জনসংখ্যা-যমদূত সমাচার by সৈয়দ আব্দুল হাদী
প্রিয় পাঠক, বেশ কিছুদিন আগে একটি বিষয়ে কিছু লেখালেখি করার চেষ্টা করেছিলাম, ‘বলা বাহুল্য, বিষয়টি কোনো গুরুত্বই পায়নি। খুবই মনঃকষ্টে ভুগছিলাম। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই একদিন একটি স্বপ্ন দেখলাম, বিধাতা স্বয়ং বলছেন, ‘ওরে মূর্খ, লেখালেখির কাজ তোর নয়, ওই কাজের জন্য আমি বুদ্ধিজীবীদের পাঠিয়েছি,
তুই গান করার আছে, করগে যা, আর অত খায়েশ থাকলে হালকা কোনো গল্পটল্প লেখার চেষ্টা করোগে যাও, ওসব স্পর্শকাতর বিষয়ে মাথা গলাতে যেয়ো না যেন।’
প্রিয় পাঠক, বিধাতার নির্দেশ মেনে একটি গল্পই লেখারই চেষ্টা করছি। গল্পটি একটু ‘শিশুতোষ’ ধরনের মনে হতে পারে। গল্পটি নিম্নরূপ:
এক দেশে ছিলেন এক মহাপরাক্রমশালী রাজা। কিন্তু প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। রাজার মনে নেই শান্তি। তাঁর যে কোনো সন্তান নেই! এত বড় রাজ্যের নেই কোনো উত্তরাধিকারী! সন্তান লাভের আশায় সভাসদদের পরামর্শে হেরেম করেছেন পরিপূর্ণ। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বীতশ্রদ্ধ হয়ে ঠিক করলেন, আর কারও পরামর্শ নয়, এবার নিজেই বসবেন ধ্যানে, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।’ তাঁর সাধনার একাগ্রতা দেখে বিধাতা তুষ্ট হলেন। একদিন রাতে দর্শন দিয়ে বললেন, ‘যাও, সংসারধর্ম পালনে পুনরায় মনোনিবেশ করো। তুমি সন্তান লাভ করবে, তবে একটি শর্ত রয়েছে—তোমার রাজ্যে যত গরিব প্রজা রয়েছে, যাঁরা সন্তানের লেখাপড়া, এমনকি খাওয়া-পরার ব্যবস্থাও করতে পারেন না, তাঁদের সন্তানদের জন্য একটি “শিশুসদন” স্থাপন করবে। সেখানে তুমি নিজের সন্তানের মতো এদের লালন-পালন করবে এবং লেখাপড়া শিখিয়ে কাজকর্মে লাগিয়ে দেবে।’ মহারাজ তো মহাখুশি। এত দিনে তাঁর মনের সাধ পূর্ণ হলো, উত্তরাধিকারের দুশ্চিন্তা দূর হলো।
দেখতে দেখতে বছর না ঘুরতেই নবজাতকদের চিৎকার আর উলুধ্বনির ঐকতানে মুখরিত হয়ে উঠল রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদের বাইরে গড়ে তোলা হলো শিশুসদন। আসতে লাগল অপুষ্টির শিকার, হাড় জিরজিরে শিশুর কাফেলা। দরিদ্র পিতামাতার চোখে আনন্দাশ্রু—এবার বুঝি বিধাতা মুখ তুলে চেয়েছেন। মহারাজার জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে থাকল; ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ যেন বুঁদ হয়ে রইল সবাই। গড়গড়ার নল মুখে প্রাসাদের ব্যালকনিতে বসে রাজা তৃপ্তির হাসি হাসেন।
‘তারপর তাহারা সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ ধরনের একটি সমাপ্তি এখানেই টানা যেত গল্পটির, কিন্তু সুখ তো আর চিরস্থায়ী হয় না। এ রাজ্যের ভাগ্যেও কোনো ব্যতিক্রম হলো না। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। মহারাজার কেশদামে পাক ধরতে শুরু করেছে। এমন সময় একদিন রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী রাজার সামনে এসে করজোড়ে দাঁড়ালেন: ‘আমায় এবার বিশ্রামে যেতে দিন, মহারাজ।’
‘কেন, কী হয়েছে তোমার?’
