে। ১৪৪ একর জমির মধ্যে ১৪ দশমিক ৩২ একর ইপকোকে দেওয়া হবে। ইপকো এ জমিতে একটি পাঁচ তারা ও একটি তিন তারা হোটেল নির্মাণ করবে। কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ ক্লাব নির্মাণ করা হবে না। বাকি ১৩০ দশমিক ৪১ একর জমি সিভিল এভিয়েশনের দখলেই থাকবে। এ জমিতে বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজ করা হবে।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। এ ব্যাপারে একটি সমাধানে আসা দরকার। কিন্তু সমাধানটি যদি ইপকোর পক্ষে হয়, তাহলেই সমস্যা। কারণ যে জমিতে হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সরকারি উদ্যোগেই হোটেল হতে পারে। সোনারগাঁও ও রূপসী বাংলার মতো এসব হোটেল সরকার পরিচালনা করবে।
এসব বিষয়ে সাবেক বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি। বর্তমান মন্ত্রী ফারুক খান বলেন, 'বিধিবিধান ও নিয়মকানুন মেনেই ইপকো সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের স্বার্থ উপেক্ষা করে কিছু করা হচ্ছে না।'
মহাজোট সরকারের প্রথম দিন থেকেই মন্ত্রিসভায় রয়েছেন জি এম কাদের ও ফারুক খান। শুরুতে জি এম কাদের ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী। ফারুক খান ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। গত বছর নভেম্বর মাসে এ দুজনের মন্ত্রণালয় বদল হয়। বর্তমানে জি এম কাদের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং ফারুক খান বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী।
বিমানে নতুন করে লোক নিয়োগের বিষয়ে বরাবরই আপত্তি ছিল জি এম কাদেরের। বিমানের অর্গানোগ্রাম হওয়ার আগে কোনো পদে লোক নিয়োগ করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া যেসব পদ থেকে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানো হয়েছে, সেসব পদে নতুন করে লোক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়েরও। এর পরও সেসব পদে এখন লোক নিয়োগ হচ্ছে।
জি এম কাদেরের বক্তব্য ছিল, যেখানে অর্গানোগ্রামই নেই, সেখানে লোক নিয়োগ হতে পারে না। বিমানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে লোক লাগবে, সেটা সাবেক মন্ত্রীও মানতেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, 'যেখানে উদ্বৃত্ত লোক রয়েছে, তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে পাঠান।' সাবেক এই মন্ত্রী ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ট্রাফিক হেলপার পদে লোক নিয়োগে আপত্তি জানিয়েছিলেন। একসময় তিনি বিমানে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ট্রাফিক হেলপার পদে লোক নিয়োগ চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে। শিগগিরই তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। আর কম্পানি হওয়ার পর বিমানের নতুন অর্গানোগ্রাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জানা গেছে, বিমানের চলমান অর্গানোগ্রামে ট্রাফিক হেলপার নামে কোনো পদ নেই।
বিমানের জনবলের প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ এবং সার্ভিস রুলস প্রণয়নের জন্য ভারতের একটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেলেও তারা এখনো অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত করতে পারেনি। এ অবস্থায়ও নতুন লোকবল নিয়োগের বিষয়টি থেমে নেই। বর্তমানে বিমানে অনুমোদিত জনবল রয়েছে তিন হাজার ৪০০ জন। ২০০৭ সালে বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে রূপান্তরের সময় এ জনবল নির্ধারণ করা হয়। তৎকালীন বিমানসচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি বিমানের জনবল কাঠামো ছয় হাজার ৮৩৭ থেকে তিন হাজার ৪০০ জনে নামিয়ে আনার সুপারিশ করে। এ কমিটির সুপারিশই কার্যকর করা হয় বিমানকে পাবলিক কম্পানি করার সময়। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারেনি বিমান। বিমানের বর্তমান জনবল চার হাজার ৬০৪ জন। এর মধ্যে স্থায়ী দুই হাজার ৭৬৫ জন, অস্থায়ী এক হাজার ৪১০ জন এবং চুক্তিভিত্তিক রয়েছেন ৪২৯ জন।