শিক্ষকতা-শিক্ষকদের একাল ও সেকাল by গোলাম মুরশিদ
‘বিশ্ববিদ্যা লয়’ নামে সম্প্রতি একটি ছোট্ট লেখা লিখেছিলাম। তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে বড়। অনেকগুলো ই-মেইল পেয়েছি। দুটি আবার দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের। তাঁরা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন খুব কম। তারই জন্য শিক্ষার মান নেমে গেছে। তা ছাড়া তারই জন্য তাঁরা বাড়তি আয়ের ধান্ধায় থাকেন।
এ ছাড়া একজন মাননীয় অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার চর্চাও যে হয়, একটি প্রকাশিত নিবন্ধে তা বলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা হবে—এটাই তো প্রত্যাশিত। বিদ্যা চর্চা হয় না, তা কোথাও বলিনি। তবে ছাত্রদের রাজনীতি-রাজনীতি না-বলে দলের দালালি বলাই ভালো, এবং শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলের দালালি ও দলাদলির ফলে শিক্ষার মান দারুণ নিচে নেমে গেছে এবং বিদ্যার চর্চা প্রায় লোপ পেয়েছে—সেটাই আমার বক্তব্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝেঁটিয়ে রাজনীতি দূর করতে না পারলে শিক্ষার মান যে আবার উন্নত হবে না, এটা আমি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলো। বিনিময়ে ছাত্র নামধারী কিছু মাস্তান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নগদ অথবা সুবিধা পায়। টেন্ডারবাজি করে। নিজেদের মধ্যেও ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে হানাহানি করে।
শিক্ষকেরা সমাজের বহির্ভূত মানুষ নন। তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ থাকতেই পারে। কিন্তু তাঁরা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী হলে জ্ঞানচর্চার প্রতি সুবিচার করতে অথবা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। তাই শিক্ষকদের রাজনীতি এবং নির্বাচনও বন্ধ করতেই হবে। এ জন্য প্রথমেই দরকার অরাজনৈতিক ব্যক্তির উপাচার্য হওয়া। সরকারের পরিবর্তনেও উপাচার্যের পরিবর্তন হবে না—তাঁর নিয়োগের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সেই বিশ্ববিদ্যারয়ের উপাচার্য হতেই পারবেন না। নয়তো তিনিও আগের সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়বেন। কাউকে সুবিধা দেবেন, কাউকে প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করবেন। নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবেন না।
আমার লেখাটার গোড়াতেই বলেছিলাম, ‘অনেক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আছে।’ আহমদ শরীফ তো বেশি দিন আগে মারা যাননি! কেবল প্রফেসর হওয়ার জন্য গবেষণা করেননি তিনি। প্রফেসর হয়েও গবেষণা করেছেন। এমনকি, অবসর নেওয়ার পরও। হুমায়ুন আজাদও এমনই আরেকটি নাম। প্রফেসর হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক লিখেছেন। সিরাজুল ইসলাম সত্তরের ঘরে পা দিয়েও এখনো এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে কাজ করেই যাচ্ছেন। অন্যকে দিয়েও কাজ করাচ্ছেন। তাঁর সামনে প্রমোশনের কোনো বন্দর নেই। জ্ঞানের আনন্দেই জ্ঞান চর্চা করছেন। সালাহউদ্দীন আহমদ অবসর নিয়েছেন অনেক কাল আগে। আজও লিখেই যাচ্ছেন, সিরিয়াস গবেষণা না করলেও। শিশির কুমার ভট্টাচার্য অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তারপর থেকে লিখছেন। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিল বেশির ভাগ শিক্ষক কী করছেন—সে সম্পর্কে।
