মত দ্বিমত-দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনও অসম্ভব নয় by হারুন অর রশীদ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে যে আলোচনাটি সামনে এসেছে তা হলো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনও সম্ভব কিনা? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? এ বিষয়ে দুটি লেখা ছাপা হলো।


চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে প্রবণতা লক্ষ করা গেছে তাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর নির্বাচন কমিশনের পুরো কর্তৃত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। তারা স্বাধীন সত্তা নিয়ে কাজ করতে পেরেছে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিয়েছে। অবশ্য এর আগে ভোলা ও বগুড়ার উপনির্বাচনও তারা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। এটি নিশ্চয়ই আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও যথাসাধ্য স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না?
এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে বিচার করতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হলো কেন? পৃথিবীর সব দেশেই দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন ছিল। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে। সামরিক শাসকেরা বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় এসে নির্বাচন কমিশনকে নিজের মতো করে সাজিয়েছে, বিতর্কিত করেছে। এমনকি নানা অপতৎপরতা সত্ত্বেও জনগণ যখন তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তখন ভোটের ফল উল্টে দিতেও তারা দ্বিধা করেনি। জিয়া ও এরশাদের আমলে একাধিকবার সাজানো নির্বাচন হয়েছে।
এ কারণেই নব্বইয়ে গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও সেই ধারা বন্ধ হয়নি। খালেদা জিয়ার আমলে মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আসে এবং সে দাবিতে কিন্তু তখনকার সব বিরোধী দল আন্দোলন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার পছন্দসই ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করার লক্ষ্যে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ১/১১-এর উদ্ভব হয়। তিন মাসের জন্য আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। তার পরও বলব, ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও বিজয়ী প্রার্থী এম এ মঞ্জুরুল আলমকে ত্বরিত অভিনন্দন জানিয়েছেন। সরকারি দলের পক্ষ থেকে তাঁকে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে নবনির্বাচিত মেয়রও চট্টগ্রামের উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এটাই হলো সুস্থ ও সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক চেতনা। এখানে একটি কথা বলা দরকার, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলকে বিরোধীদলীয় নেত্রী অভিনন্দন জানাননি। ভোলা ও বগুড়া নির্বাচনের পরও তাঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, তিনি সব সময়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনিও স্বীকার করে নিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দলের মেনে নেওয়া এবং অভিনন্দন জানানোকে আমি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শুভ দিক বলে মনে করি। গণতন্ত্র দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়। কথা হলো, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলো কীভাবে? দেখতে হবে নির্বাচন কমিশনে কারা আছেন? তাঁরা কি নতজানু চরিত্রের, না স্বাধীনচেতা? পূর্বাপর একের পর এক সুষ্ঠু নির্বাচন করে তাঁরা স্বাধীন সত্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু সেখানে যদি তাঁরা জি-হুজুর মার্কা লোক নিয়োগ দিতেন তাহলে এটি সম্ভব হতো না।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, তাতে জাতীয় নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে করা অসম্ভব নয়। তবে এই লক্ষ্যে আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। নির্বাচনে জিতলে ফল মানি, আর হারলে মানি না—মনোভাব পরিহার করতে হবে। আমি মনে করি, সরকার ও বিরোধী দল একমত হলে দলীয় সরকারের অধীনেও অবাধ, সুষ্ঠু পরিবেশে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। তবে সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচন কমিশনে পৃথক সচিবালয় করা হয়েছে, এটি ভালো দিক। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী করতে হবে। সর্বোপরি নির্বাচন কমিশন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান—একে শক্তিশালী করতে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনই তার প্রমাণ। এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে রাজনৈতিক দল ও নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অগ্রণী ভূমিকার কথা সবাই মনে রাখবে। অবাধ তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার তথ্য অধিকার আইন করেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিশেষ করে ভোট গ্রহণ ও ফল ঘোষণায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা গেলে কেউ ফলাফল উল্টে দিতে পারবে না, যেটি সামরিক সরকারের আমলে বহুবার হয়েছে।
এ কথা ঠিক, একটি স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এক নয়। স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনের ফলাফলে সরকারের পতন হয় না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা ও না-থাকার প্রশ্নটিই বড়। তার পরও বলব, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকলে, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর মতো জাতীয় নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে করাও অসম্ভব হবেনা। তবে সে জন্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে, যার শুভলক্ষণ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লক্ষ করা গেছে।
ড. হারুন অর রশীদ: উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.