‘আজ্ঞে, বুড়ো হয়েছি, এত ঝামেলা আর সামলাতে পারছি না। মহারাজ, এত দিন আপনার নুন খেয়েছি, সবকিছু আগলে রাখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আর বোধ হয় পারছি না।’
‘কেন?’
‘মহারাজ, রাজকুমার-কুমারীদের যে আর স্থান সংকুুলান হচ্ছে না প্রাসাদে—ডাবলিং করেও হচ্ছে না। খাদ্যের তালিকাও কিছুটা কাটছাঁট করতে হচ্ছে। বুঝতে পারছি, অসন্তোষ দানা বাঁধছে। গোপন খবর— উত্তরাধিকার নিয়ে দলাদলি, ষড়যন্ত্রও শুরু হয়েছে। শুনেছি, হাতাহাতি হয়েছে, খুনোখুনি হতেও বিশেষ বাকি নেই।’
‘কী?’ রাজামশাই আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘ডাকো কোতোয়ালকে’। কিছুক্ষণের মধ্যে কোতোয়াল এসে দাঁড়ালেন, পেছনে পেছনে খাজাঞ্চিবাবুও।
‘এসব কী শুনছি, কোতোয়াল? শুধু ঘুমাও নাকি?’
‘আজ্ঞে, ঘুমাব কখন, নাওয়া-খাওয়ার সময় পাচ্ছি না। প্রাসাদে, বাইরে, রাজ্যময় যে অস্থিরতা, হানাহানি, তা সামাল দেওয়া যে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না।’
‘আমার রাজ্যে নতুন আবার এসব কী উপসর্গ?’
‘আজ্ঞে, প্রাসাদে তো রাজকুমার-রাজকুমারীদের ব্যাপার, সেখানে হাত দিতে গেলে যে গর্দান যাবে, ভয়ে নাক গলাইনি। কিন্তু প্রাসাদের বাইরে শিশুসদনেরও একই হাল। দুজনের কক্ষে ১০ জন রেখেও সামাল দিতে পারছি না। সেখানেও একই অরাজকতা শুরু হয়েছে।’
‘তা, আরও কিছু ঘরদোর বানালেই তো পারো।’
এতক্ষণে খাজাঞ্চিবাবু মুখ খুললেন, ‘আজ্ঞে, বানাতে বানাতে রাজ্যের খাল, বিল, পুকুর, খানাখন্দ কিছুই তো বাদ রাখিনি মহারাজ, আর রাজকোষও যে শূন্যের কোঠায়।’
রাজামশাই অগ্নিশর্মা হয়ে ধমকে উঠলেন, ‘আগে বলোনি কেন? যাও, কাজকর্ম কিছু একটা দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করো সব, অনেক হয়েছে।’
‘তা কি আর চেষ্টা করিনি! চাল-ডাল মিশিয়ে আলাদা করার কাজও দিয়েছি। এমনকি কুকুরের লেজ সোজা করার কাজ দেওয়ারও চেষ্টা করছি, কিন্তু এত কুকুরও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘মন্ত্রী!’
‘আজ্ঞে।’
‘বিভিন্ন রাজ্যে দূত পাঠাও কাজের সন্ধানে। আমার একখানা অনুরোধলিপিও সঙ্গে দিয়ে দেবে।’
‘আজ্ঞে, সে ব্যবস্থা তো অনেক আগে থেকেই করেছি, পাঠিয়েছিও অনেক। কিন্তু তাদের চাহিদাও কমে আসছে। ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে নানা অজুহাতে। হুজুরকে তো বলতে সাহস পাইনি, বেঘোরে প্রাণও হারিয়েছে অনেকে। প্রতিবাদ করেও কোনো কাজ হয়নি। এ অপমানও যে আর সহ্য হয় না, মহারাজ।’
এমন সময় প্রাসাদের সদর দরজার সামনে হট্টগোল শোনা গেল: ‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই..!’ রাজা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওসব কী বলছে, ওরা কারা? এত হইচই করার সাহসই বা পেল কোত্থেকে ওরা, কোতোয়াল?’
‘এ আর কী শুনছেন মহারাজ, প্রতিদিন এদের সামলাতেই তো হিমশিম খাচ্ছি। দলাদলি, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি...। দু-চারটে লাশ তো এখানে-সেখানে প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। কত নতুন নতুন শব্দ, নতুন নতুন নাম যে শোনা যাচ্ছে হুজুর, ইহজনমেও শুনিনি।’
‘যেমন?’
‘এই যেমন, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী... আরও কত কী! নামের বাহার দেখলে অতি দুঃখেও মহারাজের হাসি পাবে, টুণ্ডা অমুক তো, ডান্ডা তমুক, ল্যাংড়া অমুুক তো চ্যাংড়া তমুক...এসব আরকি!’
‘বাস বাস হয়েছে, থামো এবার, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে।’
‘সে কী! রাজবৈদ্যকে ডাকব, মহারাজ?’
‘না না, বৈদ্যটৈদ্য দিয়ে হবে না, জুড়ি গাড়ি লাগাতে বলো, নদীর পার থেকে একটু মুক্ত হাওয়া সেবন করে মস্তিষ্ক শীতল করে আসি।’
মন্ত্রী, কোতোয়াল, খাজাঞ্চি তিনজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
‘কী হলো, অমন গোমড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ রাজা ধমক দিলেন।
‘আজ্ঞে, মহারাজ তো অনেক দিন বের হননি, মুক্ত বায়ু আর নদী—ওসব তো অতীত ইতিহাস। ওসবের অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাবেন না, হুজুর। নদী বলতে তো এখন শীর্ণকায় একটি নালা বই কিছুই বাকি নেই।’
‘কেন? এত বড় নদীটা হাওয়া হয়ে গেল নাকি?’
‘আজ্ঞে, হাওয়া হবে কেন, আপনার আমির-ওমরারা কলকারখানা ইত্যাদি বানিয়ে আর বাকি যা ছিল, তা মহারাজার ভূমিহীন, দরিদ্র প্রজারা কোনো রকম কুঁড়েঘরটর তুলে বসবাস করছে। ওদিকে গিয়ে কাজ নেই হুজুর, মনুষ্য বর্জ্য আর কারখানা ইত্যাদির বর্জ্যে পরিবেশ পূঁতিগন্ধময়। আপনার শরীর খারাপ করবে। তা ছাড়া এখন যাত্রা করলে বিভিন্ন গতির শকট আর পথচারীর ভিড় ঠেলে ফিরে এসে আর নৈশভোজের সময় পাবেন না।’
রাজা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। দরজার খিল এঁটে আবার ধ্যানে বসলেন। ধ্যানের একাগ্রতায় ঈশ্বর দর্শন না দিয়ে পারলেন না।
‘কী হলো আবার তোর?’
‘প্রভু, আমি সন্তান চেয়েছিলাম, তাই বলে রাজ্যের এই হাল হবে?’
‘ওরে মূর্খের দল, সন্তান চেয়েছিলি, সন্তান দিয়েছি। কোথায় থামতে হবে, তাও কি আমাকেই ভাবতে হবে? আমাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে ভাবতে হয়, তোদের পুঁচকে রাজ্য নিয়ে এত ভাবাভাবির সময় কোথায় আমার?’
‘তা হলে এখন কী হবে প্রভু?’ বলে রাজা কাঁদতে শুরু করলেন।
ঈশ্বর মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, ‘যাও, আর নাকি-কান্না কাঁদতে হবে না। দেখি কী করা যায়।’
এই বলে ঈশ্বর স্বর্গারোহণ করে যমদূতকে ডেকে বললেন: ‘কী হে, খুব কাজে ফাঁকি দিচ্ছ আজকাল।’
‘প্রভু, কী অপরাধ?’
‘কাজে ফাঁকিই যদি না দেবে, তাহলে ওই যে কী যেন নাম, ছোট একটা রাজ্য, তার এমন অবস্থা হবে কেন?’
‘হায় প্রভু, ওখানে তো ওভারাটাইম করেও কূলকিনারা করতে পারছি না।’
‘বুঝেছি, তোমার তো গায়ের জোরই সম্বল, মাথায় তো ঘিলু বলতে কিছু নেই। তাই ওই ম্যালথাস, না কী যেন নাম ব্যাটার, ওর কাছ থেকে কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়ে যেয়ো। ওকে ডেকে আনো।
এই বলে ঈশ্বর স্বর্গান্তরে চলে গেলেন। যমদূত ছুটলেন মরহুম ম্যালথাসের সন্ধানে।
(প্রিয় পাঠক, ছোটগল্পের রীতি মেনে গল্পটি এখানেই শেষ করা বোধ হয় সংগত হবে। উপসংহারটুকু নিজ নিজ বিবেচনা অনুযায়ী ভেবে নেওয়ার ভার আপনাদের ওপরই রইল।)
সৈয়দ আব্দুল হাদী: সংগীতশিল্পী।
প্রিয় পাঠক, বিধাতার নির্দেশ মেনে একটি গল্পই লেখারই চেষ্টা করছি। গল্পটি একটু ‘শিশুতোষ’ ধরনের মনে হতে পারে। গল্পটি নিম্নরূপ:
এক দেশে ছিলেন এক মহাপরাক্রমশালী রাজা। কিন্তু প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। রাজার মনে নেই শান্তি। তাঁর যে কোনো সন্তান নেই! এত বড় রাজ্যের নেই কোনো উত্তরাধিকারী! সন্তান লাভের আশায় সভাসদদের পরামর্শে হেরেম করেছেন পরিপূর্ণ। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বীতশ্রদ্ধ হয়ে ঠিক করলেন, আর কারও পরামর্শ নয়, এবার নিজেই বসবেন ধ্যানে, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।’ তাঁর সাধনার একাগ্রতা দেখে বিধাতা তুষ্ট হলেন। একদিন রাতে দর্শন দিয়ে বললেন, ‘যাও, সংসারধর্ম পালনে পুনরায় মনোনিবেশ করো। তুমি সন্তান লাভ করবে, তবে একটি শর্ত রয়েছে—তোমার রাজ্যে যত গরিব প্রজা রয়েছে, যাঁরা সন্তানের লেখাপড়া, এমনকি খাওয়া-পরার ব্যবস্থাও করতে পারেন না, তাঁদের সন্তানদের জন্য একটি “শিশুসদন” স্থাপন করবে। সেখানে তুমি নিজের সন্তানের মতো এদের লালন-পালন করবে এবং লেখাপড়া শিখিয়ে কাজকর্মে লাগিয়ে দেবে।’ মহারাজ তো মহাখুশি। এত দিনে তাঁর মনের সাধ পূর্ণ হলো, উত্তরাধিকারের দুশ্চিন্তা দূর হলো।
দেখতে দেখতে বছর না ঘুরতেই নবজাতকদের চিৎকার আর উলুধ্বনির ঐকতানে মুখরিত হয়ে উঠল রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদের বাইরে গড়ে তোলা হলো শিশুসদন। আসতে লাগল অপুষ্টির শিকার, হাড় জিরজিরে শিশুর কাফেলা। দরিদ্র পিতামাতার চোখে আনন্দাশ্রু—এবার বুঝি বিধাতা মুখ তুলে চেয়েছেন। মহারাজার জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে থাকল; ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ যেন বুঁদ হয়ে রইল সবাই। গড়গড়ার নল মুখে প্রাসাদের ব্যালকনিতে বসে রাজা তৃপ্তির হাসি হাসেন।
‘তারপর তাহারা সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ ধরনের একটি সমাপ্তি এখানেই টানা যেত গল্পটির, কিন্তু সুখ তো আর চিরস্থায়ী হয় না। এ রাজ্যের ভাগ্যেও কোনো ব্যতিক্রম হলো না। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। মহারাজার কেশদামে পাক ধরতে শুরু করেছে। এমন সময় একদিন রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী রাজার সামনে এসে করজোড়ে দাঁড়ালেন: ‘আমায় এবার বিশ্রামে যেতে দিন, মহারাজ।’
‘কেন, কী হয়েছে তোমার?’
‘আজ্ঞে, বুড়ো হয়েছি, এত ঝামেলা আর সামলাতে পারছি না। মহারাজ, এত দিন আপনার নুন খেয়েছি, সবকিছু আগলে রাখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আর বোধ হয় পারছি না।’
‘কেন?’
‘মহারাজ, রাজকুমার-কুমারীদের যে আর স্থান সংকুুলান হচ্ছে না প্রাসাদে—ডাবলিং করেও হচ্ছে না। খাদ্যের তালিকাও কিছুটা কাটছাঁট করতে হচ্ছে। বুঝতে পারছি, অসন্তোষ দানা বাঁধছে। গোপন খবর— উত্তরাধিকার নিয়ে দলাদলি, ষড়যন্ত্রও শুরু হয়েছে। শুনেছি, হাতাহাতি হয়েছে, খুনোখুনি হতেও বিশেষ বাকি নেই।’
‘কী?’ রাজামশাই আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘ডাকো কোতোয়ালকে’। কিছুক্ষণের মধ্যে কোতোয়াল এসে দাঁড়ালেন, পেছনে পেছনে খাজাঞ্চিবাবুও।
‘এসব কী শুনছি, কোতোয়াল? শুধু ঘুমাও নাকি?’
‘আজ্ঞে, ঘুমাব কখন, নাওয়া-খাওয়ার সময় পাচ্ছি না। প্রাসাদে, বাইরে, রাজ্যময় যে অস্থিরতা, হানাহানি, তা সামাল দেওয়া যে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না।’
‘আমার রাজ্যে নতুন আবার এসব কী উপসর্গ?’
‘আজ্ঞে, প্রাসাদে তো রাজকুমার-রাজকুমারীদের ব্যাপার, সেখানে হাত দিতে গেলে যে গর্দান যাবে, ভয়ে নাক গলাইনি। কিন্তু প্রাসাদের বাইরে শিশুসদনেরও একই হাল। দুজনের কক্ষে ১০ জন রেখেও সামাল দিতে পারছি না। সেখানেও একই অরাজকতা শুরু হয়েছে।’
‘তা, আরও কিছু ঘরদোর বানালেই তো পারো।’
এতক্ষণে খাজাঞ্চিবাবু মুখ খুললেন, ‘আজ্ঞে, বানাতে বানাতে রাজ্যের খাল, বিল, পুকুর, খানাখন্দ কিছুই তো বাদ রাখিনি মহারাজ, আর রাজকোষও যে শূন্যের কোঠায়।’
রাজামশাই অগ্নিশর্মা হয়ে ধমকে উঠলেন, ‘আগে বলোনি কেন? যাও, কাজকর্ম কিছু একটা দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করো সব, অনেক হয়েছে।’
‘তা কি আর চেষ্টা করিনি! চাল-ডাল মিশিয়ে আলাদা করার কাজও দিয়েছি। এমনকি কুকুরের লেজ সোজা করার কাজ দেওয়ারও চেষ্টা করছি, কিন্তু এত কুকুরও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘মন্ত্রী!’
‘আজ্ঞে।’
‘বিভিন্ন রাজ্যে দূত পাঠাও কাজের সন্ধানে। আমার একখানা অনুরোধলিপিও সঙ্গে দিয়ে দেবে।’
‘আজ্ঞে, সে ব্যবস্থা তো অনেক আগে থেকেই করেছি, পাঠিয়েছিও অনেক। কিন্তু তাদের চাহিদাও কমে আসছে। ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে নানা অজুহাতে। হুজুরকে তো বলতে সাহস পাইনি, বেঘোরে প্রাণও হারিয়েছে অনেকে। প্রতিবাদ করেও কোনো কাজ হয়নি। এ অপমানও যে আর সহ্য হয় না, মহারাজ।’
এমন সময় প্রাসাদের সদর দরজার সামনে হট্টগোল শোনা গেল: ‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই..!’ রাজা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওসব কী বলছে, ওরা কারা? এত হইচই করার সাহসই বা পেল কোত্থেকে ওরা, কোতোয়াল?’
‘এ আর কী শুনছেন মহারাজ, প্রতিদিন এদের সামলাতেই তো হিমশিম খাচ্ছি। দলাদলি, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি...। দু-চারটে লাশ তো এখানে-সেখানে প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। কত নতুন নতুন শব্দ, নতুন নতুন নাম যে শোনা যাচ্ছে হুজুর, ইহজনমেও শুনিনি।’
‘যেমন?’
‘এই যেমন, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী... আরও কত কী! নামের বাহার দেখলে অতি দুঃখেও মহারাজের হাসি পাবে, টুণ্ডা অমুক তো, ডান্ডা তমুক, ল্যাংড়া অমুুক তো চ্যাংড়া তমুক...এসব আরকি!’
