স্বাস্থ্যসেবা-দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি এতই খারাপ? by ফরিদা আখতার
খবরটি ছোট, কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর অর্থ বড়। পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে তৃতীয় পৃষ্ঠায় এক কলামে। ছবি না থাকলে হয়তো চোখেই পড়ত না। রাষ্ট্রপতি স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য লন্ডনে গেছেন ১৯ জুন। লন্ডনের বুপা ক্রমওয়েল হাসপাতালে তাঁর মেডিকেল চেকআপ হবে।
কী রোগ তা লেখা হয়নি, তবে চেকআপ মানে সবকিছুই দেখা হবে নিশ্চয়ই। ভালো কথা। এই বয়সে তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্য, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছাড়াও বঙ্গভবনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাঁর সঙ্গে রয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু আমি বাধ্য হচ্ছি দেশের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে কাজ করি বলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে কথা বলতে। দেশের রাষ্ট্রপতির স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার ক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যর্থ হলো কেন? তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার মতো দক্ষতা কি আমাদের চিকিৎসকদের নেই? সাধারণত আমাদের দেশের চিকিৎসকদের দক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, তাঁদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগ হচ্ছে তাঁরা লোকজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। আর রোগী যদি হন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের, তাহলে এখানে গাফিলতিরও কোনো সুযোগ নেই।
এই খবরে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়েছে, কারণ এর মাধ্যমে একটি বার্তা জনগণ পায়, সেটা হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলেরই কোনো আস্থা নেই। কী ভয়ানক কথা! এমন যদি হতো যে রাষ্ট্রপতি অন্য কোনো কাজে লন্ডনে গিয়েছিলেন, সেই ফাঁকে একটু স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাবেন, তাহলে বোধ হয় এত কথা বলতে হতো না। কিন্তু যখন শিরোনাম হয় চিকিৎসার জন্য যাওয়া, তখন একটু চিন্তার বিষয় হয় বৈকি।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থ্যা যথেষ্ট উন্নত নয় জানি, কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা তো আমাদের দিতেই হবে। ধনীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে যখন-তখন, কিন্তু গরিব মানুষের ভরসা তো এই সরকারি হাসপাতাল ও সরকারি চিকিৎসক। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের প্রতি উচ্চপর্যায়ের অনাস্থার কারণে এই খাতকে একটু বিমাতাসুলভ দৃষ্টিতেই দেখা হচ্ছে। তার প্রমাণ হচ্ছে, এবারের বাজেটে (২০১০-১১) স্বাস্থ্য খাতকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে দেখা হয়নি। এখানে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর চেয়েও সরকারের দলীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে বেশি। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে যে বরাদ্দ থাকা দরকার ছিল, তা এখানে নেই। ধনীদের দেখাদেখি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার বেশি দূরে না যেতে পারলেও গরু-ছাগল বিক্রি কিংবা ধার-দেনা করে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় যাচ্ছে। যেসব রোগের জন্য তারা গেছে, তা এখানে চিকিৎসা করা সম্ভব ছিল। কদিন আগে একটি টিভি চ্যানেল বিস্তারিত দেখিয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আট হাজার ১৪৯ টাকা, যা ২০০৯-১০ সালের বরাদ্দের চেয়ে এক হাজার ১৫১ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু এই বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ৬ শতাংশ, গত বাজেটে ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ মোট বাজেটের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। স্বাস্থ্য খাতে এভাবে বরাদ্দের হার কমিয়ে কী করে জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে? মনে হচ্ছে, সরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করতে আগ্রহী নয়। মন্ত্রীরাও বিদেশে চিকিৎসার জন্য চলে যেতে পারেন। এর জন্য সরকারের কোষাগারের অর্থ খরচ করা হয় বিনা বিচারে। দেশের ভেতর চিকিৎসা নিলেও তা বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালেই তাঁরা যাচ্ছেন। ২০ জুন দেখলাম, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে বিএনপির মিছিলে অংশগ্রহণের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। অথচ সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল বা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কাছে ছিল। কেন এই অনাস্থা? এর অর্থ হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবার জন্য আমাদের সরকারের অর্থ খরচ হবে দেশের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে কিংবা বিদেশের হাসপাতালে। সঙ্গে এয়ারলাইনসের ব্যবসা। এই খরচের জন্য বাজেট বরাদ্দ কোন খাত থেকে আসবে? একটু হিসাব করলেই দেখা যাবে, এই বিপুল অর্থ দিয়ে দেশের চিকিৎসাসেবা আরও উন্নত করা যেত।
এ দেশের মানুষকে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি হিসেবে ১৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করে তা চালু করার প্রস্তাব বাজেটে রয়েছে। তা ছাড়া উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে যথাক্রমে ৫০ ও ২৫০ শয্যাসংখ্যায় উন্নীত করার পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ করার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। স্বাস্থ্য আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করে আমরা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছি যে স্বাস্থ্য বাজেট নির্মাণের দিকে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে, সেবা প্রদান এখনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। হাজারটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করলেও যদি সেবার মান উন্নত করা না হয়, তাহলে এগুলো গ্রামের শৌখিন ক্লাবে পরিণত হবে। আমরা আগেই দেখেছি, উপজেলা পর্যায়ের নির্মাণ তো ঠিকই ছিল, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতালও খুব ভালো। কিন্তু চিকিৎসক থাকে না, ওষুধ পাওয়া যায় না, গরিব মানুষ সেখানে গিয়ে মর্মাহত হয়। শেষ পর্যন্ত মানুষ হাতুড়ে চিকিৎসক কিংবা ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে খায়। তাতে তাদের অনেক ক্ষতি হয়, কিন্তু এই সব বিষয়ে খবর নেওয়ার কেউ নেই।
বাজেট-বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে ছয় হাজার ৩৯১ স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রস্তাবিত বাজেটে আরও ১৪ হাজার স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এডহক ভিত্তিতে চার হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসক ও দুই হাজার ৬২৭ জন নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য একটি করে মোট ১৩ হাজার ৫০০ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে ৪৬ হাজার কর্মী নিয়োগ দিয়ে সরকার তাদের প্রতিটি পরিবারে একজনের কর্মসংস্থানের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু এরই ফাঁকে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন মুনাফাভিত্তিক স্বাস্থ্যবাণিজ্য দিনে দিনে বেড়ে উঠছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ওষুধশিল্পের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ প্রশাসনকে কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেই।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে আমিও প্রশ্ন তুলছি, শুধু নির্মাণকাজ ও নিয়োগ দিয়ে কি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব? স্বাস্থ্য আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন সরকারের কাছে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে এসেছে। বাজেটের আগে সরকারের এসব বিষয়ে কোনো মতবিনিময় করতেও দেখা যায়নি। এমনকি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি সম্পর্কেও কোনো বক্তব্য নেই।
আমাদের একটি গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি অবশ্যই দরকার। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য, এই কথা ভোলা যাবে না। কারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া আমাদের অধিকার।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু আমি বাধ্য হচ্ছি দেশের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে কাজ করি বলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে কথা বলতে। দেশের রাষ্ট্রপতির স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার ক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যর্থ হলো কেন? তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার মতো দক্ষতা কি আমাদের চিকিৎসকদের নেই? সাধারণত আমাদের দেশের চিকিৎসকদের দক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, তাঁদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগ হচ্ছে তাঁরা লোকজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। আর রোগী যদি হন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের, তাহলে এখানে গাফিলতিরও কোনো সুযোগ নেই।
এই খবরে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়েছে, কারণ এর মাধ্যমে একটি বার্তা জনগণ পায়, সেটা হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলেরই কোনো আস্থা নেই। কী ভয়ানক কথা! এমন যদি হতো যে রাষ্ট্রপতি অন্য কোনো কাজে লন্ডনে গিয়েছিলেন, সেই ফাঁকে একটু স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাবেন, তাহলে বোধ হয় এত কথা বলতে হতো না। কিন্তু যখন শিরোনাম হয় চিকিৎসার জন্য যাওয়া, তখন একটু চিন্তার বিষয় হয় বৈকি।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থ্যা যথেষ্ট উন্নত নয় জানি, কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা তো আমাদের দিতেই হবে। ধনীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে যখন-তখন, কিন্তু গরিব মানুষের ভরসা তো এই সরকারি হাসপাতাল ও সরকারি চিকিৎসক। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের প্রতি উচ্চপর্যায়ের অনাস্থার কারণে এই খাতকে একটু বিমাতাসুলভ দৃষ্টিতেই দেখা হচ্ছে। তার প্রমাণ হচ্ছে, এবারের বাজেটে (২০১০-১১) স্বাস্থ্য খাতকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে দেখা হয়নি। এখানে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর চেয়েও সরকারের দলীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে বেশি। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে যে বরাদ্দ থাকা দরকার ছিল, তা এখানে নেই। ধনীদের দেখাদেখি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার বেশি দূরে না যেতে পারলেও গরু-ছাগল বিক্রি কিংবা ধার-দেনা করে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় যাচ্ছে। যেসব রোগের জন্য তারা গেছে, তা এখানে চিকিৎসা করা সম্ভব ছিল। কদিন আগে একটি টিভি চ্যানেল বিস্তারিত দেখিয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আট হাজার ১৪৯ টাকা, যা ২০০৯-১০ সালের বরাদ্দের চেয়ে এক হাজার ১৫১ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু এই বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ৬ শতাংশ, গত বাজেটে ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ মোট বাজেটের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। স্বাস্থ্য খাতে এভাবে বরাদ্দের হার কমিয়ে কী করে জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে? মনে হচ্ছে, সরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করতে আগ্রহী নয়। মন্ত্রীরাও বিদেশে চিকিৎসার জন্য চলে যেতে পারেন। এর জন্য সরকারের কোষাগারের অর্থ খরচ করা হয় বিনা বিচারে। দেশের ভেতর চিকিৎসা নিলেও তা বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালেই তাঁরা যাচ্ছেন। ২০ জুন দেখলাম, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে বিএনপির মিছিলে অংশগ্রহণের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। অথচ সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল বা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কাছে ছিল। কেন এই অনাস্থা? এর অর্থ হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবার জন্য আমাদের সরকারের অর্থ খরচ হবে দেশের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে কিংবা বিদেশের হাসপাতালে। সঙ্গে এয়ারলাইনসের ব্যবসা। এই খরচের জন্য বাজেট বরাদ্দ কোন খাত থেকে আসবে? একটু হিসাব করলেই দেখা যাবে, এই বিপুল অর্থ দিয়ে দেশের চিকিৎসাসেবা আরও উন্নত করা যেত।
এ দেশের মানুষকে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি হিসেবে ১৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করে তা চালু করার প্রস্তাব বাজেটে রয়েছে। তা ছাড়া উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে যথাক্রমে ৫০ ও ২৫০ শয্যাসংখ্যায় উন্নীত করার পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ করার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। স্বাস্থ্য আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করে আমরা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছি যে স্বাস্থ্য বাজেট নির্মাণের দিকে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে, সেবা প্রদান এখনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। হাজারটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করলেও যদি সেবার মান উন্নত করা না হয়, তাহলে এগুলো গ্রামের শৌখিন ক্লাবে পরিণত হবে। আমরা আগেই দেখেছি, উপজেলা পর্যায়ের নির্মাণ তো ঠিকই ছিল, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতালও খুব ভালো। কিন্তু চিকিৎসক থাকে না, ওষুধ পাওয়া যায় না, গরিব মানুষ সেখানে গিয়ে মর্মাহত হয়। শেষ পর্যন্ত মানুষ হাতুড়ে চিকিৎসক কিংবা ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে খায়। তাতে তাদের অনেক ক্ষতি হয়, কিন্তু এই সব বিষয়ে খবর নেওয়ার কেউ নেই।
বাজেট-বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে ছয় হাজার ৩৯১ স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রস্তাবিত বাজেটে আরও ১৪ হাজার স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এডহক ভিত্তিতে চার হাজার ১৩৩ জন চিকিৎসক ও দুই হাজার ৬২৭ জন নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য একটি করে মোট ১৩ হাজার ৫০০ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে ৪৬ হাজার কর্মী নিয়োগ দিয়ে সরকার তাদের প্রতিটি পরিবারে একজনের কর্মসংস্থানের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু এরই ফাঁকে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন মুনাফাভিত্তিক স্বাস্থ্যবাণিজ্য দিনে দিনে বেড়ে উঠছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ওষুধশিল্পের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ প্রশাসনকে কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেই।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে আমিও প্রশ্ন তুলছি, শুধু নির্মাণকাজ ও নিয়োগ দিয়ে কি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব? স্বাস্থ্য আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন সরকারের কাছে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে এসেছে। বাজেটের আগে সরকারের এসব বিষয়ে কোনো মতবিনিময় করতেও দেখা যায়নি। এমনকি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি সম্পর্কেও কোনো বক্তব্য নেই।
আমাদের একটি গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি অবশ্যই দরকার। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য, এই কথা ভোলা যাবে না। কারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া আমাদের অধিকার।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments