চট্টগ্রামের নির্বাচন-মাঠের বার্তা কি আওয়ামী লীগ শুনতে পায়? by মনজুরুল আহসান বুলবুল

সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ঘটনাটি ঘটল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল শেষে এই নির্বাচনের নানা সমীকরণ এখন চলছে। বলতে দ্বিধা নেই, এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে অনেকে, শিক্ষার অনেক উপাদানও উঠে এসেছে।


প্রথমেই বলা যায়, এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বীর চট্টলাবাসী। তারা সফল একটি নির্বাচনে বেছে নিয়েছে তাদের নগরপিতাকে। এই নির্বাচনে নিশ্চয়ই জয়ী হয়েছে নির্বাচন কমিশন। শুরু থেকে পেশাদারির সঙ্গে তারা সব কিছু করেছে, নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন হলেই তৎপর হয়েছে, কাউকে ছাড় দেয়নি। নির্বাচন কমিশনের এই সাফল্যে বিএনপি বা বেগম খালেদা জিয়া একটু সমস্যায় পড়েছেন, কারণ তাঁরা এখন আর এ কথাটি জোর গলায় বলতে পারছেন না যে, এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ভিন্ন একটি উদ্যোগেও সফল হয়েছে কমিশন। প্রথমবারের মতো দেশের কোনো নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) দিয়ে সফলভাবে ভোট নিয়েছে একটি ওয়ার্ডে। এর মধ্য দিয়ে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি প্রবর্তনের ইতিহাসে অংশীদার হয়ে রইল চট্টগ্রাম। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকার ও সব রাজনৈতিক দল সহায়তা দিলে আমাদের নির্বাচন কমিশন প্রায় শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে যেকোনো নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে। এই নির্বাচনে সরকারি দলের সমর্থক-প্রার্থী পরাজিত হলেও জয়ী হয়েছে সরকার। তারা কোনো পর্যায়েই নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনি। সরকারি দলের নেতারা প্রচারণায় অংশ নিলেও তাঁরা নির্বাচন কমিশনের বিধি লঙ্ঘন করেননি, করলেও নত হয়েছেন কমিশনের সতর্কতা নোটিশের কাছে। সরকারের এই জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিজয়ী মেয়রকে প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন। ফলাফল ঘোষণার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অভিনন্দনবার্তা নিঃসন্দেহে আমাদের রাজনীতির ইতিবাচক সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও। চট্টগ্রামে তাঁর দলের যে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব, মন্জুর আলমকে মনোনয়ন দিয়ে তিনি তা সামাল দিয়েছেন। খালেদা জিয়া এই বার্তাটি চট্টগ্রামের প্রভাবশালী নেতাদের দিতে পেরেছেন যে তিনি বিকল্প বাছাইয়ে সাহসী হতে পারেন। এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা। কেউ কাউকে ছাড় না দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার হাতে চমৎকার এক বিকল্প দিয়েছেন মন্জুর আলমকে সামনে এনে।
সেই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জয়ও কম নয়। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে একঘরে হয়ে পড়া জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিয়ে কুপোকাত করে ফেলেছিল বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে। বিএনপি জামায়াতের এই চাল ধরতেই পারেনি। সহজ অঙ্কের সমীকরণ কষে জামায়ত দলীয় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়েছে। দুঃসময়ে বিএনপিকে পাশে পেয়ে জামায়াত নিশ্চয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
অন্যদিকে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী নেতা ও শুভানুধ্যায়ী। দেশে এখন শিক্ষা দেওয়ার রাজনীতি চলছে। এই নেতারা সফলভাবে বিদায়ী মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে শিক্ষা দিয়ে নিজেরা জয়ী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এই নেতাদের ঢাকায় ডেকেছেন, কথা শুনেছেন-বলেছেন। নির্বাচনী ফলাফল বলছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ও কথা মেনে নিয়েছেন, কিন্তু মনে নিতে পারেননি। বলা যায়, মহিউদ্দিন চৌধুরীর অপমানের মধুর প্রতিশোধ।
অবশ্যই এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন সজ্জন মানুষ মন্জুর আলম। এত বড় জয়ের পরও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক বিএনপির নানামুখী চাপ তাঁকে দৃঢ় পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কতটা শক্ত ভিত দেয়, তা দেখার জন্য নিশ্চয়ই সবাই অপেক্ষা করবেন।
তবে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন ব্যক্তি মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ। তাঁর এই পরাজয় আওয়ামী লীগের জন্য শিক্ষা নেওয়ার অনেকগুলো পাতা খোলে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের এ থেকে পাঠ নিতে হবে, যদি তাঁরা সামনে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হতে চান। সরকারের মধ্য মেয়াদে এই শিক্ষা তাঁদের আগামী পরিকল্পনার জন্যও সহায়ক হতে পারে।

