আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী-ভবিষ্যৎমুখী দলের বিনাশ নেই by হারুন-অর-রশিদ
আওয়ামী লীগ কেন ৬২ বছর পরও একটি শক্তিশালী গণভিত্তিক দল? এর মূল কারণ, এ দলে রয়েছে গতিশীলতা। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে চলতে পারে এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা সর্বদা হঠকারিতা পরিহার করে চলেছে।
কর্মসূচি ও কর্মপন্থা প্রণয়নকালে সর্বদা জনগণ কতটা গ্রহণ করতে পারবে, সেটা বিবেচনায় রেখেছে
বাষট্টি বছর আগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজগার্ডেনে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ এ ভূখণ্ডের প্রধান রাজনৈতিক দল। এ ভূখণ্ডে এ সময়ে অনেক দল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তৃণমূলে ভিত্তি ধরে রেখেছে এবং জাতীয়ভাবে শক্তিশালী রয়েছে। চলি্লশের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অনুসারী মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এ দলটির সূচনা করেন। শুরু থেকেই দলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়। বলা যায়, নেতাকর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এসেছে তাদের মধ্য থেকে। তারা বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অধিকার বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং তা সমুন্নত রাখায় ছিলেন আন্তরিক। চলি্লশের দশকের শেষ দিকে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সঙ্গে শরৎ বসুসহ আরও কয়েক নেতা অখণ্ড স্বাধীন বাংলা কায়েমে তৎপর ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রেক্ষাপটে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। কিন্তু একাত্তরে বাংলার পূর্ব অংশে বাঙালি চেতনার ভিত্তিতেই একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তার নেতৃত্ব প্রদান করে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের বিপরীতে মুসলিম লীগে ছিলেন ঢাকার নওয়াব-পরিবারকেন্দ্রিক ভূস্বামীরা। তারা ছিলেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি অনুগত। দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শ তারা মনেপ্রাণে সমর্থন করতেন। জন্মলগ্ন থেকেই আওয়াম লীগ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে জোরদার করায় সচেষ্ট থাকে। এ দলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে_ প্রথমত তারা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম কার্যকর বিরোধী দল। দ্বিতীয়ত, এ দলটি বাঙালির স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। সমগ্র পাকিস্তানে কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ঘোষণা প্রদান করা হলেও দলটি বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকেই ধারণ করে চলেছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানে নিজের ভিত মজবুত করায় কখনও তেমন উদ্যোগী হয়নি। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছিল মূলত নামসর্বস্ব একটি কমিটি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শের ভিত্তিতে এবং শুরুর দিকে এর প্রতি জনগণের ব্যাপক অংশের মোহও ছিল। এমন একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রথম বিরোধী দল হিসেবে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ তার নামের সঙ্গে 'মুসলিম' শব্দটি রেখে দেয়। বলা প্রয়োজন যে, সে সময় সরকারের বিরোধিতাকে ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিরোধিতা হিসেবে গণ্য করা হতো। বিরোধীদের ভারতের চর হিসেবে চিহ্নিত করা হতে থাকে। তবে আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই দলকে অসাম্প্রদায়িক আদর্শে পরিচালিত করতে থাকে। ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য এর দুয়ার রাখা হয় উন্মুক্ত। আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলনে নিজেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে এবং জনসাধারণের মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের আবেগ কেটে যেতে থাকে। পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জনগণ মুসলিম লীগকে কার্যত নির্মূল করে দেয়। এর পর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ যায়। দলটি নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক আদর্শের অনুসারী হিসেবে ঘোষণা করে।
পাকিস্তান আমলে এ ভূখণ্ডে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছিল। মওলানা ভাসানী নিজেও ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এ ছাড়াও ছিল কমিউনিস্ট পার্টি এবং আতাউর রহমান খানের দল। কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দলও সক্রিয় ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে বাঙালিদের মূল যে দ্বন্দ্ব তার স্বরূপ বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতার ত্যাগ ও সাহসিকতা ছিল অপরিসীম। কিন্তু কেবল আওয়ামী লীগই বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বশীল দল হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। তারা সঠিকভাবেই চিহ্নিত করে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চরিত্র ঔপনিবেশিক ধরনের। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জনগণের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন কাজের ফলে দলটি নিজেকে একটি জাতীয় প্লাটফরমে পরিণত করতে সক্ষম হয়। এটা মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না যে, তরুণ নেতা শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকেই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ দলটি জনগণকে জাতীয় মুক্তির জন্য প্রস্তুত করেছে।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতেও শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে অনন্যসাধারণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করার জন্য ব্যাপক সফর করেন। এ কারণেই দলটি বারবার শাসকদের তরফে গুরুতর আঘাত নেমে আসার পরও তা মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমান পঞ্চাশের দশকে দলের সাংগঠনিক কাজ পরিচালনার জন্য মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। সে সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি স্পষ্ট বুঝেছিলেন, জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাই শক্তিশালী দল এবং তা গড়ে তুলতে হলে বিশেষ মনোযোগ প্রদান অপরিহার্য।
আমাদের এ ভূখণ্ডে আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৫৬ সালে। তখন ২১ ফেব্রুয়ারি ও পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এফডিসি, সাভার ফার্ম, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে দলটির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচিতে স্বাধীনতার কথা ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এবং পকিস্তানের শাসকরা বুঝে যায়, শেখ মুজিব কোথায় চলেছেন। এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ বাম-ডান সংকীর্ণতা পরিহারে সচেষ্ট ছিল। তারা সর্বদা জনগণকে নিয়ে চলতে চেয়েছে। জনগণ কতটা গ্রহণ করতে পারবে, সেটা থাকে বিশেষ বিবেচনায়। মূল লক্ষ্যে অবিচল থেকেই তারা জনগণকে সংগঠিত ও উজ্জীবিত করেছে। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু জাতীয় বাস্তবতা নয়, স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কেও পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। ১ মার্চ থেকেই দেশের প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য তিনি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তার বিচক্ষণ কৌশলের কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্ববাসীর ব্যাপক সমর্থন মেলে। বিশ্ববাসী তাকে একজন সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
স্বাধীন দেশটির পুনর্গঠনের কাজ আওয়ামী লীগ দক্ষতার সঙ্গেই পালন করে। গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত এবং এর ভিত্তিতে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশে ফের সামরিক শাসন নেমে আসে। ১৫ আগস্ট নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। একে একে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হতে থাকে। এ অবস্থার মধ্যেই দলের হাল ধরেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত চলে। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবাদী আন্দোলন সফলভাবে পরিচালনা করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি জনগণকে অনুপ্রাণিত করার মতো কর্মসূচি প্রদান করেন। তার ভিশন-২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচিতে প্রতিফলন ঘটে জনপ্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার। এখন তিনি দেশ পরিচালনা করছেন অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে।
আওয়ামী লীগ কেন ৬২ বছর পরও একটি শক্তিশালী গণভিত্তিক দল? এর মূল কারণ, এ দলে রয়েছে গতিশীলতা। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে চলতে পারে এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা সর্বদা হঠকারিতা পরিহার করে চলেছে। কর্মসূচি ও কর্মপন্থা প্রণয়নকালে সর্বদা জনগণ কতটা গ্রহণ করতে পারবে, সেটা বিবেচনায় রেখেছে। বর্তমান রাষ্ট্রধর্ম ইস্যুর ক্ষেত্রে নেতৃত্বের মধ্যে এ মনোভাব কাজ করছে। তবে একইসঙ্গে তারা মূল আদর্শ গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ থেকে নিজেদের বিচ্যুত করেনি। সামরিক শাসনামলে ধ্বংস করে ফেলা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনঃস্থাপনে তারা সক্রিয় রয়েছে।
শুরুতেই বলেছি, আওয়ামী লীগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের নিয়ে গঠিত একটি দল। তবে একইসঙ্গে তারা শ্রমজীবী-মেহনতী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণেও সচেষ্ট রয়েছে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা তারা সবসময় বলে আসছে এবং এটা কেবল কথার কথা নয়। নারীর ক্ষমতায়নও তাদের বিঘোষিত আদর্শ। আমাদের দেশের বামপন্থিরা শোষণমুক্তির কথা বলে। কিন্তু আমরা দেখি, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর অনেক দল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সরে এসেছে। দলের নাম পর্যন্ত বদলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা তার অবস্থান বদলাননি। তিনি জীবনের হুমকি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন। দলের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তিনি ভবিষ্যৎমুখী কর্মপন্থা ভিশন-২০২১ প্রণয়ন করেছেন। এসব অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের কারণেই বলা যায়, আওয়ামী লীগ নিঃশেষিত হবে না, বরং টিকে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
ড. হারুন-অর-রশিদ :রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং
উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাষট্টি বছর আগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজগার্ডেনে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ এ ভূখণ্ডের প্রধান রাজনৈতিক দল। এ ভূখণ্ডে এ সময়ে অনেক দল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তৃণমূলে ভিত্তি ধরে রেখেছে এবং জাতীয়ভাবে শক্তিশালী রয়েছে। চলি্লশের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অনুসারী মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এ দলটির সূচনা করেন। শুরু থেকেই দলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়। বলা যায়, নেতাকর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এসেছে তাদের মধ্য থেকে। তারা বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অধিকার বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং তা সমুন্নত রাখায় ছিলেন আন্তরিক। চলি্লশের দশকের শেষ দিকে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সঙ্গে শরৎ বসুসহ আরও কয়েক নেতা অখণ্ড স্বাধীন বাংলা কায়েমে তৎপর ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রেক্ষাপটে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। কিন্তু একাত্তরে বাংলার পূর্ব অংশে বাঙালি চেতনার ভিত্তিতেই একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তার নেতৃত্ব প্রদান করে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের বিপরীতে মুসলিম লীগে ছিলেন ঢাকার নওয়াব-পরিবারকেন্দ্রিক ভূস্বামীরা। তারা ছিলেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি অনুগত। দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শ তারা মনেপ্রাণে সমর্থন করতেন। জন্মলগ্ন থেকেই আওয়াম লীগ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে জোরদার করায় সচেষ্ট থাকে। এ দলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে_ প্রথমত তারা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম কার্যকর বিরোধী দল। দ্বিতীয়ত, এ দলটি বাঙালির স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। সমগ্র পাকিস্তানে কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ঘোষণা প্রদান করা হলেও দলটি বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকেই ধারণ করে চলেছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানে নিজের ভিত মজবুত করায় কখনও তেমন উদ্যোগী হয়নি। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছিল মূলত নামসর্বস্ব একটি কমিটি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শের ভিত্তিতে এবং শুরুর দিকে এর প্রতি জনগণের ব্যাপক অংশের মোহও ছিল। এমন একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রথম বিরোধী দল হিসেবে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ তার নামের সঙ্গে 'মুসলিম' শব্দটি রেখে দেয়। বলা প্রয়োজন যে, সে সময় সরকারের বিরোধিতাকে ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিরোধিতা হিসেবে গণ্য করা হতো। বিরোধীদের ভারতের চর হিসেবে চিহ্নিত করা হতে থাকে। তবে আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই দলকে অসাম্প্রদায়িক আদর্শে পরিচালিত করতে থাকে। ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য এর দুয়ার রাখা হয় উন্মুক্ত। আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলনে নিজেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে এবং জনসাধারণের মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের আবেগ কেটে যেতে থাকে। পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জনগণ মুসলিম লীগকে কার্যত নির্মূল করে দেয়। এর পর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ যায়। দলটি নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক আদর্শের অনুসারী হিসেবে ঘোষণা করে।
পাকিস্তান আমলে এ ভূখণ্ডে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছিল। মওলানা ভাসানী নিজেও ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এ ছাড়াও ছিল কমিউনিস্ট পার্টি এবং আতাউর রহমান খানের দল। কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দলও সক্রিয় ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে বাঙালিদের মূল যে দ্বন্দ্ব তার স্বরূপ বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতার ত্যাগ ও সাহসিকতা ছিল অপরিসীম। কিন্তু কেবল আওয়ামী লীগই বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বশীল দল হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। তারা সঠিকভাবেই চিহ্নিত করে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চরিত্র ঔপনিবেশিক ধরনের। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জনগণের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন কাজের ফলে দলটি নিজেকে একটি জাতীয় প্লাটফরমে পরিণত করতে সক্ষম হয়। এটা মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না যে, তরুণ নেতা শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকেই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ দলটি জনগণকে জাতীয় মুক্তির জন্য প্রস্তুত করেছে।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতেও শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে অনন্যসাধারণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করার জন্য ব্যাপক সফর করেন। এ কারণেই দলটি বারবার শাসকদের তরফে গুরুতর আঘাত নেমে আসার পরও তা মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমান পঞ্চাশের দশকে দলের সাংগঠনিক কাজ পরিচালনার জন্য মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। সে সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি স্পষ্ট বুঝেছিলেন, জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাই শক্তিশালী দল এবং তা গড়ে তুলতে হলে বিশেষ মনোযোগ প্রদান অপরিহার্য।
আমাদের এ ভূখণ্ডে আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৫৬ সালে। তখন ২১ ফেব্রুয়ারি ও পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এফডিসি, সাভার ফার্ম, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে দলটির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচিতে স্বাধীনতার কথা ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এবং পকিস্তানের শাসকরা বুঝে যায়, শেখ মুজিব কোথায় চলেছেন। এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ বাম-ডান সংকীর্ণতা পরিহারে সচেষ্ট ছিল। তারা সর্বদা জনগণকে নিয়ে চলতে চেয়েছে। জনগণ কতটা গ্রহণ করতে পারবে, সেটা থাকে বিশেষ বিবেচনায়। মূল লক্ষ্যে অবিচল থেকেই তারা জনগণকে সংগঠিত ও উজ্জীবিত করেছে। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু জাতীয় বাস্তবতা নয়, স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কেও পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। ১ মার্চ থেকেই দেশের প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য তিনি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তার বিচক্ষণ কৌশলের কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্ববাসীর ব্যাপক সমর্থন মেলে। বিশ্ববাসী তাকে একজন সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
স্বাধীন দেশটির পুনর্গঠনের কাজ আওয়ামী লীগ দক্ষতার সঙ্গেই পালন করে। গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত এবং এর ভিত্তিতে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশে ফের সামরিক শাসন নেমে আসে। ১৫ আগস্ট নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। একে একে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হতে থাকে। এ অবস্থার মধ্যেই দলের হাল ধরেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত চলে। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবাদী আন্দোলন সফলভাবে পরিচালনা করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি জনগণকে অনুপ্রাণিত করার মতো কর্মসূচি প্রদান করেন। তার ভিশন-২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচিতে প্রতিফলন ঘটে জনপ্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার। এখন তিনি দেশ পরিচালনা করছেন অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে।
আওয়ামী লীগ কেন ৬২ বছর পরও একটি শক্তিশালী গণভিত্তিক দল? এর মূল কারণ, এ দলে রয়েছে গতিশীলতা। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে চলতে পারে এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা সর্বদা হঠকারিতা পরিহার করে চলেছে। কর্মসূচি ও কর্মপন্থা প্রণয়নকালে সর্বদা জনগণ কতটা গ্রহণ করতে পারবে, সেটা বিবেচনায় রেখেছে। বর্তমান রাষ্ট্রধর্ম ইস্যুর ক্ষেত্রে নেতৃত্বের মধ্যে এ মনোভাব কাজ করছে। তবে একইসঙ্গে তারা মূল আদর্শ গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ থেকে নিজেদের বিচ্যুত করেনি। সামরিক শাসনামলে ধ্বংস করে ফেলা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনঃস্থাপনে তারা সক্রিয় রয়েছে।
শুরুতেই বলেছি, আওয়ামী লীগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের নিয়ে গঠিত একটি দল। তবে একইসঙ্গে তারা শ্রমজীবী-মেহনতী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণেও সচেষ্ট রয়েছে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা তারা সবসময় বলে আসছে এবং এটা কেবল কথার কথা নয়। নারীর ক্ষমতায়নও তাদের বিঘোষিত আদর্শ। আমাদের দেশের বামপন্থিরা শোষণমুক্তির কথা বলে। কিন্তু আমরা দেখি, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর অনেক দল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সরে এসেছে। দলের নাম পর্যন্ত বদলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা তার অবস্থান বদলাননি। তিনি জীবনের হুমকি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন। দলের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তিনি ভবিষ্যৎমুখী কর্মপন্থা ভিশন-২০২১ প্রণয়ন করেছেন। এসব অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের কারণেই বলা যায়, আওয়ামী লীগ নিঃশেষিত হবে না, বরং টিকে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
ড. হারুন-অর-রশিদ :রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং
উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments