চারদিক-একখণ্ড হীরা! by অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত
শুক্রবার, ৪ মে। দিনটা এত ভালো যাবে ভাবিনি। নিত্যদিনের মতো পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে প্রত্যুষের প্রার্থনাসহ সব কাজ সেরে কিছুটা নৈতিক দায়িত্ব, কিছুটা রুজি-রোজগারের ধান্ধায় গ্রিন লাইফ হাসপাতালে আসি। মিতি আপাকে বলেছিলাম সকাল আটটায় অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতে।
যথাসময়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পেলাম, তিনি দরজার বাইরে অপেক্ষমাণ। তাঁকে সার্জনদের ঘরে বসালাম।
তারপর হাতের কাজ আর প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কেন আর কোথায়, সে বৃত্তান্ত বলি।
আগের দিন মিতি আপা ফোনে একজন রোগী সম্পর্কে পরামর্শ চেয়েছিলেন। পরিচয় জেনে বলি, তাঁকে আমি বাসায় গিয়ে দেখতে চাই। আপা বললেন, ‘উনি তো উত্তরায় থাকেন, আপনি এত দূর যাবেন?’ উত্তরা যেতে যেন ভিসা-টিকিট লাগবে! যাঁর জন্য উত্তরায় যাওয়া, তিনি নাদেরা খালা—নাদেরা বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে মেজভাই শহীদ মুনীর চৌধুরীর পথ ধরে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খেটেছিলেন। তাঁর স্বামী প্রয়াত গোলাম কিবরিয়া সাবেক অর্থসচিব ও মহাহিসাব নিরীক্ষক।
কিবরিয়া স্যারকে আমি প্রথম দেখি আজ থেকে ২০ বছর আগে। তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল আমিন স্যারকে দেখাতে এসেছিলেন। আমি তখন আমিন স্যারের অধীনে সহযোগী অধ্যাপকের চলতি দায়িত্বে কাজ করি। স্যার কোনো রোগী দেখলে ব্যবস্থাপত্র লেখার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপর, হয়তো আমার পরিষ্কার হাতের লেখার জন্যই।
সেদিন কিবরিয়া স্যার যখন আসেন, নুরুল আমিন স্যারের ওখানে ছিলেন আহমেদ আমিন ভাই, অধ্যাপক আহসান উল্লাহ স্যারসহ আরও দু-একজন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে জোর আলোচনা চলছিল। আমি আর আহমেদ আমিন ভাই শুধুই শ্রোতা। কিবরিয়া স্যারও নীরবেই শুনছিলেন। ওঠার সময় দুই বাক্যে উনি যা বললেন, তাতেই দেড় ঘণ্টার আলোচনার সমাপ্তি হয়ে গেল। তাঁর বাক্যে তিনটা শব্দ ছিল—এক. অস্থিরতা (সামাজিক ও আন্তর্জাতিক), দুই. প্রাপ্তি (ব্যক্তি পর্যায়ে, এবং যেকোনো প্রাপ্তিতে অসন্তুষ্টি), তিন. ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা, জ্ঞানী হওয়ার নয়।
বের হয়ে আমিন ভাই বলেছিলেন, এটাই ডাক্তার আর প্রকৃত আমলার মধ্যে পার্থক্য। আমার মাথা নত করার মতো ব্যক্তিত্ব। সে রকম আরেকজন জ্ঞানী লোকের দেখা পেয়েছিলাম একই স্থানে—সিএসপি এ কে এম আহসান সাহেব, পটিয়ায় বাড়ি। যখনই কথা বলতেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি।
কিবরিয়া স্যারকে আমি রোগী হিসেবেও অনেকবার দেখেছি। কোনো মানুষ যে এত বিনম্র হতে পারেন, তা যাঁরা তাঁর সঙ্গে মেশেননি, তাঁরা ধারণাও করতে পারবেন না। আমি এখনো তাঁর বিদেহী আত্মার কাছে প্রার্থনা করছি, তাঁর কিছু গুণাবলি যদি আমাকে দেন!
নাদেরা খালাকে দেখতে চিকিৎসক হিসেবে অনেকবার তাঁদের ওয়ারীর বাসায় গিয়েছি। কিবরিয়া স্যারও অনেকবার তাঁর ভালোবাসার এই প্রিয় মানুষটাকে আমার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বা গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। আসার আগে টেলিফোনে শুধু বলতেন—লিফট আছে কি না, নাদেরা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে না এবং হুইলচেয়ার থাকলে ভালো হয়। যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। এ রকম পণ্ডিত ব্যক্তিদের সেবা করার সৌভাগ্য কম লোকেরই হয়।
আজ নাদেরা খালা তাঁর হাতে লেখা একটা কাগজ দেখালেন। যার সার কথা হলো, ‘আমি আর কোনো হাসপাতালে যাব না। হোমিওপ্যাথি বা হারবাল ওষুধ খাব। তবে আপনার দেওয়া ওষুধ অবশ্যই খাব।’
কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘কিবরিয়া সংসারের কাজ তেমন দেখত না। তবে আমি যদি কোনো কলম বা বই চাইতাম তাহলে দুনিয়ার যেখান থেকে হোক তা এনে দিত।’ সুহূদ স্বামী চলে গেছেন ৮২ বছর বয়সে। বয়সে সামান্য বড় জীবনসঙ্গিনী এখন একা। শুনলাম, মুনীর চৌধুরীর ওপর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন।
কিবরিয়া স্যার জীবনসায়াহ্নে এসে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। খবর পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। বিএসএমএমইউর প্যালিয়েটিভ কেয়ার শাখাতেও ছিলেন কয়েক দিন। তারপর ঘরে ফিরে গত আগস্টে নিঃশব্দে চলে গেলেন। তাঁর আদর্শটা আমি লালন করতে চাই।
আমাকে চিকিৎসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য এই পরিবারের কাছে আমি ঋণী। ঋণী আমি আমার সব রোগীর কাছেই। হাসপাতাল হলো আমার মন্দির এবং রোগী আমার দেবতা। দেবতার পূজা করার সুযোগ পাওয়াটাই বড় প্রাপ্তি।
দুই হাতের চেয়েও লম্বা হীরকখণ্ডটির কথা বলা হলো না। পৃথিবীতে যত হীরার টুকরা আছে, তার সবগুলোর চেয়ে দীর্ঘ ও মূল্যবান এই হীরকখণ্ড। আটটি লোহার শিকে কাপড়ের ঘেরাটোপে গড়া হীরকখণ্ডটি একটি অভিনব খাপে বন্দী। এ ছাতা কিবরিয়া স্যার সব সময় ব্যবহার করতেন। নাদেরা খালা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এটা আমি আপনাকে দিলাম।’ আমি আপত্তি করেছিলাম, আবার স্যারের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য একটি সামগ্রী নিজের কাছে রাখতে লোভও হচ্ছিল।
ঘরে ফিরে স্ত্রীকে সব খুলে বলতে সে ঝোলানোর একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখানে রেখে দাও। খবরদার, কাউকে দিয়ে দিও না! ব্যবহার করেও নষ্ট কোরো না।’ এমন সময় আমার তিন বছরের নাতনি বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু লাগ পাই!’
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত
উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
তারপর হাতের কাজ আর প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কেন আর কোথায়, সে বৃত্তান্ত বলি।
আগের দিন মিতি আপা ফোনে একজন রোগী সম্পর্কে পরামর্শ চেয়েছিলেন। পরিচয় জেনে বলি, তাঁকে আমি বাসায় গিয়ে দেখতে চাই। আপা বললেন, ‘উনি তো উত্তরায় থাকেন, আপনি এত দূর যাবেন?’ উত্তরা যেতে যেন ভিসা-টিকিট লাগবে! যাঁর জন্য উত্তরায় যাওয়া, তিনি নাদেরা খালা—নাদেরা বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে মেজভাই শহীদ মুনীর চৌধুরীর পথ ধরে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খেটেছিলেন। তাঁর স্বামী প্রয়াত গোলাম কিবরিয়া সাবেক অর্থসচিব ও মহাহিসাব নিরীক্ষক।
কিবরিয়া স্যারকে আমি প্রথম দেখি আজ থেকে ২০ বছর আগে। তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল আমিন স্যারকে দেখাতে এসেছিলেন। আমি তখন আমিন স্যারের অধীনে সহযোগী অধ্যাপকের চলতি দায়িত্বে কাজ করি। স্যার কোনো রোগী দেখলে ব্যবস্থাপত্র লেখার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপর, হয়তো আমার পরিষ্কার হাতের লেখার জন্যই।
সেদিন কিবরিয়া স্যার যখন আসেন, নুরুল আমিন স্যারের ওখানে ছিলেন আহমেদ আমিন ভাই, অধ্যাপক আহসান উল্লাহ স্যারসহ আরও দু-একজন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে জোর আলোচনা চলছিল। আমি আর আহমেদ আমিন ভাই শুধুই শ্রোতা। কিবরিয়া স্যারও নীরবেই শুনছিলেন। ওঠার সময় দুই বাক্যে উনি যা বললেন, তাতেই দেড় ঘণ্টার আলোচনার সমাপ্তি হয়ে গেল। তাঁর বাক্যে তিনটা শব্দ ছিল—এক. অস্থিরতা (সামাজিক ও আন্তর্জাতিক), দুই. প্রাপ্তি (ব্যক্তি পর্যায়ে, এবং যেকোনো প্রাপ্তিতে অসন্তুষ্টি), তিন. ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা, জ্ঞানী হওয়ার নয়।
বের হয়ে আমিন ভাই বলেছিলেন, এটাই ডাক্তার আর প্রকৃত আমলার মধ্যে পার্থক্য। আমার মাথা নত করার মতো ব্যক্তিত্ব। সে রকম আরেকজন জ্ঞানী লোকের দেখা পেয়েছিলাম একই স্থানে—সিএসপি এ কে এম আহসান সাহেব, পটিয়ায় বাড়ি। যখনই কথা বলতেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি।
কিবরিয়া স্যারকে আমি রোগী হিসেবেও অনেকবার দেখেছি। কোনো মানুষ যে এত বিনম্র হতে পারেন, তা যাঁরা তাঁর সঙ্গে মেশেননি, তাঁরা ধারণাও করতে পারবেন না। আমি এখনো তাঁর বিদেহী আত্মার কাছে প্রার্থনা করছি, তাঁর কিছু গুণাবলি যদি আমাকে দেন!
নাদেরা খালাকে দেখতে চিকিৎসক হিসেবে অনেকবার তাঁদের ওয়ারীর বাসায় গিয়েছি। কিবরিয়া স্যারও অনেকবার তাঁর ভালোবাসার এই প্রিয় মানুষটাকে আমার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বা গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। আসার আগে টেলিফোনে শুধু বলতেন—লিফট আছে কি না, নাদেরা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে না এবং হুইলচেয়ার থাকলে ভালো হয়। যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। এ রকম পণ্ডিত ব্যক্তিদের সেবা করার সৌভাগ্য কম লোকেরই হয়।
আজ নাদেরা খালা তাঁর হাতে লেখা একটা কাগজ দেখালেন। যার সার কথা হলো, ‘আমি আর কোনো হাসপাতালে যাব না। হোমিওপ্যাথি বা হারবাল ওষুধ খাব। তবে আপনার দেওয়া ওষুধ অবশ্যই খাব।’
কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘কিবরিয়া সংসারের কাজ তেমন দেখত না। তবে আমি যদি কোনো কলম বা বই চাইতাম তাহলে দুনিয়ার যেখান থেকে হোক তা এনে দিত।’ সুহূদ স্বামী চলে গেছেন ৮২ বছর বয়সে। বয়সে সামান্য বড় জীবনসঙ্গিনী এখন একা। শুনলাম, মুনীর চৌধুরীর ওপর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন।
কিবরিয়া স্যার জীবনসায়াহ্নে এসে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। খবর পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। বিএসএমএমইউর প্যালিয়েটিভ কেয়ার শাখাতেও ছিলেন কয়েক দিন। তারপর ঘরে ফিরে গত আগস্টে নিঃশব্দে চলে গেলেন। তাঁর আদর্শটা আমি লালন করতে চাই।
আমাকে চিকিৎসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য এই পরিবারের কাছে আমি ঋণী। ঋণী আমি আমার সব রোগীর কাছেই। হাসপাতাল হলো আমার মন্দির এবং রোগী আমার দেবতা। দেবতার পূজা করার সুযোগ পাওয়াটাই বড় প্রাপ্তি।
দুই হাতের চেয়েও লম্বা হীরকখণ্ডটির কথা বলা হলো না। পৃথিবীতে যত হীরার টুকরা আছে, তার সবগুলোর চেয়ে দীর্ঘ ও মূল্যবান এই হীরকখণ্ড। আটটি লোহার শিকে কাপড়ের ঘেরাটোপে গড়া হীরকখণ্ডটি একটি অভিনব খাপে বন্দী। এ ছাতা কিবরিয়া স্যার সব সময় ব্যবহার করতেন। নাদেরা খালা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এটা আমি আপনাকে দিলাম।’ আমি আপত্তি করেছিলাম, আবার স্যারের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য একটি সামগ্রী নিজের কাছে রাখতে লোভও হচ্ছিল।
ঘরে ফিরে স্ত্রীকে সব খুলে বলতে সে ঝোলানোর একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখানে রেখে দাও। খবরদার, কাউকে দিয়ে দিও না! ব্যবহার করেও নষ্ট কোরো না।’ এমন সময় আমার তিন বছরের নাতনি বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু লাগ পাই!’
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত
উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
No comments