মাঠের বার্তা শুনতে কি পাও?
এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের কাছে একটিই জিজ্ঞাসা। মাঠের বার্তা শুনতে কি পাও?
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ অন্য বেশ কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে হার হয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হলো চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন। এটি অনেক বড় ধাক্কা।
ভিন্ন এক প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সরকারের চিত্র এঁকেছেন এভাবে:
প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সূর্য। তাঁকে ঘিরে থাকবে গ্রহ, উপগ্রহ। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরেই ঘুরপাক খাবেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথা এবং পরামর্শ শুনবেন। পত্রপত্রিকায় যাঁরা লিখবেন তাঁরা গ্রহ-উপগ্রহের বাইরে। কে শুনবে তাঁদের কথা?
এই চিত্রকল্পের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ না করেও শুধু বলতে চাই, সব আমলেই সরকারকে ঘিরে থাকে এমন নানা ধরনের গ্রহ-উপগ্রহ। গণতান্ত্রিক, উর্দি পরা, পেছনে উর্দি, সামনে বেসামরিক এমনকি তত্ত্বাবধায়ক—কোনো সরকারই এই ঘূর্ণাবর্তের বাইরে নয়।
একটি দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তাকে ঘিরে যে বলয় তৈরি হয় তার থাকে তিনটি স্তর। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়, তাদেরও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী হওয়ার সুযোগ নেই।
সরকারকে ঘিরে রাখা তিন স্তরের মধ্যে প্রথম স্তরে অবস্থান যাদের তারা হলো প্রাপ্তিতে বিভোর একটি গ্রুপ। নিজ দল ক্ষমতায়, তাই যোগ্যতা বা চাওয়ার চেয়ে অতিরিক্ত প্রাপ্তি। এই শ্রেণীর লোকেরা ডানে-বাঁয়ে তাকাবে না, মন্দ কিছু দেখবে না, সমালোচনা সহ্য করবে না, সমালোচনাও করবে না—পাছে প্রাপ্তির রশিটি ছিঁড়ে যায়।
বলয়ের দ্বিতীয় স্তরে অবস্থান যাদের তাদের বলা যায়, প্রত্যাশায় ঘুরঘুর। নিজ দল ক্ষমতায়, এখনো কিছু মেলেনি কিন্তু আশাও ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে না, যদি কিছু মেলে। কিছুটা হতাশা থাকলেও প্রত্যাশা নিয়ে সরকারের পিছু পিছু ঘুরঘুর করা এদের মূল আচরণ প্রথম গোষ্ঠীর মতোই। তবে এখনো কিছু না পেয়ে মাঝেমধ্যে উচ্চকণ্ঠ হয় এরা নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য।
বলয়ের তৃতীয় প্রান্তে অবস্থান যাদের তারা হলো: হতাশায় বহুদূর। এই গোষ্ঠীর মধ্যে একাংশ হচ্ছে, যারা কিছু না পেয়ে হতাশ। প্রাপ্তির কোনো আশাই নেই, কাজেই দলের সমালোচনায় মুখর এরা। এই গ্রুপের অপর অংশ হচ্ছে যারা আদর্শিকভাবে চায় সরকার বা দল ভালোভাবে চলুক, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে, কাজে তার প্রতিফলন ঘটুক, সরকার তার ঘোষিত রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী দেশটিকে স্বচ্ছভাবে নেতৃত্ব দিক। এই গোষ্ঠীটি কোনো ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে নয়, বরং তাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন না দেখে হতাশ এবং নিষ্ক্রিয়।
এত কথা বলার কারণ একটিই, আওয়ামী লীগ জাতিকে ২০২১ সালের স্বপ্ন দেখিয়েছে। ২০২০ সালে জাতি পালন করবে জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী। ২০১০ সালে ক্ষমতার দুই বছরেই যদি আওয়ামী লীগ মাঠের বার্তা শুনতে ভুল করে, তা হলে স্বপ্ন দেখানো ২০২১ সাল আসবে, ভিশন ২০২১ও হয়তো থাকবে, কিন্তু এই ভিশনের সহযাত্রীরা দিনাতিপাত করবেন স্বপ্নের অপূর্ণতার কষ্ট নিয়ে।
চট্টগ্রামের জয়-পরাজয়ের সমীকরণটি সবাইকে সচেতন করুক।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: প্রধান সম্পাদক, বৈশাখী টেলিভিশন।
bulbulahsan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.