এইদিনে-একটি ভাষণ হয়ে উঠল কবিতা by জাহীদ রেজা নূর
কথাগুলো বারবার বলা দরকার। ৭ মার্চ, ১৯৭১-এর কথা। এমন দিন খুব কম এসেছে আমাদের জীবনে, এই ভূখণ্ডে।
তত দিনে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের খবর পৌঁছে গেছে প্রতিটি বাঙালির শিরায় শিরায়।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছিলেন এই বৈষম্যের কথা।
তত দিনে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের খবর পৌঁছে গেছে প্রতিটি বাঙালির শিরায় শিরায়।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছিলেন এই বৈষম্যের কথা।
‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ শিরোনামে একটি পোস্টার ছাপা হয়েছিল, তাতে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছিল শোষণের ইতিবৃত্ত। দু-একটি নমুনা তুলে ধরা ভালো। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব-ব্যয়ের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো দেড় হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ২০ শতাংশ আসত পূর্ব বাংলায়। সামরিক বাহিনীর জন্য ৯০ শতাংশ ব্যয়ই করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির ৮৫ শতাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে।
তাহলে শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার একটি পথ তো তৈরি হয়েই ছিল। আর তাই এই ভূখণ্ডের মানুষ চাইছিল এমন একজন নেতা, যাঁর ডাকে একাত্ম হবে সবাই।
এ দেশে অনেক নেতার জন্ম হয়েছে। অনেক নেতা শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। বিচক্ষণ বহু নেতাই পাল্টে দিতে চেয়েছেন দেশের চেহারা। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন আপাদমস্তক ‘নিজের মানুষ’কে এত দিন খুঁজে পায়নি বাঙালি। জনগণ তাঁর মধ্যে যেন দেখতে পেল নিজের অবয়ব। তাঁর বলা কথা হয়ে গেল বাঙালির নিজস্ব কণ্ঠস্বর।
সেই অসাধারণ সাত দিনকে আনা যাক ভাবনায়।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। অবিশ্বাস্য বড় জয় পেয়েছে দলটি। শেখ মুজিবুর রহমান তত দিনে ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পথ ঘুরে এই ভূখণ্ডের মানুষের নয়নের মণিতে পরিণত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখও করেছেন। ২৩ বছরের পাকিস্তানি অস্তিত্বে এ-ই প্রথম বাঙালির হাতে যাচ্ছে শাসনক্ষমতা। এটা কী করে সহ্য করবে পশ্চিমারা, কী করে তারা মেনে নেবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতার আধিপত্য?
অতএব ষড়যন্ত্রের কথাই তারা ভাবতে থাকে। ১ মার্চ ইয়াহিয়া দেন বেতার ভাষণ। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল, ইয়াহিয়া খান এই অজুহাতে তা স্থগিত করে দেন যে পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল অধিবেশনে আসবে না।
এ যেন বারুদে লাগল আগুন। ফুঁসে উঠল বাংলার জনগণ। ‘মানি না, মানব না’ বলে রাজপথ দখল করে নিল মিছিল। মিছিলগুলোর অভিন্ন গন্তব্য—হোটেল পূর্বাণী। সেখানেই বসেছিল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক। হোটেলের সামনে তখন জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু এলেন সাংবাদিকদের সামনে। বললেন, অধিবেশন স্থগিত করাটা পাকিস্তানি শাসকচক্রের আরেকটি ষড়যন্ত্র। তিনি কি এবার স্বাধীনতার ঘোষণা করবেন—এই প্রশ্ন ভেসে বেড়াতে লাগল সারা দেশে। বঙ্গবন্ধু শুধু বললেন, ‘অপেক্ষা করুন।’
ইয়াহিয়া-ভুট্টো তো চাইছিলেনই, বঙ্গবন্ধু এখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করুন। বিশ্ব জানুক, শেখ মুজিব একজন দেশদ্রোহী। এটা প্রমাণ করা গেলেই বাঙালির বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া সহজ হবে।
জনতার বিক্ষোভ চলতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করেন। ২ মার্চ অর্ধবেলা হরতালের মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সরকারি পেটোয়া বাহিনী। ফার্মগেট এলাকায় অন্তত দুজন নিহত হয়। ২ মার্চই সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বাঙালির শিরায় শিরায় তখন দুঃসাহস। সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে বিবৃতি দেন, তাতে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘বাঙালিকে আর দমন করিয়া রাখা যাইবে না।’ ৭ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী হরতাল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশ।
বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম চলতে লাগল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। এই অঞ্চল থেকে বিদায় নিল সরকার। শেখ মুজিবের নির্দেশই এখানে একমাত্র কার্যকরী নির্দেশ।
৭ মার্চ সবাই প্রতীক্ষা করছে, কী বলবেন দেশের নেতা? মানুষে মানুষে ছেয়ে গেল রেসকোর্স ময়দান। রাজনীতির কবি মঞ্চে এসে যা বললেন, তার প্রতিটি শব্দই যেন হীরণ্ময় দ্যুতিতে ভাস্বর।
