সোনাপুরের ভূত by জাফর তালুকদার
গ্রামের একটা কলেজে আমি পড়াই। শহর থেকে নতুন এসেছি। হঠাৎ পাশের সোনাপুর গ্রাম থেকে ডাক এল পাঠাগার উদ্বোধন করতে হবে। এমনভাবে ধরল—না করা গেল না। সোনাপুর গ্রামটা আসলেই সোনায় মোড়া। চমৎকার ফসলের খেত। চোখ জুড়ানো সবুজ চারদিকে। নদীটা ছবির মতো।
সূর্য ডোবার আগে সুন্দরবনের ওদিক থেকে সার বেঁধে উড়ে আসে রাজ্যের পাখি। ধীরে ধীরে লাল থালার মতো সূর্যটা হারিয়ে গেলে বুকটা কেমন হাহাকার করে ওঠে।
সারা দিনের অনুষ্ঠান আর বকবকানির পর এবার বিশ্রামের পালা। যে বাড়িতে ওরা রাত কাটানোর ব্যবস্থা করেছে, তাদের খাতির-যত্নের কমতি নেই। আলাদা একটা ঘরে বিছানা পড়েছে আমার। নতুন বিছানায় শুয়ে একটু গড়াগড়ি খেতেই চোখ জুড়িয়ে এল। হঠাৎ কার পায়ের শব্দে চমকে তাকালাম ভেজানো দরজার দিকে।
‘কে?’
‘স্যার, আমি মাহিন। একটা প্রয়োজনে এসেছি আপনার কাছে।’
এ আবার কোন আপদ রে বাবা! তোর এমন কী প্রয়োজন হয়েছে, একটা ঘুমন্ত লোককে বিছানা থেকে তুলে কথা বলতে হবে এই রাতদুপুরে! যত্ত সব হ্যাপা।
‘তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। কী প্রয়োজন, বলো।’ আমার কথা কিছুটা রূঢ় শোনাল বলে লজ্জিত হলাম।
‘স্যার, আপনি আমাকে চিনবেন না। চেনাচেনির দরকারও বা কী। চলেন, বাইরে চমৎকার জোছনা উঠেছে। এমন রাতে কোনো কবি কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে। চলেন, বকুলতলায় গিয়ে আমরা একটু বসি। চাঁদের আলোয় বসে দুটো কবিতা আপনাকে পড়ে শোনাব। দোহাই আপনার, না করবেন না।’
বিরক্ত হলেও ছেলেটার কথায় এমন মায়াবী জাদু ছিল যে চট করে না বলতে পারলাম না। ঘুম আর কবিতা একসঙ্গে চলে না। অগত্যা বিছানা ছেড়ে পিছু নিতে হলো আগন্তুকের।
‘স্যার।’
‘বলো।’
‘এই সেই বকুলতলা। যদি কিছু মনে না করেন, ওখানে একটু বসি। আপনার নিশ্চয় খারাপ লাগছে না।’
‘না-না, মোটেই না। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। এবার তোমার কবিতা দুটো শোনাও।’
বকুলগাছে ঠেস দিয়ে সে পা ছড়িয়ে বসল। তারপর ভরাট কণ্ঠে একে একে আবৃত্তি করে শোনাল একের পর এক কবিতা।
আমার কানের কাছে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে কবিতার বৃষ্টি। গভীর নিদ্রায় দেহ আছড়ে পড়ল ঝরা বকুলের বিছানায়।
আমার এই কাহিনির শেষটুকু ভারি লজ্জা আর বিড়ম্বনার।
পরদিন সকালবেলা লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করল বকুলতলা থেকে। তারা নানা রকম প্রশ্ন করে জানতে চায়, রাতভর এভাবে শুয়ে থাকার কারণ। তাদের চোখে রাজ্যের কৌতূহল। কী জবাব দেব। এখন পালাতে পারলেই বাঁচি।
তবু মুখ খুলতে হয়।
‘একটা ছেলে রাতদুপুরে কবিতা শোনাতে নিয়ে এসেছিল এখানে। তার নাম মাহিন। তাকে একবার নিয়ে আসেন তো আমার কাছে। দারুণ কণ্ঠ ছেলেটার। কবিতাগুলোও বেশ। মনে হয় স্বপ্ন দেখছি।’
এবার যেন সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পাঠাগারের যে লোকটা আমাকে নিয়ে এসেছে, এখানে আমার ওপর তার অধিকার বেশি। রহস্য উদ্ঘাটনে সফল হওয়ায় তার মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল।
‘আহা। কী দুঃখ, সবটাই তাহলে অই মাহিনের কাণ্ড!’
‘মাহিন কে?’ চায়ে চুমুক দিয়ে আমি বিড়বিড় করে উঠি।
‘ও ছিল আমাদের পাঠাগারের সভাপতি। কলেজে পড়ার সময় মাহিনই প্রথম পাঠাগারটা গড়ে তোলে। একটু পাগলাটে। চমৎকার কবিতা লিখত। আবৃত্তির গলাও দারুণ। হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ও একটা ছোট্ট দল গড়ে তোলে। সবেই তো প্রস্তুতি। এমন সময় সুন্দরবন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে রাজাকারের একটা লঞ্চ ডুবিয়ে দিল নদীতে। ঘটনার পরপরই বাগেরহাট থেকে ছুটে এল গানবোট। মাহিনেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধরা পড়ে গেল মিলিটারির হাতে। সেদিনের ঘটনা আর না-ই বা শুনলেন...।’ দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠল তার গলা।
‘তারপর মাহিনের কী হলো!’ আমার কণ্ঠে উত্তেজনা ঝরে পড়ে।
‘কী আর হবে। ওকে ধরে এনে বকুলগাছটার সঙ্গে বাঁধল। তারপর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারল সবার সামনে। সে কী উল্লাস ওদের। এই ঘটনা এখনো কাঁদায় সবাইকে। আমরা ওর নামেই বন্ধ পাঠাগারটা আবার চালু করেছি। নাম দিয়েছি মাহিন স্মৃতি পাঠাগার।’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘ও কী ভূত হয়ে বকুলগাছটায় বসে আছে নাকি, এখনো!’
‘ভূত হলেই বা কী, ওকে তো ভয় পাই না আমরা।’ অকৃত্রিম হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। এদের মতো সাহস আমার নেই। তাই এ যুগের মানুষ হয়েও ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠি।
কিন্তু মাহিন? সামনে দাঁড়ানো ওই হাসিমুখের ছেলেটা আসলে কে? কী আশ্চর্য মিল রাতের ছবিটার সঙ্গে।
তাহলে ওরা সবাই ভূত হয়ে গেল নাকি?
ভয়ে-আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়ি। রাত নামার আগেই সোনাপুর ছেড়ে পালাতে হবে আমাকে।
সারা দিনের অনুষ্ঠান আর বকবকানির পর এবার বিশ্রামের পালা। যে বাড়িতে ওরা রাত কাটানোর ব্যবস্থা করেছে, তাদের খাতির-যত্নের কমতি নেই। আলাদা একটা ঘরে বিছানা পড়েছে আমার। নতুন বিছানায় শুয়ে একটু গড়াগড়ি খেতেই চোখ জুড়িয়ে এল। হঠাৎ কার পায়ের শব্দে চমকে তাকালাম ভেজানো দরজার দিকে।
‘কে?’
‘স্যার, আমি মাহিন। একটা প্রয়োজনে এসেছি আপনার কাছে।’
এ আবার কোন আপদ রে বাবা! তোর এমন কী প্রয়োজন হয়েছে, একটা ঘুমন্ত লোককে বিছানা থেকে তুলে কথা বলতে হবে এই রাতদুপুরে! যত্ত সব হ্যাপা।
‘তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। কী প্রয়োজন, বলো।’ আমার কথা কিছুটা রূঢ় শোনাল বলে লজ্জিত হলাম।
‘স্যার, আপনি আমাকে চিনবেন না। চেনাচেনির দরকারও বা কী। চলেন, বাইরে চমৎকার জোছনা উঠেছে। এমন রাতে কোনো কবি কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে। চলেন, বকুলতলায় গিয়ে আমরা একটু বসি। চাঁদের আলোয় বসে দুটো কবিতা আপনাকে পড়ে শোনাব। দোহাই আপনার, না করবেন না।’
বিরক্ত হলেও ছেলেটার কথায় এমন মায়াবী জাদু ছিল যে চট করে না বলতে পারলাম না। ঘুম আর কবিতা একসঙ্গে চলে না। অগত্যা বিছানা ছেড়ে পিছু নিতে হলো আগন্তুকের।
‘স্যার।’
‘বলো।’
‘এই সেই বকুলতলা। যদি কিছু মনে না করেন, ওখানে একটু বসি। আপনার নিশ্চয় খারাপ লাগছে না।’
‘না-না, মোটেই না। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। এবার তোমার কবিতা দুটো শোনাও।’
বকুলগাছে ঠেস দিয়ে সে পা ছড়িয়ে বসল। তারপর ভরাট কণ্ঠে একে একে আবৃত্তি করে শোনাল একের পর এক কবিতা।
আমার কানের কাছে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে কবিতার বৃষ্টি। গভীর নিদ্রায় দেহ আছড়ে পড়ল ঝরা বকুলের বিছানায়।
আমার এই কাহিনির শেষটুকু ভারি লজ্জা আর বিড়ম্বনার।
পরদিন সকালবেলা লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করল বকুলতলা থেকে। তারা নানা রকম প্রশ্ন করে জানতে চায়, রাতভর এভাবে শুয়ে থাকার কারণ। তাদের চোখে রাজ্যের কৌতূহল। কী জবাব দেব। এখন পালাতে পারলেই বাঁচি।
তবু মুখ খুলতে হয়।
‘একটা ছেলে রাতদুপুরে কবিতা শোনাতে নিয়ে এসেছিল এখানে। তার নাম মাহিন। তাকে একবার নিয়ে আসেন তো আমার কাছে। দারুণ কণ্ঠ ছেলেটার। কবিতাগুলোও বেশ। মনে হয় স্বপ্ন দেখছি।’
এবার যেন সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পাঠাগারের যে লোকটা আমাকে নিয়ে এসেছে, এখানে আমার ওপর তার অধিকার বেশি। রহস্য উদ্ঘাটনে সফল হওয়ায় তার মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল।
‘আহা। কী দুঃখ, সবটাই তাহলে অই মাহিনের কাণ্ড!’
‘মাহিন কে?’ চায়ে চুমুক দিয়ে আমি বিড়বিড় করে উঠি।
‘ও ছিল আমাদের পাঠাগারের সভাপতি। কলেজে পড়ার সময় মাহিনই প্রথম পাঠাগারটা গড়ে তোলে। একটু পাগলাটে। চমৎকার কবিতা লিখত। আবৃত্তির গলাও দারুণ। হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ও একটা ছোট্ট দল গড়ে তোলে। সবেই তো প্রস্তুতি। এমন সময় সুন্দরবন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে রাজাকারের একটা লঞ্চ ডুবিয়ে দিল নদীতে। ঘটনার পরপরই বাগেরহাট থেকে ছুটে এল গানবোট। মাহিনেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধরা পড়ে গেল মিলিটারির হাতে। সেদিনের ঘটনা আর না-ই বা শুনলেন...।’ দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠল তার গলা।
‘তারপর মাহিনের কী হলো!’ আমার কণ্ঠে উত্তেজনা ঝরে পড়ে।
‘কী আর হবে। ওকে ধরে এনে বকুলগাছটার সঙ্গে বাঁধল। তারপর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারল সবার সামনে। সে কী উল্লাস ওদের। এই ঘটনা এখনো কাঁদায় সবাইকে। আমরা ওর নামেই বন্ধ পাঠাগারটা আবার চালু করেছি। নাম দিয়েছি মাহিন স্মৃতি পাঠাগার।’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘ও কী ভূত হয়ে বকুলগাছটায় বসে আছে নাকি, এখনো!’
‘ভূত হলেই বা কী, ওকে তো ভয় পাই না আমরা।’ অকৃত্রিম হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। এদের মতো সাহস আমার নেই। তাই এ যুগের মানুষ হয়েও ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠি।
কিন্তু মাহিন? সামনে দাঁড়ানো ওই হাসিমুখের ছেলেটা আসলে কে? কী আশ্চর্য মিল রাতের ছবিটার সঙ্গে।
তাহলে ওরা সবাই ভূত হয়ে গেল নাকি?
ভয়ে-আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়ি। রাত নামার আগেই সোনাপুর ছেড়ে পালাতে হবে আমাকে।
No comments