অধিকার-গ্রাম পুলিশের অনশন আমাদের লজ্জিত করে by এসকে মজিদ মুকুল
গ্রাম পুলিশরাও মানুষ। তারাও দেশের নাগরিক। সে কারণে দেশের সংবিধান অনুসারে তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা তথা মৌলিক অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা বিধানে সাংবিধানিক দায়িত্ব সরকারের। অথচ গ্রাম পুলিশের সংখ্যা কম, দাবিও বেশি নয়
কৈশোর থেকে যৌবনকাল আমরা যাদের জেনে আসছি চৌকিদার-দফাদার, যারা রাত জেগে তাদের দায়িত্বাধীন গ্রামগুলোতে পাহারা দিতেন, যাতে চোর-ডাকাত গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে। সে কারণে তারা মাঝে মাঝে 'জাগো-জাগো' বলে হাঁক্ ছাড়তেন। খোঁজ-খবর রাখতেন, কোন বাড়ির কোন পরিবারের কে রাতে বাড়িতে থাকে না। আবার যে রাতে থাকে না অথচ দিনভর ঘুমায়। পরিবারের কোনো সদস্য বলতে পারে না বা বলে না দিনে ঘুমানোর খবর এবং রাতে না থাকার খবর বা কারণ। তাদের (গ্রাম পুলিশ) জন্য নির্ধারিত তারিখে থানায় হাজিরা দিতে হয় ও হতো। হাজিরাকালে কোনো পাড়ার কোনো গ্রামের কারও প্রতি সন্দেহ হলে তা পুলিশকে জানাতেন। আবার পুলিশের সন্দেহের তালিকায় থাকা সন্দেহপরায়ণ লোকজনের খবরাখবর পেঁৗছে দিতেন। প্রয়োজনে থানা পুলিশ নিয়ে দোষীদের গ্রেফতারে সাহায্য করতেন। কোনো কোনো সময় গ্রামবাসীসহ কাউকে আটক করে থানায় সোপর্দ করতেন। এমন ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনে একেকজন চৌকিদার-দফাদারের সফলতা রয়েছে অনেক। নিজেদের তৈরি একটা লাঠি ছিল তাদের হাতের অস্ত্র। গ্রাম পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা ও উন্নয়ন কাজের জন্য প্রত্যেক পরিবারের নির্ধারিত ইউনিয়ন ট্যাক্স আদায়ের কাজটাও তাদের করতে হতো ও হয়। তেমনি থানা পুলিশের পথপ্রদর্শক বাহিনী বা অগ্রণী বাহিনীর ভূমিকা পালনও করতে হতো তাদের। আদায়কৃত ট্যাক্সের টাকা থেকে তাদের সামান্য ভাতা দেওয়া হতো। আমার জানা মতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে কারা ব্রিটিশের বিরোধিতা করে, কারা ব্রিটিশ সরকারকে খাজনা-ট্যাক্স দিচ্ছে না ও না দেওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন তাদের ধরতে এবং তাদের নামে অভিযোগ দিতেই চৌকিদার ও কয়েকজন চৌকিদারের কাজের তদারকির জন্য দফাদার নিয়োগ করা হয়েছিল। চৌকিদার-দফাদারদের ঘাড়েই সব দোষ চাপাত ব্রিটিশরা।
আমার জানা চৌকিদার-দফাদাররাই আজকের গ্রাম পুলিশ। সেদিন তাদের পোশাক ছিল নীল ও বেগুনি রঙের সংমিশ্রণে। আজকের লাল শার্ট, লাল টুপি, মেরুন খাকি রঙের প্যান্ট। নাম ও পোশাকের ক্ষেত্রে এটুকুই পরিবর্তন। বেতন-ভাতা সে তো ব্রিটিশই দেয়নি। এ দোষ তো আমাদের দেশের কোনো সরকারের নয় (!) ব্রিটিশের আইনই আজকেও এ দেশের আইন। যে আইন লেখা আছে তার কোনোটার ক্ষেত্রে সংশোধন-সংযোজন হয়েছে মাত্র। গ্রাম পুলিশের ভাগ্যের চাকা ভালোর দিকে ঘুরানোর কোনো আইন নেই। আমরা বিতর্কে যাব না। মন্ত্রী-সচিবসহ আমলারা কে কত টাকা পাচ্ছেন, কত টাকা ও কী কী সম্পদের মালিক হচ্ছেন সে খোঁজও করব না। শুধু বলব, থানা পুলিশ থানা এলাকার দায়িত্বে। তারা বেতন-ভাতা-রেশন পান। গ্রাম পুলিশও গ্রামের দায়িত্ব পালনের জন্য বেতন-ভাতা-রেশন পাবেন। তা পাবেন পরিবার পরিজনের জীবন-জীবিকার জন্য। গ্রাম পুলিশরাও মানুষ। তারাও দেশের নাগরিক। সে কারণে দেশের সংবিধান অনুসারে তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা তথা মৌলিক অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা বিধানে সাংবিধানিক দায়িত্ব সরকারের। অথচ গ্রাম পুলিশের সংখ্যা কম, দাবিও বেশি নয়। তাদের দাবি সরকারের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের। এ দাবি নতুন নয়। অনেক বছরের। আমি তো এক যুগের বেশি সময় আগে বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিসহ গাইবান্ধা জেলার সব গ্রাম পুলিশের এক সমাবেশে তাদের সংগঠক-নেতা রংপুরের ষাট দশকের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা, দৈনিক দাবানল সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বাটুল ভাইয়ের অনুরোধে গাইবান্ধার শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলাম। আবেদন জানিয়ে বলেছিলাম সরকারের কাছে, গ্রাম পুলিশরাও মানুষ। তাদের বাঁচার অধিকার রয়েছে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করেছি। কিন্তু আজও তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। আমি তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সরকারের প্রতি বিনীত নিবেদন জানাচ্ছি, গ্রাম পুলিশের দাবি পূরণে চলতি বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকার ভোগের সুযোগ দেওয়া হোক।
এসকে মজিদ মুকুল : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক
No comments