আন্তর্জাতিক নারী দিবস-নারীবান্ধব উন্নয়ন: সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য by ফাহমিদা খাতুন
প্রতিবছর নারী দিবসের স্লোগানের ভাষা ভিন্ন হলেও সবগুলোর অন্তর্নিহিত বক্তব্য একটিই—নারীর প্রতি বৈষম্য বিদ্যমান, তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ এবং তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ১০০ বছর ধরে সারা বিশ্বে একেকটি থিম নিয়ে নারী দিবস পালিত হলেও বিশ্বের কোথাও নারী-পুরুষ সমতা এখনো অর্জিত হয়নি।
জাতিসংঘের জেন্ডার উন্নয়ন সূচক এবং জেন্ডার ক্ষমতায়ন সূচক দুটির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নারী-পুরুষের অবস্থান দেখানো হয় এবং সূচক অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের অবস্থানও দেখানো হয়। জেন্ডার উন্নয়ন সূচকে নারী-পুরুষের মধ্যকার অসমতা প্রতিফলিত হয়। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট-২০০৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে জেন্ডার উন্নয়ন সূচক ০.৫৩৬। আর ১৫৫টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১২৩তম। এই সূচকের অর্থ হচ্ছে, নারীরা পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে জেন্ডার ক্ষমতায়ন সূচকের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করা হয় নারীরা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয়ভাবে কতটুকু অংশগ্রহণ করতে পারছে। জাতীয় সংসদে পুরুষের তুলনায় শতকরা কতজন নারীর আসন রয়েছে, কতজন নারী মন্ত্রী রয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক পর্যায়ে কতভাগ নারী, বিভিন্ন পেশাগত এবং কারিগরি কাজে নারীর অংশগ্রহণের হার কত এবং তাদের আয়বৈষম্য ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মতো তথ্যগুলোর মাধ্যমে জেন্ডার ক্ষমতায়ন সূচক তৈরি করা হয়। অর্থাত্ এখানে কিছু নির্ধারিত ক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য তুলে ধরা হয়। বর্তমানে ১০৯টি দেশের মধ্যে জেন্ডার ক্ষমতায়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৮। আর বাংলাদেশের জন্য এই সূচকটি হচ্ছে ০.২৬৪ অর্থাত্ নারী-পুরুষ বৈষম্য এ ক্ষেত্রে আরও ব্যাপক। সেদিক থেকে এবারের নারী দিবসের স্লোগান সম-অধিকারের মাধ্যমে সবার অগ্রগতি অনেক তাত্পর্যপূর্ণ।
সিমোঁ দ্য বোভায়া তাঁর বিখ্যাত বই দ্বিতীয় লিঙ্গতে বলেছেন, ‘নারী হয়ে কেউ জন্ম নেয় না, নারী হয়ে ওঠে’। এই হয়ে ওঠার পর যে মানবসত্তা তৈরি হয় তাকে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। ঘর আর বাহির দুই জায়গাই তার প্রতি সমভাবে তৈরি। এর প্রতিফলন ঘটে নানাভাবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পদ, চাকরি—সব ক্ষেত্রেই নারীর পাওয়া অসম। ঘরের ভেতর একটি অসম প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠে যখন বাইরে আরেকটি অসম জগতে প্রবেশ করে, তখন সে আগে থেকেই প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে থাকে। তার জন্য ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ বা একই সমতলে সুযোগ না থাকার কারণে সে বরাবরই অসম অবস্থায় রয়ে যায়। সেটি কী অর্থনীতিতে, কী রাজনীতিতে—সবর্ত্রই প্রযোজ্য।
অথচ সামাজিক উন্নয়নের প্রধান অনুষঙ্গ যে মানব উন্নয়ন এবং সেই উন্নয়নের জন্য মানবজাতির অর্ধেক অংশ নারীর উন্নয়নও যে অপরিহার্য তা সবারই জানা। কেননা যে উন্নয়ন সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে হয় না অর্থাত্ যা ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় তা টেকসই উন্নয়ন নয়, তার প্রবৃদ্ধির হার যত বেশিই হোক না কেন। আবার যে উন্নয়ন শুধু বস্তুগত এবং প্রাকৃতিক মূলধনের ওপর ভিত্তি করে অর্জিত হয়, সেটিও আকাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নয়, কেননা মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া সেই অগ্রগতির ধারা বেশি দূর অব্যাহত রাখা যায় না।
আমাদের দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্তমানে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং ধারা চলছে তা অসম এবং অ-অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে অসমতা দরিদ্র ও ধনীদের মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। আর তার পেছনে কারণ হলো, এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। নারীরা মূলত দুইভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। প্রথমত: সুযোগের অভাব অর্থাত্ বিদ্যমান অর্থনীতি নারীর জন্য কাজের এবং আয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ করে দিতে পারে না। তবে সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। সুযোগ কোনো কাজেই লাগবে না যদি না তার ব্যবহার করা যায়। তাই দ্বিতীয় প্রয়োজনটি হলো সক্ষমতার, যেটির অভাব রয়েছে নারীর। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই দুটি বিষয়কে তাঁর ‘কমোডিটিজ অ্যান্ড কেপেবিলিটিজ’ প্রবন্ধে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, কাউকে কোনো পণ্য দিলেই তার জীবনযাত্রার মান বদলে যায় না। বদলানোটা নির্ভর করে ওই পণ্যটি ব্যবহার করার সক্ষমতা ওই ব্যক্তির রয়েছে কি না তার ওপর। আমাদের সমাজে যে সুযোগগুলো অর্থনীতিতে রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করার জন্য নারীর উপায় বা ক্ষমতা থাকে না। যেমন, শিক্ষা এবং দক্ষতার অভাবে নারীরা অনেক কাজ করতে পারে না কিংবা শুধু স্বল্প আয়ের এবং নিচু পর্যায়ের কাজগুলোতে অংশ নিতে পারে। এটি এমনকি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রেও সত্য, যেখানে শতকরা ৭৫ ভাগ শ্রমিকই নারী। প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনা, করপোরেট খাত ইত্যাদির বেলায়ও এটি বিদ্যমান। আর এ কারণেই দেখা দেয় আয়বৈষম্য। অর্থনীতিবিদ এবং তাত্ত্বিকগণ, যেমন জন স্টুয়ার্ট মিল, অ্যাডাম স্মিথ এবং কার্ল মার্কস যুক্তি দিয়েছিলেন, মানুষের সহজাত ক্ষমতা নয়, বরং শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই উত্পাদনশীলতা বাড়ানো যায়। সমাজের আয়বৈষম্য এই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। গ্যারি বেকার, থিওডোর শুলজ এবং অ্যাডাম স্মিথের মতো অর্থনীতিবিদেরা তাই তাঁদের বিখ্যাত ‘মানব মূলধন’ তত্ত্বের মাধ্যমে মানব মূলধনের ওপর বিনিয়োগ করতে বলেছেন। তার সুফল যদিও ব্যয়সাপেক্ষ, কিন্তু তা সুদূরপ্রসারী।
আমাদের দেশে মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ সাধারণভাবে অনেক কম। যেমন স্বাস্থ্য খাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে যে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে তা আমাদের মোট সরকারি ব্যয়ের শতকরা ৬.৩ ভাগ এবং শিক্ষা ও কারিগরি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট সরকারি ব্যয়ের শতকরা ১৩ ভাগ। সামগ্রিকভাবে মানব উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের অংশ মোট বাজেটের শতকরা ২৩.৫ ভাগ। এই বরাদ্দ আগের তুলনায় বেশি হলেও বলার অপেক্ষা রাখে না যে মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগামী দেশগুলোতে এই বরাদ্দের পরিমাণ আরও বেশি। তা ছাড়া এই বরাদ্দের বেশ কিছু অংশ প্রতিবছরই অব্যবহূত রয়ে যায় আমাদের ব্যয় করার ক্ষমতা এবং দক্ষতার অভাবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের তৃতীয় আরেকটি অনুষঙ্গ হলো অর্থনৈতিক সুযোগের এবং আয়ের নিরাপত্তা। যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা মহামারি, সামাজিক ব্যাধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দরিদ্র জনগণই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেহেতু তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম। তাদের মধ্যে দরিদ্র নারীদের অবস্থা আরও বেশি সঙ্গিন। এ ধরনের বিপর্যয়ের সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের সহায়তা না করলে তারা হতদরিদ্রই রয়ে যাবে। সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ মোট বাজেটের ১৫.২ শতাংশ, যা দিয়ে নারীসহ চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন কার্যক্রমের আওতায় সাহায্য করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যে কার্যক্রমগুলো নেওয়া হয়ে আসছে সেগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। তবে সেখানে নারীদের সংখ্যা আরও বাড়ানোর অবকাশ রয়েছে। এই কর্মসূচিগুলোর গুণগত ও পরিমাণগত মান বাড়িয়ে অধিকসংখ্যক নারীকে এই বেষ্টনীর মধ্যে আনা এবং প্রকৃত সহায়তা তাদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন বলেছিলেন, ‘নারী আসলে পুরুষই, পার্থক্য হলো, তার কম অর্থ আছে’। বিছিন্নভাবে এই বক্তব্যটি অনেক নারীই উচ্চপর্যায়ের কাজের এবং উচ্চ আয়ের মাধ্যমে খণ্ডন করলেও সাধারণভাবে নারী এখনো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে। বর্তমানে নারী ও পুরুষের আয়ের অনুপাত প্রায় ০.