চারদিক-আমের রাজ্যে একদিন by শর্মিলা সিনড্রেলা
আকাশের রং কী? আকাশের নক্ষত্রদেরই বা কী রং? না, না, এটা স্রেফ কোনো প্রশ্ন নয়। জানা কথা, আকাশের রং নীল আর নক্ষত্ররা জ্বলন্ত লাল আগুন। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বপশ্চিমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আকাশ এখন সবুজ! আর সেখানকার আকাশের নক্ষত্রগুলোও সবুজ। আপনি যদি নক্ষত্রদের সঙ্গে মোলাকাত করতে চান, তাও সম্ভব।
এ জন্য শুধু সবুজ আকাশের নিচ দিয়ে হাঁটাই যথেষ্ট। হ্যাঁ, আমরা আকাশ বলতে আমগাছের কথা বলছি। আর নক্ষত্র হচ্ছে সেই গাছগুলোয় থোকা থোকা ঝুলে থাকা আম। অবাক হয়ে যাচ্ছেন? ঘুরেই আসুন না চাঁপাইনবাবগঞ্জ। হ্যাঁ, আমি আসলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবুজ আমবাগানের সবুজ আমের কথা বলছি।
ভাবুন তো, কেমন হবে যদি আপনি নিজে গাছ থেকে আম পেড়ে খেতে পারেন? বা যদি দেখেন একজন বিক্রেতা এমন আম নিয়ে বসে আছে যে আমের বোঁটায় এখনো কষ লেগে আছে? এমনই সব রসরসে-টসটসে কাঁচা-পাকা আম দেখতে হলে যেতে হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে বড় আমের হাট কানসাটে। শিবগঞ্জের খাসেরহাট থেকে ভুটভুটি নামের যানে চড়ে যখন কানসাটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি, তখন বেলা প্রায় ১১টা। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য তার সব তেজ নিংড়ে দিচ্ছে। না, প্রচণ্ড রোদ আম কেনাবেচায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। যেমন বিক্রেতার সংখ্যা বেশি, ক্রেতার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। রাস্তার ধারেই অনেক বিক্রেতা আমের ডালি সাইকেল-ভ্যানে করে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমের ভিড়ে কানসাটের রাস্তায় যানবাহন তো দূরের কথা. মানুষ চলাও যেন দায়। এরই মধ্যে চলছে দরকষাকষি। ‘কত করে জি, এই আম?’
‘১৫০০ করে মণ, লিবা?’
‘নাহ, ৯৫০ দিবা?’
‘মাথা খারাপ? কুণ্ঠে (কোথায়) প্যাইবা (পাবে) এই দামে?’—এ রকম বাক্যের ব্যস্ততায় দিন কাটে এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতাদের।
অনেক রকমের আর অদ্ভুত অদ্ভুত নামের আমের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। যেমন—বোগলাগুটি, কালুয়া, কুয়াপাহাড়ি, চোষা, দিলশাদ, রংবাজ, গোলাপবাস, সুন্দরভোগ, মোহনভোগ, মিশ্রিকান্ত ইত্যাদি।
কথা হলো প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী ধাইনগর থেকে আসা মাইনুলের সঙ্গে। গুটি আম নিয়ে এসেছেন তিনি। দাম হয়তো পাওয়া যাবে মণে হাজার কিংবা বারো শ। ভালো দামের আশায় দিনভর রোদে বসে থাকতে হয় মাইনুলদের। হাটে এসেছেন আবদুল আলিম। নিজের গাছের ল্যাংড়া আম নিয়ে বসে আছেন তিনি। কেন জানি আক্ষেপ ঝরছে তাঁর কণ্ঠে; বললেন ‘ল্যাংড়ার নাম আছে দাম নেই।’ চার-পাঁচ মণ আম হাটে আনতে হলে ভ্যান ভাড়া করতে হয়। ‘ভ্যানের ভাড়া দিতে দিতেই তো বিকিয়ে গেনু (বিক্রি হয়ে গেলাম)। ভ্যানওয়ালাকে দিতে হোবে (হবে) ৩০০ টাকা। আবার দুপুরে খিলাতেও (খাওয়াতে) হোবে, বিড়ি-টিড়ি চাহিলেও (চাইলেও) দিতে হয়।’
একটু পাশেই ‘রংবাজ’ আম নিয়ে বসেছেন সেরাজুল। আম বেচাকেনার রং ভালোই লেগেছে তাঁর মনে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘শাহবাজপুরে এমপির বাড়ির পাঞ্জরে (পাশে) হাঁরঘে (আমাদের) বাড়ি।’ দাম? ‘মণপ্রতি এ হাজার ৪০০ টাকা।’ ছাতা মাথায় দিয়ে মুখ কুঁচকে বসে ছিলেন জগন্নাথপুরের শফিকুল। তাঁর কাছে যে আম আছে তার নাম দিলশাদ। ‘স্বাদে প্রচুর মিষ্টি, খেলে দিল জুড়িয়ে যাবে। দাম মাত্র ৯০০ টাকা মণ।’ শফিকুলের কাছে আরেকটা মিষ্টি আম আছে; নাম বোম্বাই আম। ‘এবার একটু বেশি খরা বলেই আমটার আকার একটু ছোট। তা না হলে এই আম আকারে অনেক বড় হয়।’ বিশ্বনাথপুরের ইমরান আলী যেন আমাদের বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘ফজলি, ল্যাংড়া, আশ্বিনা, খিরসাপাত (হিমসাগর)—এ রকম কয়েকটা আম ছাড়া সব আমই তো গুটি। রিয়ালি ফ্যাক্ট! খালি কুনোটা (কোনোটা) একটু দেখতে আলাদা, কুনোটার স্বাদ আলাদা। হামরাই (আমরাই) লয়া লয়া (নতুন নতুন) নাম দিয়েছি। হাঁরা (আমরা) আমের দাম চাই ষোলো শ করে, বিক্রি করি তেরো-চৌদ্দ শ করে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে মিষ্টি আমের নাম-দামই তো বলা হলো না। খিরসাপাত। খেতে কী যে মজা। ল্যাংড়া আর এই আমটাই এলাকার মানুষের সবচেয়ে প্রিয়। বাইরের কোনো আত্মীয়স্বজনকে আম উপহার দিলে সাধারণত এই দুটো জাতের আম বেছে নেন তাঁরা। শিবগঞ্জের হাজারিডাঙ্গার আম ব্যবসায়ী সুনুপতি কুণ্ডু মুঠোফোনে হয়তো কোনো আমের ব্যাপারীর সঙ্গে আমের দামদর নিয়ে কথা বলছিলেন, ‘খিরসাপাত ভালোটা দুই হাজার টাকা। আর ল্যাংড়াটা ষোলো শ।’ বিনোদপুরের আম ব্যবসায়ী রোকনুজ্জামান মুকুল জানালেন, ‘খিরসাপাত আর ল্যাংড়ার দাম প্রতিদিনই বাড়বে।’ কারণ কী? ‘কারণ, বাগানে এই দুটো জাতের আমের পরিমাণ কমে আসছে। তিন-চার দিনের মধ্যেই এগুলোর দাম দাঁড়াবে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার।’
অনেকেই ভ্যানে করে সদ্য গাছ থেকে পাড়া আম নিয়ে আসেন। আবার সাইকেলের রডের মধ্যে কাঠ দিয়ে তার ওপর দুই ডালিতে আম আনেন বিক্রেতারা। এভাবে এক সাইকেলে প্রায় পাঁচ মণ আম আনা যায়। তবে কষ্ট একটাই, এভাবে আম আনলে সাইকেল চালানো যায় না। ১০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ সাইকেল ঠেলে আনতে হয়। এত কষ্ট সহ্য করেও বিক্রেতারা আমের হাট কানসাটে আসেন। চাওয়া একটাই, যথার্থ দাম পেলে কষ্টটা সার্থক হবে।
ভাবুন তো, কেমন হবে যদি আপনি নিজে গাছ থেকে আম পেড়ে খেতে পারেন? বা যদি দেখেন একজন বিক্রেতা এমন আম নিয়ে বসে আছে যে আমের বোঁটায় এখনো কষ লেগে আছে? এমনই সব রসরসে-টসটসে কাঁচা-পাকা আম দেখতে হলে যেতে হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে বড় আমের হাট কানসাটে। শিবগঞ্জের খাসেরহাট থেকে ভুটভুটি নামের যানে চড়ে যখন কানসাটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি, তখন বেলা প্রায় ১১টা। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য তার সব তেজ নিংড়ে দিচ্ছে। না, প্রচণ্ড রোদ আম কেনাবেচায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। যেমন বিক্রেতার সংখ্যা বেশি, ক্রেতার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। রাস্তার ধারেই অনেক বিক্রেতা আমের ডালি সাইকেল-ভ্যানে করে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমের ভিড়ে কানসাটের রাস্তায় যানবাহন তো দূরের কথা. মানুষ চলাও যেন দায়। এরই মধ্যে চলছে দরকষাকষি। ‘কত করে জি, এই আম?’
‘১৫০০ করে মণ, লিবা?’
‘নাহ, ৯৫০ দিবা?’
‘মাথা খারাপ? কুণ্ঠে (কোথায়) প্যাইবা (পাবে) এই দামে?’—এ রকম বাক্যের ব্যস্ততায় দিন কাটে এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতাদের।
অনেক রকমের আর অদ্ভুত অদ্ভুত নামের আমের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। যেমন—বোগলাগুটি, কালুয়া, কুয়াপাহাড়ি, চোষা, দিলশাদ, রংবাজ, গোলাপবাস, সুন্দরভোগ, মোহনভোগ, মিশ্রিকান্ত ইত্যাদি।
কথা হলো প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী ধাইনগর থেকে আসা মাইনুলের সঙ্গে। গুটি আম নিয়ে এসেছেন তিনি। দাম হয়তো পাওয়া যাবে মণে হাজার কিংবা বারো শ। ভালো দামের আশায় দিনভর রোদে বসে থাকতে হয় মাইনুলদের। হাটে এসেছেন আবদুল আলিম। নিজের গাছের ল্যাংড়া আম নিয়ে বসে আছেন তিনি। কেন জানি আক্ষেপ ঝরছে তাঁর কণ্ঠে; বললেন ‘ল্যাংড়ার নাম আছে দাম নেই।’ চার-পাঁচ মণ আম হাটে আনতে হলে ভ্যান ভাড়া করতে হয়। ‘ভ্যানের ভাড়া দিতে দিতেই তো বিকিয়ে গেনু (বিক্রি হয়ে গেলাম)। ভ্যানওয়ালাকে দিতে হোবে (হবে) ৩০০ টাকা। আবার দুপুরে খিলাতেও (খাওয়াতে) হোবে, বিড়ি-টিড়ি চাহিলেও (চাইলেও) দিতে হয়।’
একটু পাশেই ‘রংবাজ’ আম নিয়ে বসেছেন সেরাজুল। আম বেচাকেনার রং ভালোই লেগেছে তাঁর মনে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘শাহবাজপুরে এমপির বাড়ির পাঞ্জরে (পাশে) হাঁরঘে (আমাদের) বাড়ি।’ দাম? ‘মণপ্রতি এ হাজার ৪০০ টাকা।’ ছাতা মাথায় দিয়ে মুখ কুঁচকে বসে ছিলেন জগন্নাথপুরের শফিকুল। তাঁর কাছে যে আম আছে তার নাম দিলশাদ। ‘স্বাদে প্রচুর মিষ্টি, খেলে দিল জুড়িয়ে যাবে। দাম মাত্র ৯০০ টাকা মণ।’ শফিকুলের কাছে আরেকটা মিষ্টি আম আছে; নাম বোম্বাই আম। ‘এবার একটু বেশি খরা বলেই আমটার আকার একটু ছোট। তা না হলে এই আম আকারে অনেক বড় হয়।’ বিশ্বনাথপুরের ইমরান আলী যেন আমাদের বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘ফজলি, ল্যাংড়া, আশ্বিনা, খিরসাপাত (হিমসাগর)—এ রকম কয়েকটা আম ছাড়া সব আমই তো গুটি। রিয়ালি ফ্যাক্ট! খালি কুনোটা (কোনোটা) একটু দেখতে আলাদা, কুনোটার স্বাদ আলাদা। হামরাই (আমরাই) লয়া লয়া (নতুন নতুন) নাম দিয়েছি। হাঁরা (আমরা) আমের দাম চাই ষোলো শ করে, বিক্রি করি তেরো-চৌদ্দ শ করে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে মিষ্টি আমের নাম-দামই তো বলা হলো না। খিরসাপাত। খেতে কী যে মজা। ল্যাংড়া আর এই আমটাই এলাকার মানুষের সবচেয়ে প্রিয়। বাইরের কোনো আত্মীয়স্বজনকে আম উপহার দিলে সাধারণত এই দুটো জাতের আম বেছে নেন তাঁরা। শিবগঞ্জের হাজারিডাঙ্গার আম ব্যবসায়ী সুনুপতি কুণ্ডু মুঠোফোনে হয়তো কোনো আমের ব্যাপারীর সঙ্গে আমের দামদর নিয়ে কথা বলছিলেন, ‘খিরসাপাত ভালোটা দুই হাজার টাকা। আর ল্যাংড়াটা ষোলো শ।’ বিনোদপুরের আম ব্যবসায়ী রোকনুজ্জামান মুকুল জানালেন, ‘খিরসাপাত আর ল্যাংড়ার দাম প্রতিদিনই বাড়বে।’ কারণ কী? ‘কারণ, বাগানে এই দুটো জাতের আমের পরিমাণ কমে আসছে। তিন-চার দিনের মধ্যেই এগুলোর দাম দাঁড়াবে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার।’
অনেকেই ভ্যানে করে সদ্য গাছ থেকে পাড়া আম নিয়ে আসেন। আবার সাইকেলের রডের মধ্যে কাঠ দিয়ে তার ওপর দুই ডালিতে আম আনেন বিক্রেতারা। এভাবে এক সাইকেলে প্রায় পাঁচ মণ আম আনা যায়। তবে কষ্ট একটাই, এভাবে আম আনলে সাইকেল চালানো যায় না। ১০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ সাইকেল ঠেলে আনতে হয়। এত কষ্ট সহ্য করেও বিক্রেতারা আমের হাট কানসাটে আসেন। চাওয়া একটাই, যথার্থ দাম পেলে কষ্টটা সার্থক হবে।
No comments