বঙ্গবন্ধুর ওপর তখন দেশি-বিদেশি চাপ। সাংবাদিকেরা একটি অসাধারণ শিরোনামের অপেক্ষায়। ৭ মার্চ গম্ভীর কণ্ঠের ভাষণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস তুলে আনলেন এক ঝলকে। তাঁর ভাষণটি যেকোনোভাবে বুঝে নেওয়া যাবে, কিন্তু তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়ার কোনো সুযোগ রাখলেন না। এ কারণেই ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও তা তাত্ক্ষণিকতার মোহে আবদ্ধ থাকল না, অথচ এই কথার ভেতরের অর্থ বুঝে নিলেন সবাই।
একটি দেশের জন্মমুহূর্তের আগে সব প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ৭ মার্চ।
একটি মানুষ হয়ে উঠলেন কবি।
একটি ভাষণ হয়ে উঠল কবিতা।
একটি জাতি একটি দণ্ডে একাত্ম হয়ে রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নে বিভোর হলো এই দিনটিতে।
তাহলে শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার একটি পথ তো তৈরি হয়েই ছিল। আর তাই এই ভূখণ্ডের মানুষ চাইছিল এমন একজন নেতা, যাঁর ডাকে একাত্ম হবে সবাই।
এ দেশে অনেক নেতার জন্ম হয়েছে। অনেক নেতা শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। বিচক্ষণ বহু নেতাই পাল্টে দিতে চেয়েছেন দেশের চেহারা। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন আপাদমস্তক ‘নিজের মানুষ’কে এত দিন খুঁজে পায়নি বাঙালি। জনগণ তাঁর মধ্যে যেন দেখতে পেল নিজের অবয়ব। তাঁর বলা কথা হয়ে গেল বাঙালির নিজস্ব কণ্ঠস্বর।
সেই অসাধারণ সাত দিনকে আনা যাক ভাবনায়।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। অবিশ্বাস্য বড় জয় পেয়েছে দলটি। শেখ মুজিবুর রহমান তত দিনে ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পথ ঘুরে এই ভূখণ্ডের মানুষের নয়নের মণিতে পরিণত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখও করেছেন। ২৩ বছরের পাকিস্তানি অস্তিত্বে এ-ই প্রথম বাঙালির হাতে যাচ্ছে শাসনক্ষমতা। এটা কী করে সহ্য করবে পশ্চিমারা, কী করে তারা মেনে নেবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতার আধিপত্য?
অতএব ষড়যন্ত্রের কথাই তারা ভাবতে থাকে। ১ মার্চ ইয়াহিয়া দেন বেতার ভাষণ। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল, ইয়াহিয়া খান এই অজুহাতে তা স্থগিত করে দেন যে পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল অধিবেশনে আসবে না।
এ যেন বারুদে লাগল আগুন। ফুঁসে উঠল বাংলার জনগণ। ‘মানি না, মানব না’ বলে রাজপথ দখল করে নিল মিছিল। মিছিলগুলোর অভিন্ন গন্তব্য—হোটেল পূর্বাণী। সেখানেই বসেছিল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক। হোটেলের সামনে তখন জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু এলেন সাংবাদিকদের সামনে। বললেন, অধিবেশন স্থগিত করাটা পাকিস্তানি শাসকচক্রের আরেকটি ষড়যন্ত্র। তিনি কি এবার স্বাধীনতার ঘোষণা করবেন—এই প্রশ্ন ভেসে বেড়াতে লাগল সারা দেশে। বঙ্গবন্ধু শুধু বললেন, ‘অপেক্ষা করুন।’
ইয়াহিয়া-ভুট্টো তো চাইছিলেনই, বঙ্গবন্ধু এখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করুন। বিশ্ব জানুক, শেখ মুজিব একজন দেশদ্রোহী। এটা প্রমাণ করা গেলেই বাঙালির বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া সহজ হবে।
জনতার বিক্ষোভ চলতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করেন। ২ মার্চ অর্ধবেলা হরতালের মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সরকারি পেটোয়া বাহিনী। ফার্মগেট এলাকায় অন্তত দুজন নিহত হয়। ২ মার্চই সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বাঙালির শিরায় শিরায় তখন দুঃসাহস। সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে বিবৃতি দেন, তাতে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘বাঙালিকে আর দমন করিয়া রাখা যাইবে না।’ ৭ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী হরতাল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশ।
বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম চলতে লাগল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। এই অঞ্চল থেকে বিদায় নিল সরকার। শেখ মুজিবের নির্দেশই এখানে একমাত্র কার্যকরী নির্দেশ।
৭ মার্চ সবাই প্রতীক্ষা করছে, কী বলবেন দেশের নেতা? মানুষে মানুষে ছেয়ে গেল রেসকোর্স ময়দান। রাজনীতির কবি মঞ্চে এসে যা বললেন, তার প্রতিটি শব্দই যেন হীরণ্ময় দ্যুতিতে ভাস্বর।
বঙ্গবন্ধুর ওপর তখন দেশি-বিদেশি চাপ। সাংবাদিকেরা একটি অসাধারণ শিরোনামের অপেক্ষায়। ৭ মার্চ গম্ভীর কণ্ঠের ভাষণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস তুলে আনলেন এক ঝলকে। তাঁর ভাষণটি যেকোনোভাবে বুঝে নেওয়া যাবে, কিন্তু তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়ার কোনো সুযোগ রাখলেন না। এ কারণেই ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও তা তাত্ক্ষণিকতার মোহে আবদ্ধ থাকল না, অথচ এই কথার ভেতরের অর্থ বুঝে নিলেন সবাই।
একটি দেশের জন্মমুহূর্তের আগে সব প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ৭ মার্চ।
একটি মানুষ হয়ে উঠলেন কবি।
একটি ভাষণ হয়ে উঠল কবিতা।
একটি জাতি একটি দণ্ডে একাত্ম হয়ে রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নে বিভোর হলো এই দিনটিতে।
No comments