৫১ অর্থাত্ একজন নারী একজন পুরুষের আয়ের অর্ধেক উপার্জন করতে পারছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বেড়ে চলা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো এখনো নারীর কাজের জন্য পুরোপুরি উপযোগী হয়ে ওঠেনি। তবে বৈষম্যের মাত্রা কমানোর জন্য শুধু আয় বাড়ানোই একমাত্র নিয়ামক নয়। নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য ঘুচিয়ে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য সঠিক নীতিমালা এবং যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে মানব উন্নয়নে ব্যয় বাড়ানো যেমন অপরিহার্য, তেমনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাও অত্যাবশ্যক। আর সেটি সম্ভব দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ এবং পরিচালক, জনতা ব্যাংক।
সিমোঁ দ্য বোভায়া তাঁর বিখ্যাত বই দ্বিতীয় লিঙ্গতে বলেছেন, ‘নারী হয়ে কেউ জন্ম নেয় না, নারী হয়ে ওঠে’। এই হয়ে ওঠার পর যে মানবসত্তা তৈরি হয় তাকে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। ঘর আর বাহির দুই জায়গাই তার প্রতি সমভাবে তৈরি। এর প্রতিফলন ঘটে নানাভাবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পদ, চাকরি—সব ক্ষেত্রেই নারীর পাওয়া অসম। ঘরের ভেতর একটি অসম প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠে যখন বাইরে আরেকটি অসম জগতে প্রবেশ করে, তখন সে আগে থেকেই প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে থাকে। তার জন্য ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ বা একই সমতলে সুযোগ না থাকার কারণে সে বরাবরই অসম অবস্থায় রয়ে যায়। সেটি কী অর্থনীতিতে, কী রাজনীতিতে—সবর্ত্রই প্রযোজ্য।
অথচ সামাজিক উন্নয়নের প্রধান অনুষঙ্গ যে মানব উন্নয়ন এবং সেই উন্নয়নের জন্য মানবজাতির অর্ধেক অংশ নারীর উন্নয়নও যে অপরিহার্য তা সবারই জানা। কেননা যে উন্নয়ন সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে হয় না অর্থাত্ যা ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় তা টেকসই উন্নয়ন নয়, তার প্রবৃদ্ধির হার যত বেশিই হোক না কেন। আবার যে উন্নয়ন শুধু বস্তুগত এবং প্রাকৃতিক মূলধনের ওপর ভিত্তি করে অর্জিত হয়, সেটিও আকাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নয়, কেননা মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া সেই অগ্রগতির ধারা বেশি দূর অব্যাহত রাখা যায় না।
আমাদের দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্তমানে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং ধারা চলছে তা অসম এবং অ-অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে অসমতা দরিদ্র ও ধনীদের মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। আর তার পেছনে কারণ হলো, এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। নারীরা মূলত দুইভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। প্রথমত: সুযোগের অভাব অর্থাত্ বিদ্যমান অর্থনীতি নারীর জন্য কাজের এবং আয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ করে দিতে পারে না। তবে সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। সুযোগ কোনো কাজেই লাগবে না যদি না তার ব্যবহার করা যায়। তাই দ্বিতীয় প্রয়োজনটি হলো সক্ষমতার, যেটির অভাব রয়েছে নারীর। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই দুটি বিষয়কে তাঁর ‘কমোডিটিজ অ্যান্ড কেপেবিলিটিজ’ প্রবন্ধে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, কাউকে কোনো পণ্য দিলেই তার জীবনযাত্রার মান বদলে যায় না। বদলানোটা নির্ভর করে ওই পণ্যটি ব্যবহার করার সক্ষমতা ওই ব্যক্তির রয়েছে কি না তার ওপর। আমাদের সমাজে যে সুযোগগুলো অর্থনীতিতে রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করার জন্য নারীর উপায় বা ক্ষমতা থাকে না। যেমন, শিক্ষা এবং দক্ষতার অভাবে নারীরা অনেক কাজ করতে পারে না কিংবা শুধু স্বল্প আয়ের এবং নিচু পর্যায়ের কাজগুলোতে অংশ নিতে পারে। এটি এমনকি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রেও সত্য, যেখানে শতকরা ৭৫ ভাগ শ্রমিকই নারী। প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনা, করপোরেট খাত ইত্যাদির বেলায়ও এটি বিদ্যমান। আর এ কারণেই দেখা দেয় আয়বৈষম্য। অর্থনীতিবিদ এবং তাত্ত্বিকগণ, যেমন জন স্টুয়ার্ট মিল, অ্যাডাম স্মিথ এবং কার্ল মার্কস যুক্তি দিয়েছিলেন, মানুষের সহজাত ক্ষমতা নয়, বরং শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই উত্পাদনশীলতা বাড়ানো যায়। সমাজের আয়বৈষম্য এই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। গ্যারি বেকার, থিওডোর শুলজ এবং অ্যাডাম স্মিথের মতো অর্থনীতিবিদেরা তাই তাঁদের বিখ্যাত ‘মানব মূলধন’ তত্ত্বের মাধ্যমে মানব মূলধনের ওপর বিনিয়োগ করতে বলেছেন। তার সুফল যদিও ব্যয়সাপেক্ষ, কিন্তু তা সুদূরপ্রসারী।
আমাদের দেশে মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ সাধারণভাবে অনেক কম। যেমন স্বাস্থ্য খাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে যে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে তা আমাদের মোট সরকারি ব্যয়ের শতকরা ৬.৩ ভাগ এবং শিক্ষা ও কারিগরি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট সরকারি ব্যয়ের শতকরা ১৩ ভাগ। সামগ্রিকভাবে মানব উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের অংশ মোট বাজেটের শতকরা ২৩.৫ ভাগ। এই বরাদ্দ আগের তুলনায় বেশি হলেও বলার অপেক্ষা রাখে না যে মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগামী দেশগুলোতে এই বরাদ্দের পরিমাণ আরও বেশি। তা ছাড়া এই বরাদ্দের বেশ কিছু অংশ প্রতিবছরই অব্যবহূত রয়ে যায় আমাদের ব্যয় করার ক্ষমতা এবং দক্ষতার অভাবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের তৃতীয় আরেকটি অনুষঙ্গ হলো অর্থনৈতিক সুযোগের এবং আয়ের নিরাপত্তা। যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা মহামারি, সামাজিক ব্যাধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দরিদ্র জনগণই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেহেতু তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম। তাদের মধ্যে দরিদ্র নারীদের অবস্থা আরও বেশি সঙ্গিন। এ ধরনের বিপর্যয়ের সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের সহায়তা না করলে তারা হতদরিদ্রই রয়ে যাবে। সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ মোট বাজেটের ১৫.২ শতাংশ, যা দিয়ে নারীসহ চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন কার্যক্রমের আওতায় সাহায্য করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যে কার্যক্রমগুলো নেওয়া হয়ে আসছে সেগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। তবে সেখানে নারীদের সংখ্যা আরও বাড়ানোর অবকাশ রয়েছে। এই কর্মসূচিগুলোর গুণগত ও পরিমাণগত মান বাড়িয়ে অধিকসংখ্যক নারীকে এই বেষ্টনীর মধ্যে আনা এবং প্রকৃত সহায়তা তাদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন বলেছিলেন, ‘নারী আসলে পুরুষই, পার্থক্য হলো, তার কম অর্থ আছে’। বিছিন্নভাবে এই বক্তব্যটি অনেক নারীই উচ্চপর্যায়ের কাজের এবং উচ্চ আয়ের মাধ্যমে খণ্ডন করলেও সাধারণভাবে নারী এখনো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে। বর্তমানে নারী ও পুরুষের আয়ের অনুপাত প্রায় ০.৫১ অর্থাত্ একজন নারী একজন পুরুষের আয়ের অর্ধেক উপার্জন করতে পারছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বেড়ে চলা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো এখনো নারীর কাজের জন্য পুরোপুরি উপযোগী হয়ে ওঠেনি। তবে বৈষম্যের মাত্রা কমানোর জন্য শুধু আয় বাড়ানোই একমাত্র নিয়ামক নয়। নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য ঘুচিয়ে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য সঠিক নীতিমালা এবং যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে মানব উন্নয়নে ব্যয় বাড়ানো যেমন অপরিহার্য, তেমনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাও অত্যাবশ্যক। আর সেটি সম্ভব দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ এবং পরিচালক, জনতা ব্যাংক।
No comments