সেই বেশির ভাগ শিক্ষক, বিশেষ করে ঢাকা অথবা তার কাছাকাছি যাঁরা আছেন, তাঁরা গবেষণা, অধ্যাপনা এবং লেখার কাজ করেন সামান্যই। উপার্জনেই তাঁদের আগ্রহ। সত্যি সত্যি যে বেতন তাঁদের দেওয়া হয়, তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে সংসার চালানোও সহজ নয়। তাঁদের থেকে খারাপ ছাত্ররা তাঁদের চেয়ে ভালো অবস্থাতে আছেন—এটা দেখেও তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। তাই বাড়তি আয়ের জন্য তাঁরা উৎসুক হয়ে থাকেন। অন্য সবার যখন গাড়ি আছে, তখন তাঁদেরও গাড়ি আবশ্যিক। প্রতিবেশীরা জীবনযাত্রায় যে চমক দেখাচ্ছেন, তা না দেখিয়ে তাঁরা থাকেন কীভাবে? তাহলে সন্তান এবং স্ত্রীর কাছে মান থাকে না।
এসব সত্ত্ব্বেও শিক্ষকেরা যদি চোখ বুজে না থাকেন, তাহলে তাঁদের স্বীকার করতেই হবে যে, তিয়াত্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের আইন থেকে তাঁরা দল পাকিয়ে অনেকে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন। কেউ কেউ আখেরও গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পায়নি। মানুষ যদি কেবল পঞ্জিকার হিসেবে জ্যেষ্ঠত্ব লাভ করে এবং খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে প্রফেসর হতে পারে, তাহলে গবেষণা করার কোনো দরকার পড়ে না। তাও জুনিয়র শিক্ষকেরা কিছু কিছু কাজ করে মাঝেমধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন প্রফেসর কী গবেষণা করেন? আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁরা একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন? সাধারণত করেন না। কারণ, প্রফেসর পদের মোক্ষ তাঁরা অর্জন করেছেন। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা এবং কনসালটেন্সি করে অতিরিক্ত আয়ও করেন। গাড়ি তো আগেই কিনেছেন। এমনকি কারও কারও বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। সুতরাং আর লিখে কী হবে? ফালতু গবেষণা দিয়ে গৌরব আসবে? অথবা গৌরবে পেট ভরবে?
দেশের আর পাঁচজন মানুষ যখন তুলনামূলক কম শিক্ষা নিয়েও বেশ করে খাচ্ছেন, তখন বর্তমান যুগের প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বাড়ি-গাড়ি-সঞ্চয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু উপার্জনই যদি প্রধান লক্ষ্য হয়, তাহলে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে গ্রহণ না করে অন্য কোনো অর্থকরী পেশাই তাঁদের বেছে নেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষকতার সঙ্গে একটা আদর্শ এবং মহান ব্রতও থাকে। সেটা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। ডাক্তারদের সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। তাঁরা কোনো না কোনো মেডিকেল কলেজে চাকরি করেন—সে কেবল প্যাডে লিখে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য। নয়তো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আনেন রোগী দেখে অথবা না দেখে। নানা রকমের অদরকারি পরীক্ষা করিয়ে তার ভাগ নিয়ে।
ডিরোজিও, ডিএলআর, রামতনু, বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, হেরম্ব মৈত্র—চিরকালই বিরল। ১৮৫০-এর দশকে বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের অন্যতম। তা সত্ত্বেও কেবল শিক্ষানীতিতে সরকারের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না বলে, আদর্শের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাধারণ লোকেরা তখন নাকি তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়লে খাবেন কী করে?’ তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তিনি আলু পটোল বিক্রি করবেন, তাও ভালো। কিন্তু আপস নয়।
হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পিএইচডি, ইংরেজিতে। ইংরেজি বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। দেশবিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালও হয়েছিলেন। খুব সাধারণ মানুষের মতো সাদামাটা জীবনযাত্রা ছিল তাঁর। রাজ্যপাল থাকার সময়েও নিজের ভৃত্য তাঁর রান্না করে দিত। মারা যাওয়ার সময়ে সারা জীবনের সঞ্চয় ১৭ লাখ টাকা, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গিয়েছিলেন।
বদরুদ্দীন উমর ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন। সেকালের বিবেচনায় ভালো আয় ছিল, প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি করে সমাজের সেবা করবেন বলে পদত্যাগ করেন। স্ত্রীর ব্যাংকের চাকরি ছাড়া তাঁর সামনে তখন কোন অবলম্বন ছিল না ।
শিবনারায়ণ রায় মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতবিদ্যা বিভাগের প্রধানের চাকরি থেকে পাঁচ বছর আগেই অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন—শুধু লেখালেখি করবেন আর জিজ্ঞাসা পত্রিকা চালাবেন বলে। শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন খুব অভাবের মধ্যে।
শিক্ষকতা এমনই একটি পেশা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে খানিকটা আত্মত্যাগ, জ্ঞানের সাধনা এবং ছাত্রদের শেখানোর আগ্রহ। প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং। পারিবারিক কারণে এবং ক্রমবর্ধমান সংসারের খরচ জোগাতে অসমর্থ হওয়ায় ’৮৩ সালের ডিসেম্বরে আমি শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে লন্ডনে একটা চাকরি নিয়েছিলাম। ততদিনে আমার শিক্ষকতা হয়েছিল ২০ বছর। কিন্তু ব্যাংকে ১০ হাজার টাকাও ছিল না। ১৮ বছর চাকরি করে লন্ডনে নির্ধারিত সময়ের চার বছর আগেই আমি যখন অবসর নিয়েছিলাম, তখন ব্যাংকে আমার পাঁচ হাজার পাউন্ডও জমা হয়নি। তবু অবসর নিয়েছিলাম, শুধু লিখব বলে। আর সবিনয়ে বলতে পারি, তখন থেকে প্রায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো গ্রন্থ প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি। এসব গ্রন্থ কারও কোনো কাজে লাগবে কি না, তা ভেবে দেখিনি। অথবা এসব গ্রন্থ থেকে যে রয়্যালটি পাওয়া যায়, পাউন্ডের হিসেবে তা সামান্যই। কিন্তু লেখাই আমার নেশা। সত্তরের কোঠায় পড়েও এই নেশা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার পর ডজনখানেক বই বোধ হয় লিখেছি।
গোলাম মুরশিদ: গবেষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা হবে—এটাই তো প্রত্যাশিত। বিদ্যা চর্চা হয় না, তা কোথাও বলিনি। তবে ছাত্রদের রাজনীতি-রাজনীতি না-বলে দলের দালালি বলাই ভালো, এবং শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলের দালালি ও দলাদলির ফলে শিক্ষার মান দারুণ নিচে নেমে গেছে এবং বিদ্যার চর্চা প্রায় লোপ পেয়েছে—সেটাই আমার বক্তব্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝেঁটিয়ে রাজনীতি দূর করতে না পারলে শিক্ষার মান যে আবার উন্নত হবে না, এটা আমি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলো। বিনিময়ে ছাত্র নামধারী কিছু মাস্তান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নগদ অথবা সুবিধা পায়। টেন্ডারবাজি করে। নিজেদের মধ্যেও ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে হানাহানি করে।
শিক্ষকেরা সমাজের বহির্ভূত মানুষ নন। তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ থাকতেই পারে। কিন্তু তাঁরা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী হলে জ্ঞানচর্চার প্রতি সুবিচার করতে অথবা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। তাই শিক্ষকদের রাজনীতি এবং নির্বাচনও বন্ধ করতেই হবে। এ জন্য প্রথমেই দরকার অরাজনৈতিক ব্যক্তির উপাচার্য হওয়া। সরকারের পরিবর্তনেও উপাচার্যের পরিবর্তন হবে না—তাঁর নিয়োগের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সেই বিশ্ববিদ্যারয়ের উপাচার্য হতেই পারবেন না। নয়তো তিনিও আগের সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়বেন। কাউকে সুবিধা দেবেন, কাউকে প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করবেন। নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবেন না।
আমার লেখাটার গোড়াতেই বলেছিলাম, ‘অনেক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আছে।’ আহমদ শরীফ তো বেশি দিন আগে মারা যাননি! কেবল প্রফেসর হওয়ার জন্য গবেষণা করেননি তিনি। প্রফেসর হয়েও গবেষণা করেছেন। এমনকি, অবসর নেওয়ার পরও। হুমায়ুন আজাদও এমনই আরেকটি নাম। প্রফেসর হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক লিখেছেন। সিরাজুল ইসলাম সত্তরের ঘরে পা দিয়েও এখনো এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে কাজ করেই যাচ্ছেন। অন্যকে দিয়েও কাজ করাচ্ছেন। তাঁর সামনে প্রমোশনের কোনো বন্দর নেই। জ্ঞানের আনন্দেই জ্ঞান চর্চা করছেন। সালাহউদ্দীন আহমদ অবসর নিয়েছেন অনেক কাল আগে। আজও লিখেই যাচ্ছেন, সিরিয়াস গবেষণা না করলেও। শিশির কুমার ভট্টাচার্য অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তারপর থেকে লিখছেন। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিল বেশির ভাগ শিক্ষক কী করছেন—সে সম্পর্কে।
সেই বেশির ভাগ শিক্ষক, বিশেষ করে ঢাকা অথবা তার কাছাকাছি যাঁরা আছেন, তাঁরা গবেষণা, অধ্যাপনা এবং লেখার কাজ করেন সামান্যই। উপার্জনেই তাঁদের আগ্রহ। সত্যি সত্যি যে বেতন তাঁদের দেওয়া হয়, তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে সংসার চালানোও সহজ নয়। তাঁদের থেকে খারাপ ছাত্ররা তাঁদের চেয়ে ভালো অবস্থাতে আছেন—এটা দেখেও তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। তাই বাড়তি আয়ের জন্য তাঁরা উৎসুক হয়ে থাকেন। অন্য সবার যখন গাড়ি আছে, তখন তাঁদেরও গাড়ি আবশ্যিক। প্রতিবেশীরা জীবনযাত্রায় যে চমক দেখাচ্ছেন, তা না দেখিয়ে তাঁরা থাকেন কীভাবে? তাহলে সন্তান এবং স্ত্রীর কাছে মান থাকে না।
এসব সত্ত্ব্বেও শিক্ষকেরা যদি চোখ বুজে না থাকেন, তাহলে তাঁদের স্বীকার করতেই হবে যে, তিয়াত্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের আইন থেকে তাঁরা দল পাকিয়ে অনেকে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন। কেউ কেউ আখেরও গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পায়নি। মানুষ যদি কেবল পঞ্জিকার হিসেবে জ্যেষ্ঠত্ব লাভ করে এবং খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে প্রফেসর হতে পারে, তাহলে গবেষণা করার কোনো দরকার পড়ে না। তাও জুনিয়র শিক্ষকেরা কিছু কিছু কাজ করে মাঝেমধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন প্রফেসর কী গবেষণা করেন? আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁরা একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন? সাধারণত করেন না। কারণ, প্রফেসর পদের মোক্ষ তাঁরা অর্জন করেছেন। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা এবং কনসালটেন্সি করে অতিরিক্ত আয়ও করেন। গাড়ি তো আগেই কিনেছেন। এমনকি কারও কারও বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। সুতরাং আর লিখে কী হবে? ফালতু গবেষণা দিয়ে গৌরব আসবে? অথবা গৌরবে পেট ভরবে?