‘বাস বাস হয়েছে, থামো এবার, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে।’
‘সে কী! রাজবৈদ্যকে ডাকব, মহারাজ?’
‘না না, বৈদ্যটৈদ্য দিয়ে হবে না, জুড়ি গাড়ি লাগাতে বলো, নদীর পার থেকে একটু মুক্ত হাওয়া সেবন করে মস্তিষ্ক শীতল করে আসি।’
মন্ত্রী, কোতোয়াল, খাজাঞ্চি তিনজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
‘কী হলো, অমন গোমড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ রাজা ধমক দিলেন।
‘আজ্ঞে, মহারাজ তো অনেক দিন বের হননি, মুক্ত বায়ু আর নদী—ওসব তো অতীত ইতিহাস। ওসবের অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাবেন না, হুজুর। নদী বলতে তো এখন শীর্ণকায় একটি নালা বই কিছুই বাকি নেই।’
‘কেন? এত বড় নদীটা হাওয়া হয়ে গেল নাকি?’
‘আজ্ঞে, হাওয়া হবে কেন, আপনার আমির-ওমরারা কলকারখানা ইত্যাদি বানিয়ে আর বাকি যা ছিল, তা মহারাজার ভূমিহীন, দরিদ্র প্রজারা কোনো রকম কুঁড়েঘরটর তুলে বসবাস করছে। ওদিকে গিয়ে কাজ নেই হুজুর, মনুষ্য বর্জ্য আর কারখানা ইত্যাদির বর্জ্যে পরিবেশ পূঁতিগন্ধময়। আপনার শরীর খারাপ করবে। তা ছাড়া এখন যাত্রা করলে বিভিন্ন গতির শকট আর পথচারীর ভিড় ঠেলে ফিরে এসে আর নৈশভোজের সময় পাবেন না।’
রাজা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। দরজার খিল এঁটে আবার ধ্যানে বসলেন। ধ্যানের একাগ্রতায় ঈশ্বর দর্শন না দিয়ে পারলেন না।
‘কী হলো আবার তোর?’
‘প্রভু, আমি সন্তান চেয়েছিলাম, তাই বলে রাজ্যের এই হাল হবে?’
‘ওরে মূর্খের দল, সন্তান চেয়েছিলি, সন্তান দিয়েছি। কোথায় থামতে হবে, তাও কি আমাকেই ভাবতে হবে? আমাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে ভাবতে হয়, তোদের পুঁচকে রাজ্য নিয়ে এত ভাবাভাবির সময় কোথায় আমার?’
‘তা হলে এখন কী হবে প্রভু?’ বলে রাজা কাঁদতে শুরু করলেন।
ঈশ্বর মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, ‘যাও, আর নাকি-কান্না কাঁদতে হবে না। দেখি কী করা যায়।’
এই বলে ঈশ্বর স্বর্গারোহণ করে যমদূতকে ডেকে বললেন: ‘কী হে, খুব কাজে ফাঁকি দিচ্ছ আজকাল।’
‘প্রভু, কী অপরাধ?’
‘কাজে ফাঁকিই যদি না দেবে, তাহলে ওই যে কী যেন নাম, ছোট একটা রাজ্য, তার এমন অবস্থা হবে কেন?’
‘হায় প্রভু, ওখানে তো ওভারাটাইম করেও কূলকিনারা করতে পারছি না।’
‘বুঝেছি, তোমার তো গায়ের জোরই সম্বল, মাথায় তো ঘিলু বলতে কিছু নেই। তাই ওই ম্যালথাস, না কী যেন নাম ব্যাটার, ওর কাছ থেকে কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়ে যেয়ো। ওকে ডেকে আনো।
এই বলে ঈশ্বর স্বর্গান্তরে চলে গেলেন। যমদূত ছুটলেন মরহুম ম্যালথাসের সন্ধানে।
(প্রিয় পাঠক, ছোটগল্পের রীতি মেনে গল্পটি এখানেই শেষ করা বোধ হয় সংগত হবে। উপসংহারটুকু নিজ নিজ বিবেচনা অনুযায়ী ভেবে নেওয়ার ভার আপনাদের ওপরই রইল।)
সৈয়দ আব্দুল হাদী: সংগীতশিল্পী।
No comments