শেকড়ের ডাক-সুপেয় পানির সংকট ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ by ফরহাদ মাহমুদ
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে সুপেয় পানির জন্য- শুধু বাংলাদেশে নয়, দুনিয়াজুড়েই কথাটি বহুল প্রচলিত। এর সত্যাসত্য নিরূপণ করা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়, আগত সময়ই এর সঠিক জবাব দিতে পারবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে কি হবে না, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও একটি বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই, আর তা হলো দুনিয়াজোড়াই সুপেয় পানির সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন, সাগরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে এবং মিঠাপানির উৎস ক্রমেই কমছে। মিঠাপানির প্রধান উৎস বৃষ্টির পরিমাণও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
মিঠাপানির উৎস কমে গেলে কী হবে? মিঠাপানির সংকট আরো বাড়বে। মিঠাপানিনির্ভর জীবনচক্র ক্রমে হারিয়ে যাবে। অনেক প্রাণী-প্রজাতিসহ মাটির গুণাগুণ রক্ষাকারী অনুজীবেরাও হারিয়ে যাবে। ফসল বা খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। দুর্ভিক্ষ মানবজাতিকে তাড়িয়ে বেড়াবে। যুদ্ধবিগ্রহ তখন আর অস্বাভাবিক ঘটনা থাকবে না। প্রশ্ন হলো, এ থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? অবশ্যই আছে। একটি হলো স্থায়ী বা টেকসই সমাধান এবং অপরটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক সমাধান। স্থায়ী সমাধানের মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করা, দূষণের মাত্রা কমানো, বনভূমির ধ্বংস রোধ করা এবং প্রকৃতির ওপর অত্যাচারের মাত্রা কমানো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্ব স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটছে না। হাঁটার সদিচ্ছাও দেখাচ্ছে না। পরিত্রাণের জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল উন্নত রাষ্ট্রগুলো সেসব উদ্যোগে যথেষ্ট সাড়া দিচ্ছে না। কিওটো প্রোটোকল বস্তুত তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোয় যতটা না বাগাড়ম্বর হচ্ছে, কার্যকর সমাধানের উদ্যোগ ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। তাৎক্ষণিক সমাধানের অনেক চেষ্টাই উন্নত দেশগুলো করছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, সাগরের পানিকে লবণমুক্ত করে ব্যবহার করা। উন্নত অনেক দেশেই ব্যাপকভাবে এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ২০০৬ সালে স্থাপিত পার্থ সি-ওয়াটার ডিস্যালাইনেশন প্লান্ট (পিএসডিপি) বর্তমানে সমন্বিত পানি সরবরাহ কর্মসূচির ১৭ শতাংশ পূরণ করে। সাউদার্ন সি-ওয়াটার ডিস্যালাইনেশন প্লান্ট বা এসএসডিপি নামে আরেকটি প্লান্টের কাজ চলছে। এসব প্রকল্প থেকে সাময়িকভাবে সুপেয় পানি পাওয়া গেলেও এই প্রক্রিয়াটির অনেক দীর্ঘমেয়াদি কুফল রয়েছে। এসব প্লান্ট চালাতে যে পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল পোড়ানো হয়, প্লান্টে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয় এবং যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়- তা যেমন অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ায়, অন্যদিকে সুপেয় পানির প্রাকৃতিক উৎসকে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, এসব প্লান্ট থেকে এক গিগালিটার পানি সরবরাহ করতে তিন হাজার ৮৯০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে আমাদের যেখানে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনা প্রয়োজন, সেখানে সুপেয় পানির তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়ার জন্য আমরা প্রতিদিনই কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছি। আর আমাদের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেই এই ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের জন্য সুপেয় পানির এই সংকট অচিরেই আরো বেশি তীব্র রূপ ধারণ করবে। উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি নোনা পানির আগ্রাসনে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই এর পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সাম্প্রতিক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, নোনা পানি ক্রমেই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফরিদপুর, যশোর, নড়াইল পর্যন্ত দেশের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ভূগর্ভস্ত স্তরে নোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই অনুপ্রবেশ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এসব এলকায় গভীর নলকূপ দিয়ে নোনা পানি উঠে আসার আশঙ্কা রয়েছে। আর তখন সেই পানির সেচ দিয়ে ফসল উৎপাদন করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ক্রমাগতভাবে ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে ঠিকমতো প্রবেশও করতে পারে না। নদী খনন বা জলাধার সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেই। এ অবস্থায় অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এই বিপদের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করছে। ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক উত্তোলনের আরো অনেক ধরনের কুফল রয়েছে। হয়তো সেগুলোও আমাদের একদিন মোকাবিলা করতেই হবে।
বিপদ ঘাড়ের ওপর এসে না চাপা পর্যন্ত আমরা বিপদ সম্পর্কে খুব কমই সাবধান হই। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কেও আমাদের অবস্থা একই রকম। যত কথা হচ্ছে, কাজ হচ্ছে না তার ১ শতাংশও। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডর এবং ২০০৮ সালের আইলায় উপকূল রক্ষা বাঁধের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কেবল খুলনা বিভাগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে থাকা এক হাজার ৬৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটারই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনো সেসব বাঁধ সম্পূর্ণরূপে মেরামত করা যায়নি। ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে আসা নোনা পানিতে তলিয়ে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্তর ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। অথচ পাকিস্তান আমলে নির্মিত এসব বাঁধের উচ্চতা জরুরি ভিত্তিতে বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগও নেই। উপকূলীয় কৃষি আজ চরমভাবে বিপর্যস্ত। বিকল্প কৃষিব্যবস্থা চালু করারও যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। ভোলা-বরগুনা-পটুয়াখালী-বাগেরহাটের মতো শহরগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। যে বরিশাল বিভাগকে এক সময় বাংলাদেশের ধানের গোলা বলা হতো, সেখানে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। কমছে চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিভাগেও।
এদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই সাগর আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যত বাড়ে ততই বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত খরা, ভয়াবহ বন্যা, মহামারি আকারে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়াসহ আরো অনেক কিছুই। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এই লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ইতিমধ্যেই মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়েও পানি উঠছে না। ফলে বোরো ধাননির্ভর বাংলাদেশের ধান চাষে চরম বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
এ অবস্থায় আমাদের প্রধান করণীয় হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো নানা কৌশল উদ্ভাবন ও সেগুলো প্রয়োগ করা। মানুষের দুর্ভোগ যাতে কম হয় সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া। নোনা পানির থাবা থেকে ফসলি জমি যতটুকু পারা যায় রক্ষা করা। অধিক সংখ্যায় মানুষ যাতে বাস্তুচ্যুত না হয়, এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। নোনা পানি সহনশীল কৃষিপদ্ধতি উদ্ভাবন করা। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলোকে বাস্তবসম্মত ধ্যানধারণা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং তাদের এই গবেষণায় সরকারকে সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে। এ জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সর্বোপরি, সরকারকে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সেসব পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি যেমন ত্বরান্বিত করতে হবে, তেমনি এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
মিঠাপানির উৎস কমে গেলে কী হবে? মিঠাপানির সংকট আরো বাড়বে। মিঠাপানিনির্ভর জীবনচক্র ক্রমে হারিয়ে যাবে। অনেক প্রাণী-প্রজাতিসহ মাটির গুণাগুণ রক্ষাকারী অনুজীবেরাও হারিয়ে যাবে। ফসল বা খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। দুর্ভিক্ষ মানবজাতিকে তাড়িয়ে বেড়াবে। যুদ্ধবিগ্রহ তখন আর অস্বাভাবিক ঘটনা থাকবে না। প্রশ্ন হলো, এ থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? অবশ্যই আছে। একটি হলো স্থায়ী বা টেকসই সমাধান এবং অপরটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক সমাধান। স্থায়ী সমাধানের মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করা, দূষণের মাত্রা কমানো, বনভূমির ধ্বংস রোধ করা এবং প্রকৃতির ওপর অত্যাচারের মাত্রা কমানো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্ব স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটছে না। হাঁটার সদিচ্ছাও দেখাচ্ছে না। পরিত্রাণের জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল উন্নত রাষ্ট্রগুলো সেসব উদ্যোগে যথেষ্ট সাড়া দিচ্ছে না। কিওটো প্রোটোকল বস্তুত তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোয় যতটা না বাগাড়ম্বর হচ্ছে, কার্যকর সমাধানের উদ্যোগ ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। তাৎক্ষণিক সমাধানের অনেক চেষ্টাই উন্নত দেশগুলো করছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, সাগরের পানিকে লবণমুক্ত করে ব্যবহার করা। উন্নত অনেক দেশেই ব্যাপকভাবে এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ২০০৬ সালে স্থাপিত পার্থ সি-ওয়াটার ডিস্যালাইনেশন প্লান্ট (পিএসডিপি) বর্তমানে সমন্বিত পানি সরবরাহ কর্মসূচির ১৭ শতাংশ পূরণ করে। সাউদার্ন সি-ওয়াটার ডিস্যালাইনেশন প্লান্ট বা এসএসডিপি নামে আরেকটি প্লান্টের কাজ চলছে। এসব প্রকল্প থেকে সাময়িকভাবে সুপেয় পানি পাওয়া গেলেও এই প্রক্রিয়াটির অনেক দীর্ঘমেয়াদি কুফল রয়েছে। এসব প্লান্ট চালাতে যে পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল পোড়ানো হয়, প্লান্টে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয় এবং যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়- তা যেমন অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ায়, অন্যদিকে সুপেয় পানির প্রাকৃতিক উৎসকে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, এসব প্লান্ট থেকে এক গিগালিটার পানি সরবরাহ করতে তিন হাজার ৮৯০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে আমাদের যেখানে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনা প্রয়োজন, সেখানে সুপেয় পানির তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়ার জন্য আমরা প্রতিদিনই কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছি। আর আমাদের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেই এই ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের জন্য সুপেয় পানির এই সংকট অচিরেই আরো বেশি তীব্র রূপ ধারণ করবে। উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি নোনা পানির আগ্রাসনে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই এর পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সাম্প্রতিক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, নোনা পানি ক্রমেই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফরিদপুর, যশোর, নড়াইল পর্যন্ত দেশের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ভূগর্ভস্ত স্তরে নোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই অনুপ্রবেশ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এসব এলকায় গভীর নলকূপ দিয়ে নোনা পানি উঠে আসার আশঙ্কা রয়েছে। আর তখন সেই পানির সেচ দিয়ে ফসল উৎপাদন করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ক্রমাগতভাবে ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে ঠিকমতো প্রবেশও করতে পারে না। নদী খনন বা জলাধার সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেই। এ অবস্থায় অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এই বিপদের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করছে। ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক উত্তোলনের আরো অনেক ধরনের কুফল রয়েছে। হয়তো সেগুলোও আমাদের একদিন মোকাবিলা করতেই হবে।
বিপদ ঘাড়ের ওপর এসে না চাপা পর্যন্ত আমরা বিপদ সম্পর্কে খুব কমই সাবধান হই। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কেও আমাদের অবস্থা একই রকম। যত কথা হচ্ছে, কাজ হচ্ছে না তার ১ শতাংশও। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডর এবং ২০০৮ সালের আইলায় উপকূল রক্ষা বাঁধের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কেবল খুলনা বিভাগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে থাকা এক হাজার ৬৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটারই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনো সেসব বাঁধ সম্পূর্ণরূপে মেরামত করা যায়নি। ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে আসা নোনা পানিতে তলিয়ে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্তর ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। অথচ পাকিস্তান আমলে নির্মিত এসব বাঁধের উচ্চতা জরুরি ভিত্তিতে বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগও নেই। উপকূলীয় কৃষি আজ চরমভাবে বিপর্যস্ত। বিকল্প কৃষিব্যবস্থা চালু করারও যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। ভোলা-বরগুনা-পটুয়াখালী-বাগেরহাটের মতো শহরগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। যে বরিশাল বিভাগকে এক সময় বাংলাদেশের ধানের গোলা বলা হতো, সেখানে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। কমছে চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিভাগেও।
এদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই সাগর আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যত বাড়ে ততই বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত খরা, ভয়াবহ বন্যা, মহামারি আকারে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়াসহ আরো অনেক কিছুই। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এই লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ইতিমধ্যেই মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়েও পানি উঠছে না। ফলে বোরো ধাননির্ভর বাংলাদেশের ধান চাষে চরম বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
এ অবস্থায় আমাদের প্রধান করণীয় হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো নানা কৌশল উদ্ভাবন ও সেগুলো প্রয়োগ করা। মানুষের দুর্ভোগ যাতে কম হয় সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া। নোনা পানির থাবা থেকে ফসলি জমি যতটুকু পারা যায় রক্ষা করা। অধিক সংখ্যায় মানুষ যাতে বাস্তুচ্যুত না হয়, এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। নোনা পানি সহনশীল কৃষিপদ্ধতি উদ্ভাবন করা। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলোকে বাস্তবসম্মত ধ্যানধারণা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং তাদের এই গবেষণায় সরকারকে সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে। এ জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সর্বোপরি, সরকারকে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সেসব পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি যেমন ত্বরান্বিত করতে হবে, তেমনি এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
No comments