তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-হরতাল পালন, না ভীতি উদযাপন? by মশিউল আলম
গাবতলী থেকে গুলিস্তান যাবে বলে যাত্রী নিয়ে একটি বাস ফার্মগেটে এসে থেমে গেল। বাসটির চালক ও তাঁর সহযোগী যাত্রীদের উদ্দেশে সমস্বরে বলে উঠল, ‘নামেন নামেন, বাস আর যাইব না।’ যাত্রীদের মধ্য থেকে একজন রাগী স্বরে জানতে চাইল, ‘কেন যাবে না?’
‘সামনে রিস্কের ব্যাপার,’ বাসের কন্ডাক্টর বোঝাতে লাগলেন ওই যাত্রীকে। আশপাশে দাঁড়ানো আরও কয়েকটি বাস দেখিয়ে তিনি যাত্রীকে বললেন, ‘ওই যে দেখেন, গুলিস্তানের দিকে কুনো বাসই যাইতাছে না।’
পল্টন-গুলিস্তান, অর্থাৎ রাজধানীর কেন্দ্রীয় এলাকায় প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়; হরতাল, অবরোধ, সমাবেশসহ যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র এবং সে-কারণে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনাগুলো ওই এলাকা বা তার আশপাশেই ঘটে বেশি। হরতালের দিনে যাত্রীসুদ্ধ বাস নিয়ে সেদিকে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে বাসগুলোর ড্রাইভার-কন্ডাক্টররা সচেতন ও সাবধানী। সব যাত্রী নেমে গেলে বাসটির তরুণ চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গুলিস্তানের দিকে কোনো গণ্ডগোলের খবর কি আপনারা পেয়েছেন?’ তাঁর উত্তর, ‘না। কিন্তু রিস্ক লইতে চাই না।’
তার আগে, সকাল সাড়ে নটার দিকে শ্যামলীতে এক দোকানের একটি বাদে সব ঝাঁপ বন্ধ দেখে এগিয়ে গিয়ে দোকানের কর্মীদের জিজ্ঞাসা করি, হরতাল বলে তাঁদের এই সাবধানী ব্যবস্থা কি না। উত্তরে এক কর্মী বললেন, ‘বহুত দিন পর হরতাল দিছে না? কী হয় না হয়!’
রিকশাচালকেরা যাত্রী নিয়ে দূরের গন্তব্যে যেতে রাজি হচ্ছেন না। রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েকজন রাস্তার পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাঁদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আপনারা কি হরতাল করছেন?’ একজন বললেন, ‘না, ভয়ে ভয়ে আছি। এত পুলিশ-র্যাব দেইখ্যা মনে হয় গণ্ডগোল হইতে পারে।’ আরেকজন বললেন, ‘ধরেন, একখান ইটা আইসা ঘাড়ে পড়ল, বা ধরেন, আপনারে বাড়ি লাগাইল, চিন্তার বিষয় আছে না?’
শ্যামলী সিনেমা হলের মোড় ও আশপাশ এলাকায় অধিকাংশ দোকান বন্ধ, মিরপুর রোডে বাস, ট্যাক্সি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিরল। মানুষ হেঁটে বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে। মোড়ে পুলিশ ও র্যাবের সদস্যদের জটলা। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা শুরু করি। হরতালে জনগণের সাড়া কেমন দেখছেন? আমার এ প্রশ্নের উত্তরে একজন মৃদু হেসে বললেন, ‘ডাক দিলেই তো হরতাল হয়ে যায়। আর কিছু করা লাগে না।’ বললাম, ‘রাস্তায় আপনাদের সংখ্যা বেশি দেখতে পেলে তো মানুষ ভাবে, গণ্ডগোল হতে পারে।’ পুলিশ সদস্যের উত্তর, ‘স্বাভাবিক, গণ্ডগোল তো হইতেই পারে। হরতাল মানেই গণ্ডগোলের সম্ভাবনা।’
‘সব হরতালের ক্ষেত্রেই তো এমন কথা বলা যায়। আজকের হরতাল কিন্তু বেশ টাইট মনে হচ্ছে।’—আমার মন্তব্যে পুলিশের সদস্য বললেন, ‘অনেক দিন হরতাল ছিল না। মানুষ বুঝতে পারতেছে না, ঘর থেকে বারাইব, না ঘরেই থাকা নিরাপদ। দোকানপাট খুলতেও দোনোমনা করতেছে। সবার মনেই ভয়।’
সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা পৌনে ১১টা পর্যন্ত আদাবর, রিং রোড, শ্যামলী সিনেমা হলের মোড়, সেখান থেকে হেঁটে মিরপুর রোড ধরে কলেজ গেট হয়ে আসাদ গেট পর্যন্ত যেতে যেতে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি হরতাল প্রসঙ্গে। আসাদ গেটে গুলিস্তানগামী একটি বাসে উঠে ফার্মগেটে নামতে বাধ্য হয়েছি। কারণ বাসটির চালক ও কন্ডাক্টর আর কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার সাহস করেননি। ফার্মগেটে অনেক মানুষ, প্রত্যেককেই ঘর থেকে বেরোতে হয়েছে কোনো না-কোনো জরুরি কাজে। তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, একান্তই জরুরি না হলে তাঁরা হরতালের মধ্যে ঘর থেকে বের হতেন না। যেমন, কল্যাণপুর থেকে আসা এক যুবক বললেন, তাঁকে যেতে হবে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে। কিন্তু বাস ফার্মগেটের পর আর শাহবাগের দিকে যাচ্ছে না বলে তিনি হেঁটেই রওনা হয়েছেন শাহবাগের উদ্দেশে। বাসায় স্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, দুপুরের পর হরতাল একটু শিথিল হলে তিনি যেন বের হন। কিন্তু তবুও তিনি বেরিয়েছেন: ঝুঁকি নিয়ে।
বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও বয়সের যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, সবাই প্রকাশ করেছেন অজানা আশঙ্কা ও ভীতির কথা। প্রত্যেকেই ঘর থেকে বের হয়েছেন মনের মধ্যে একটা ঝুঁকির বোধ নিয়ে। বিএনপির এই হরতালের ইস্যু কী, কেন তারা হরতাল ডেকেছে, তা বলতে পারলেন না একজনও। দুপুরের একটু পরই বার্তা সংস্থার খবরে জানা গেল, বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন দাবি করেছেন, সারা দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করছে। সোমবারের সংবাদমাধ্যমে হয়তো দেখা যাবে, বিএনপির নেত্রী হরতাল সফল করার জন্য দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে—বিষয়টি বোধ হয় পুরোপুরি এ রকম নয়। আসলে জনজীবনে স্বাভাবিক ছন্দের যে পতন দেখা গেছে, তার কারণ একটা সাধারণ ভীতি, অজানা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার বোধ। হরতালে মানুষের মনে কাজ করে নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ, কী হয় না-হয়—এমন শঙ্কা।
জনগণকে এই শঙ্কার মধ্যে ফেলার অধিকার কি কারোর আছে? হরতালের ডাক দিলেই জনমনে যে ভীতি ও অজানা আশঙ্কার সঞ্চার ঘটে, তার ফলে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতালের বৈধতা প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। যে কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার বিপন্নতার মুখে পড়ে, নিরাপদে চলাফেরা ও জীবিকা অর্জনের পথে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়, তেমন কর্মসূচি সম্পর্কে গুরুতর পুনর্বিবেচনা আশু কর্তব্য হয়ে উঠেছে। সংসদে ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে হরতালের মতো জবরদস্তিমূলক, নাগরিক অধিকার খর্বকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, সে বিষয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
ঢাকা, ২৭ জুন ২০১০
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
পল্টন-গুলিস্তান, অর্থাৎ রাজধানীর কেন্দ্রীয় এলাকায় প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়; হরতাল, অবরোধ, সমাবেশসহ যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র এবং সে-কারণে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনাগুলো ওই এলাকা বা তার আশপাশেই ঘটে বেশি। হরতালের দিনে যাত্রীসুদ্ধ বাস নিয়ে সেদিকে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে বাসগুলোর ড্রাইভার-কন্ডাক্টররা সচেতন ও সাবধানী। সব যাত্রী নেমে গেলে বাসটির তরুণ চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গুলিস্তানের দিকে কোনো গণ্ডগোলের খবর কি আপনারা পেয়েছেন?’ তাঁর উত্তর, ‘না। কিন্তু রিস্ক লইতে চাই না।’
তার আগে, সকাল সাড়ে নটার দিকে শ্যামলীতে এক দোকানের একটি বাদে সব ঝাঁপ বন্ধ দেখে এগিয়ে গিয়ে দোকানের কর্মীদের জিজ্ঞাসা করি, হরতাল বলে তাঁদের এই সাবধানী ব্যবস্থা কি না। উত্তরে এক কর্মী বললেন, ‘বহুত দিন পর হরতাল দিছে না? কী হয় না হয়!’
রিকশাচালকেরা যাত্রী নিয়ে দূরের গন্তব্যে যেতে রাজি হচ্ছেন না। রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েকজন রাস্তার পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাঁদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আপনারা কি হরতাল করছেন?’ একজন বললেন, ‘না, ভয়ে ভয়ে আছি। এত পুলিশ-র্যাব দেইখ্যা মনে হয় গণ্ডগোল হইতে পারে।’ আরেকজন বললেন, ‘ধরেন, একখান ইটা আইসা ঘাড়ে পড়ল, বা ধরেন, আপনারে বাড়ি লাগাইল, চিন্তার বিষয় আছে না?’
শ্যামলী সিনেমা হলের মোড় ও আশপাশ এলাকায় অধিকাংশ দোকান বন্ধ, মিরপুর রোডে বাস, ট্যাক্সি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিরল। মানুষ হেঁটে বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে। মোড়ে পুলিশ ও র্যাবের সদস্যদের জটলা। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা শুরু করি। হরতালে জনগণের সাড়া কেমন দেখছেন? আমার এ প্রশ্নের উত্তরে একজন মৃদু হেসে বললেন, ‘ডাক দিলেই তো হরতাল হয়ে যায়। আর কিছু করা লাগে না।’ বললাম, ‘রাস্তায় আপনাদের সংখ্যা বেশি দেখতে পেলে তো মানুষ ভাবে, গণ্ডগোল হতে পারে।’ পুলিশ সদস্যের উত্তর, ‘স্বাভাবিক, গণ্ডগোল তো হইতেই পারে। হরতাল মানেই গণ্ডগোলের সম্ভাবনা।’
‘সব হরতালের ক্ষেত্রেই তো এমন কথা বলা যায়। আজকের হরতাল কিন্তু বেশ টাইট মনে হচ্ছে।’—আমার মন্তব্যে পুলিশের সদস্য বললেন, ‘অনেক দিন হরতাল ছিল না। মানুষ বুঝতে পারতেছে না, ঘর থেকে বারাইব, না ঘরেই থাকা নিরাপদ। দোকানপাট খুলতেও দোনোমনা করতেছে। সবার মনেই ভয়।’
সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা পৌনে ১১টা পর্যন্ত আদাবর, রিং রোড, শ্যামলী সিনেমা হলের মোড়, সেখান থেকে হেঁটে মিরপুর রোড ধরে কলেজ গেট হয়ে আসাদ গেট পর্যন্ত যেতে যেতে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি হরতাল প্রসঙ্গে। আসাদ গেটে গুলিস্তানগামী একটি বাসে উঠে ফার্মগেটে নামতে বাধ্য হয়েছি। কারণ বাসটির চালক ও কন্ডাক্টর আর কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার সাহস করেননি। ফার্মগেটে অনেক মানুষ, প্রত্যেককেই ঘর থেকে বেরোতে হয়েছে কোনো না-কোনো জরুরি কাজে। তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, একান্তই জরুরি না হলে তাঁরা হরতালের মধ্যে ঘর থেকে বের হতেন না। যেমন, কল্যাণপুর থেকে আসা এক যুবক বললেন, তাঁকে যেতে হবে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে। কিন্তু বাস ফার্মগেটের পর আর শাহবাগের দিকে যাচ্ছে না বলে তিনি হেঁটেই রওনা হয়েছেন শাহবাগের উদ্দেশে। বাসায় স্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, দুপুরের পর হরতাল একটু শিথিল হলে তিনি যেন বের হন। কিন্তু তবুও তিনি বেরিয়েছেন: ঝুঁকি নিয়ে।
বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও বয়সের যত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, সবাই প্রকাশ করেছেন অজানা আশঙ্কা ও ভীতির কথা। প্রত্যেকেই ঘর থেকে বের হয়েছেন মনের মধ্যে একটা ঝুঁকির বোধ নিয়ে। বিএনপির এই হরতালের ইস্যু কী, কেন তারা হরতাল ডেকেছে, তা বলতে পারলেন না একজনও। দুপুরের একটু পরই বার্তা সংস্থার খবরে জানা গেল, বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন দাবি করেছেন, সারা দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করছে। সোমবারের সংবাদমাধ্যমে হয়তো দেখা যাবে, বিএনপির নেত্রী হরতাল সফল করার জন্য দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে—বিষয়টি বোধ হয় পুরোপুরি এ রকম নয়। আসলে জনজীবনে স্বাভাবিক ছন্দের যে পতন দেখা গেছে, তার কারণ একটা সাধারণ ভীতি, অজানা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার বোধ। হরতালে মানুষের মনে কাজ করে নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ, কী হয় না-হয়—এমন শঙ্কা।
জনগণকে এই শঙ্কার মধ্যে ফেলার অধিকার কি কারোর আছে? হরতালের ডাক দিলেই জনমনে যে ভীতি ও অজানা আশঙ্কার সঞ্চার ঘটে, তার ফলে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতালের বৈধতা প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। যে কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার বিপন্নতার মুখে পড়ে, নিরাপদে চলাফেরা ও জীবিকা অর্জনের পথে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়, তেমন কর্মসূচি সম্পর্কে গুরুতর পুনর্বিবেচনা আশু কর্তব্য হয়ে উঠেছে। সংসদে ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে হরতালের মতো জবরদস্তিমূলক, নাগরিক অধিকার খর্বকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, সে বিষয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
ঢাকা, ২৭ জুন ২০১০
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments