মত দ্বিমত-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে by মাহবুব উল্লাহ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে যে আলোচনাটি সামনে এসেছে তা হলো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনও সম্ভব কিনা? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? এ বিষয়ে দুটি লেখা ছাপা হলো।


ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা বলছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার যে সাংবিধানিক বিধান আছে, সেটি সংশোধন করতে হবে। তাঁদের এই বক্তব্যের পেছনে যৌক্তিতা ছিল ২০০৭-এ গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া অনুধাবন করে। প্রধান দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কর্মী, নেতা, ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাদের হয়রানি ও নির্যাতনে শিকার হন। এর আগে ২০০৬-এর আগেই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়—চারজন উপদেষ্টার পদত্যাগ এবং প্রধান দুটি দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে তাঁরাও অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে বিদায় নিতে বাধ্য হন। এর পরই ঘটে ১১ জানুয়ারি অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপ।
যেসব দেশে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চালু আছে, সেসব দেশে বিদায়ী সরকারই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করে এবং তাদের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে দুটি প্রধান দলের মধ্যে আস্থার যে সংকট আছে, তাতে বিশ্বজনীন এই ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা ১৯৯৬ এবং ২০০১-এর নির্বাচনে কার্যকর বলেই প্রমাণিত । কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ২০০৬-এ ২০০৭ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঘিরে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী মঞ্জুরুল আলম বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এ উদাহরণ টেনে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে যদি এ রকম একটি নির্বাচন হতে পারে তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখার প্রয়োজনীয়তা নেই। এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপি সরকারের অধীনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী যথাক্রমে মোহাম্মদ হানিফ ও মহিউদ্দিন চৌধুরী বিজয়ী হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কেউ বিশ্বাস করেনি, বিএনপির অধীনে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে ।
কাজেই চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করে না যে ভবিষ্যতে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচনে আমরা দুই প্রার্থীর মধ্যে গভীর সন্দেহ ও অবিশ্বাস ঘুরপাক খেতে দেখেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার দিকে কিছু ফলাফলের খবর প্রচারিত হয়। এতে দেখা গেল মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মঞ্জুরুল আলমের চেয়ে এগিয়ে আছেন। এরপর দীর্ঘক্ষণ রাত ১১টা পর্যন্ত ফলাফল প্রচার বন্ধ ছিল। এই ঘটনা অনেককে হতবাক করেছে এবং কিছু উত্তেজনাও সৃষ্টি হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। অন্যদিকে মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দলবলসহ প্রবেশের চেষ্টা করলে নির্বাচন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বাধা দেওয়া হয়।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ফলাফল ঘোষিত হয় এবং মঞ্জুরুল আলমকে নির্বাচিত বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দেয়। দীর্ঘ সময় নির্বাচনী ফলাফল প্রচারে যে বিরতি ঘটানো হয় তা রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। চট্টগ্রাম শহরকে আমি জানি। ভোটকেন্দ্রগুলো যেভাবে বিন্যাস করা হয়েছিল তাতে অব্যাহতভাবে ফলাফল প্রচার করা দুরূহ কাজ ছিল না। এ ছাড়া অভিযোগ উঠেছে, কিছু নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ফলাফলপত্রে সই দিতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। সব মিলে বলা যায়, চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ফল ঘোষণায় বাধা সৃষ্টির চেষ্টা কোনো না কোনো মহল থেকে নেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের সুমতি ঘটেছে।
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সমগ্র দেশে। আমরা যদি ধরেও নিই যে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করার জন্য আগ্রহী। তা সত্ত্বেও সারা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা তাদের নেই। নির্বাচন কমিশনকে আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বলেই বিরোধী দল নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করে। চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচনেও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এর আগে ভোলা উপনির্বাচনে সে দাবি অগ্রাহ্য হয়। কমিশনের প্রতি বিএনপিসহ কিছু দলের আস্থারও অভাব রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির সঙ্গে তারা যে আচরণ করেছিল সেটি বিএনপির খুব সহজে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। শুধু একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কী ভূমিকা পালন করেছে তা দিয়ে তাদের অতীতের বিচ্যুতিগুলো ধুয়ে মুছে যায় না। সে জন্যই নির্বাচন কমিশনকে এখনো পুরো নিরপেক্ষ বলার সুযোগ নেই।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেষ হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। দলীয় সরকার দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশন কতটা বিরোধী দলসহ সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে সেটি বিরাট প্রশ্ন। অতীতে প্রায় প্রতিটি নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত ছিল এবং সব সিইসিকে নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। সুতরাং সরকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা একটি নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে—এটি বিশ্বাস করা কঠিন।
জাতীয় নির্বাচনের আগে সমগ্র জাতিকে যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে, তা হলো সব দল ও মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা। সরকার যদি গণতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় তাহলে তাদের উচিত হবে, সব ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা। বর্তমান বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে সব দলের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন। এ পদক্ষেপটি নেওয়া হলেই আমাদের গণতন্ত্র স্বাধীন পথে হাঁটার প্রাথমিক সুযোগ পাবে।
আগামীতে দলীয় নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান কাম্য। এ মুহূর্তে অন্য ধরনের কোনো চিন্তা জাতিকে আরও বিভক্ত করবে এবং রাজনৈতিক সংঘাতকে উসকে দেবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.