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য কানাডিয়ান কম্পানি ভিজুয়াল ডিফেন্স ইনকরপোরেশন (ভিডিআই) প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল জি এম কাদেরের সময়। তারা ২৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ২৫ বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার নামে যাত্রীপ্রতি ৩৫ মার্কিন ডলার (প্রায় আড়াই হাজার টাকা) নিরাপত্তা ফি আদায় করার কথা ছিল ভিডিআইয়ের। কানাডিয়ান ওই কম্পানির প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায়ও অনুমোদন করা হয়েছিল। প্রাথমিক অবস্থায় তাতে সায় ছিল জি এম কাদেরেরও। কিন্তু যখন বুঝতে পারেন ভিডিআই নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাবে, তখন তিনি বাধা দেন। মন্ত্রিসভা অনুমোদনের পর ভিডিআইয়ের ফাইল প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অনুমোদন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অনড় ছিলেন জি এম কাদের। শেষ পর্যন্ত জি এম কাদের ভিডিআই ঠেকাতে পারলেও এবার দৃশ্যপটে এসেছে আরেক কানাডিয়ান কম্পানি এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট কানাডা (ইডিসি)। ইডিসির বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের মতামত নেওয়ার জন্য বিমান ও পর্যটনসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন বর্তমান মন্ত্রী ফারুক খান। বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে মেরামত ও আনুষঙ্গিক কাজের দরপত্র নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় তাতেও সম্মতি দেননি সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী। ১৪০ কোটি টাকার কাজের দর নিয়ে অতিমূল্যায়নের (বেশি দাম) অভিযোগ ছিল। জি এম কাদের থাকা অবস্থায় এ দরপত্রের ব্যাপারে কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। কাজ পায় অভিযুক্ত কম্পানিই।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন বর্তমান বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান। এর ফলে মন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ ও তাদের পুরনো ব্যবসায়িক অংশীদার ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন ইপকো বিমানবন্দর এলাকায় একটি পাঁচ তারা হোটেল ও শপিং আর্কেডসহ একটি তিন তারা হোটেল নির্মাণের অনুমতি পাচ্ছে। অথচ জি এম কাদের চেয়েছিলেন ইপকোর বিষয়ে যেন আদালতেই নিষ্পত্তি হয়। বর্তমান মন্ত্রী আদালতের বাইরে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছেন।
জানা গেছে, ন্যাম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশপথের ১৪৪ একর বা ৪৩৪ বিঘা জমির ওপর একটি পাঁচ তারা হোটেল, একটি তিন তারা হোটেল, একটি কান্ট্রি ক্লাব এবং এশিয়ার সবচেয়ে বড় গলফ কোর্স নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। একই বছর দরপত্র আহ্বান করা হয়। চুক্তির আওতায় পাঁচ তারা হোটেল নির্মাণের জন্য ইপকো হোটেলস লিমিটেড, তিন তারা হোটেল ও শপিং আর্কেডের জন্য ইপকো ডেভেলপমেন্ট (বিডি) লিমিটেড এবং গলফ কোর্স ও কান্ট্রি ক্লাব নির্মাণের জন্য ইপকো রিসোর্টস লিমিটেড নামের স্বতন্ত্র তিনটি কম্পানি গঠন করা হয়। এ জন্য বেবিচকের সঙ্গে তিনটি বিল্ড অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) চুক্তি ও তিনটি ল্যান্ড লিজ অ্যাগ্রিমেন্ট (এলএলএ) হয়। তবে ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর এলএলএ বাতিল করা হলেও পরে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর চুক্তি বাতিলের আদেশটি প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ইপকো জামানত ও লিজের টাকা জমা দিয়ে হোটেলের নির্মাণকাজ শুরু করে। এ সময় রাজউকের সঙ্গে নকশা নিয়ে জটিলতা দেখা দিলেও পরে তা মিটে যায়। তবে বেবিচকের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। বেবিচক ৬০ বছরের জন্য এ জমি হাতছাড়া করছে। কোনো প্রকার জরিপ, সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা না করে হোটেল ও গলফ ক্লাব নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। হোটেল নির্মাণের কার্যাদেশ পাওয়ার পর বিমানবন্দরে প্রবেশপথের বনজ ও ফলদ গাছগাছালিতে পূর্ণ এলাকাটি টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সব নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও ইপকো তিনটি ভবনের দুই থেকে তিন তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে তা বন্ধ করে দেয়। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশপথে এভাবে কাজ বন্ধ থাকায় পর্যটকদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত।