দেশের আর পাঁচজন মানুষ যখন তুলনামূলক কম শিক্ষা নিয়েও বেশ করে খাচ্ছেন, তখন বর্তমান যুগের প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বাড়ি-গাড়ি-সঞ্চয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু উপার্জনই যদি প্রধান লক্ষ্য হয়, তাহলে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে গ্রহণ না করে অন্য কোনো অর্থকরী পেশাই তাঁদের বেছে নেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষকতার সঙ্গে একটা আদর্শ এবং মহান ব্রতও থাকে। সেটা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। ডাক্তারদের সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। তাঁরা কোনো না কোনো মেডিকেল কলেজে চাকরি করেন—সে কেবল প্যাডে লিখে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য। নয়তো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আনেন রোগী দেখে অথবা না দেখে। নানা রকমের অদরকারি পরীক্ষা করিয়ে তার ভাগ নিয়ে।
ডিরোজিও, ডিএলআর, রামতনু, বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, হেরম্ব মৈত্র—চিরকালই বিরল। ১৮৫০-এর দশকে বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের অন্যতম। তা সত্ত্বেও কেবল শিক্ষানীতিতে সরকারের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না বলে, আদর্শের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাধারণ লোকেরা তখন নাকি তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়লে খাবেন কী করে?’ তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তিনি আলু পটোল বিক্রি করবেন, তাও ভালো। কিন্তু আপস নয়।
হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পিএইচডি, ইংরেজিতে। ইংরেজি বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। দেশবিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালও হয়েছিলেন। খুব সাধারণ মানুষের মতো সাদামাটা জীবনযাত্রা ছিল তাঁর। রাজ্যপাল থাকার সময়েও নিজের ভৃত্য তাঁর রান্না করে দিত। মারা যাওয়ার সময়ে সারা জীবনের সঞ্চয় ১৭ লাখ টাকা, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গিয়েছিলেন।
বদরুদ্দীন উমর ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন। সেকালের বিবেচনায় ভালো আয় ছিল, প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি করে সমাজের সেবা করবেন বলে পদত্যাগ করেন। স্ত্রীর ব্যাংকের চাকরি ছাড়া তাঁর সামনে তখন কোন অবলম্বন ছিল না ।
শিবনারায়ণ রায় মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতবিদ্যা বিভাগের প্রধানের চাকরি থেকে পাঁচ বছর আগেই অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন—শুধু লেখালেখি করবেন আর জিজ্ঞাসা পত্রিকা চালাবেন বলে। শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন খুব অভাবের মধ্যে।
শিক্ষকতা এমনই একটি পেশা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে খানিকটা আত্মত্যাগ, জ্ঞানের সাধনা এবং ছাত্রদের শেখানোর আগ্রহ। প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং। পারিবারিক কারণে এবং ক্রমবর্ধমান সংসারের খরচ জোগাতে অসমর্থ হওয়ায় ’৮৩ সালের ডিসেম্বরে আমি শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে লন্ডনে একটা চাকরি নিয়েছিলাম। ততদিনে আমার শিক্ষকতা হয়েছিল ২০ বছর। কিন্তু ব্যাংকে ১০ হাজার টাকাও ছিল না। ১৮ বছর চাকরি করে লন্ডনে নির্ধারিত সময়ের চার বছর আগেই আমি যখন অবসর নিয়েছিলাম, তখন ব্যাংকে আমার পাঁচ হাজার পাউন্ডও জমা হয়নি। তবু অবসর নিয়েছিলাম, শুধু লিখব বলে। আর সবিনয়ে বলতে পারি, তখন থেকে প্রায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো গ্রন্থ প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি। এসব গ্রন্থ কারও কোনো কাজে লাগবে কি না, তা ভেবে দেখিনি। অথবা এসব গ্রন্থ থেকে যে রয়্যালটি পাওয়া যায়, পাউন্ডের হিসেবে তা সামান্যই। কিন্তু লেখাই আমার নেশা। সত্তরের কোঠায় পড়েও এই নেশা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার পর ডজনখানেক বই বোধ হয় লিখেছি।
গোলাম মুরশিদ: গবেষক।
No comments