এমন পরিস্থিতিতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আতাহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে ইপকোর সঙ্গে বেবিচকের বিদ্যমান সমস্যা ও মামলা সম্পর্কে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বেবিচকের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য কর্মকর্তা এবং ইপকোর পক্ষে এর এমডি ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা ও অন্যরা অংশ নেন। ইপকোর প্রতিনিধিরা দাবি করেন, তাঁরা সমস্যাটি সমঝোতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য সব সময়ই আন্তরিক ছিলেন এবং এখনো আছেন। দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা চলতে থাকায় আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি সভাকে অবহিত করে ইপকোর পক্ষ থেকে বলা হয়, জমির দখল হস্তান্তর এবং পাঁচ তারা ও তিন তারা হোটেলের নির্মাণকাজ অনেক দূর অগ্রসর হলেও চলমান বিরোধের আজও সুরাহা হয়নি। ইপকো সরকারকে সহযোগিতা এবং লিজের টাকা পরিশোধ করতে প্রস্তুত জানিয়ে তিনটি ল্যান্ড লিজ অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী সম্পত্তির পরিপূর্ণ দখল বুঝিয়ে দিতে সভায় সভাপতিকে অনুরোধ করে। বেবিচকের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ইপকোর দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের দখল দেওয়া হয়নি এবং সেখানে কোনো নির্মাণকাজও শুরু হয়নি। বৈঠকে বেবিচকের চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমান বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের জন্য কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের নির্ধারিত জায়গা বেবিচকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন। আলোচনার একপর্যায়ে ইপকো কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের দাবি পরিত্যাগ করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। হোটেলের কাজ শুরুর অনুমতিসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানায়। সভায় সুপারিশ করা হয়, বেবিচকের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করে নেবে ইপকো। ইপকো কেবল হোটেল নির্মাণে সম্মতি জানানোর পর বেবিচক কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্সের চুক্তি বাতিল করবে। এ ছাড়া হোটেলের জায়গা পরিমাপ করে ইপকোকে বুঝিয়ে দেওয়াসহ বিধি মোতাবেক অবশিষ্ট নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেবে বেবিচক। অন্যদিকে ইপকো পরিশোধ করবে যাবতীয় পাওনা।
বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে ইপকোর সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছে। ১৪৪ একর জমির মধ্যে ১৪ দশমিক ৩২ একর ইপকোকে দেওয়া হবে। ইপকো এ জমিতে একটি পাঁচ তারা ও একটি তিন তারা হোটেল নির্মাণ করবে। কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ ক্লাব নির্মাণ করা হবে না। বাকি ১৩০ দশমিক ৪১ একর জমি সিভিল এভিয়েশনের দখলেই থাকবে। এ জমিতে বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজ করা হবে।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। এ ব্যাপারে একটি সমাধানে আসা দরকার। কিন্তু সমাধানটি যদি ইপকোর পক্ষে হয়, তাহলেই সমস্যা। কারণ যে জমিতে হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সরকারি উদ্যোগেই হোটেল হতে পারে। সোনারগাঁও ও রূপসী বাংলার মতো এসব হোটেল সরকার পরিচালনা করবে।
এসব বিষয়ে সাবেক বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি। বর্তমান মন্ত্রী ফারুক খান বলেন, 'বিধিবিধান ও নিয়মকানুন মেনেই ইপকো সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের স্বার্থ উপেক্ষা করে কিছু করা হচ্ছে না।'
মহাজোট সরকারের প্রথম দিন থেকেই মন্ত্রিসভায় রয়েছেন জি এম কাদের ও ফারুক খান। শুরুতে জি এম কাদের ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী। ফারুক খান ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। গত বছর নভেম্বর মাসে এ দুজনের মন্ত্রণালয় বদল হয়। বর্তমানে জি এম কাদের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং ফারুক খান বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী।
No comments