গ্যালারি কায়া-মৃত্তিকা গর্ভে জ্যোৎস্না বাগান by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

মাটি, আগুন, রং—এই তিনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সিরামিকস। প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রাপ্ত ভাস্কর্য মাতৃমূর্তি ‘ভেনাস অব ভিলেনডর্ফ’ থেকে আমরা ধারণা পাই মাটির তৈরি ভাস্কর্য সম্পর্কে। বাংলাদেশে নিরীক্ষাধর্মী ভাস্কর্যের চর্চা শুরু করেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। সেই ধারাবাহিকতায় শিল্পীরা চিত্রকলার পাশাপাশি মাটি, প্লাস্টার,


সিমেন্ট, কাঠ ও ধাতব বস্তুর ব্যবহারে ভাস্কর্য তৈরি শুরু করেন সত্তরের দশকের শেষভাগে। ৪ মে উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শুরু হয়েছে শিল্পী দেবাশীষ পালের একক সিরামিকস প্রদর্শনী। নিরীক্ষাধর্মী কাজের পাশাপাশি ব্যবহারিক শিল্পিত সামগ্রীর সমন্বয়ে সাজানো এ প্রদর্শনী মাটি পুড়িয়ে তার ওপর রঙের প্রয়োগে মানুষের মুখাবয়ব হুবহু রেখে দিয়ে যুক্ত করেছেন কাঠ ও বালিসহ নানা মাধ্যম। ২০০৪ সালে শিল্পীর করা ‘বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রতিকৃতি’ শিরোনামের কাজে আমরা দেখি কাঠের বাক্স থেকে ঊর্ধ্বমুখে উঠে আসছে একদল মানুষের মুখ। ‘জার্নি ইন ফায়ার’ শিরোনামের এবারের প্রদর্শনীতে নতুন কিছু বিষয়ের দেখা মেলে। শিল্পীর মতে, কাজের বিস্তৃতির চেয়ে বিষয়ের সংক্ষিপ্ত রূপ নির্মাণে প্রত্যেক শিল্পীর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তিনি তাঁর কাজে বিষয়ের পরিধি কমিয়ে এনেছেন এ প্রদর্শনীতে। এটি দীর্ঘ সময় কাজ নিয়ে নিরীক্ষারই ফল। পিতার মূর্তি গড়ার সান্নিধ্যে বড় হওয়া মনে করেন, ভাস্কর্যের হাতেখড়ি পেয়েছেন তিনি তাঁর পরিবার থেকেই।
শিল্পী দেবাশীষের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ বাঙালির সাহসী সব অর্জন আর সমাজে প্রতিনিয়ত লড়াই করা মানুষের জীবনযাপন।
প্রথমে মাটির ভাস্কর্য বানানোর পর তাঁকে সিরামিকসে রূপ দেওয়ার জন্য কয়েকটি ধাপে কাজ করতে হয়। কোনো কোনো কাজে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও পুড়িয়ে কাজে বিষয়ের উপস্থিতি ঘটান। সিরামিকসের গায়ে বুনট, সংবাদপত্রের শিরোনাম অথবা বাংলা বর্ণমালার ছাপ দেন।
বর্তমান প্রদর্শনীর কাজগুলো একই শিরোনামে হলেও প্রতিটি কাজের করণকৌশল ও বিষয় ভিন্ন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সরাকে তিনি ফ্রেমবন্দী করে রং ও বুনটের নিরীক্ষা করেছেন চৌকোনো প্লেটে স্থাপন করে। গোলাকৃতির কোনো কোনো কাজে নারীমুখের সঙ্গে নকশার রিলিফ উৎকীর্ণ করেছেন। ‘জার্নি ইন ফায়ার-৪’ শিরোনামের কাজে আটটি মুখের চোখ ও নাক একই রেখে লাল রঙের প্রয়োগে বিভিন্ন ভঙ্গি সামাজিক অবিচার ও দলনের প্রতিবাদ। ‘জার্নি ইন ফায়ার-২’ কাজে মেঝেতে রাখা ছয়টি কাঠের বাক্সে ছয়টি ধানবীজের বপন, বাক্সের দুপাশে নারী, পুরুষ, শিশুমুখের শায়িত ভঙ্গি আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নকে রূপ দিয়েছেন। গ্যালারি প্রাঙ্গণে উপস্থাপিত স্থাপনাশিল্পের বিষয় ‘বধ্যভূমি’। ২৫ মার্চের পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। সেই গলিত লাশের স্তূপের মধ্যে মানুষের মুখাবয়বের প্রাণহীন উপস্থিতি বধ্যভূমির স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়।
শিল্পী দেবাশীষ বাংলাদেশে অনুকরণীয় শিল্পী হিসেবে অলক রায়কে আদর্শ মানেন। বিষয় ও করণকৌশলে সমসাময়িক ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে তিনি শিল্পী অলক রায়ের কাজকে প্রাধান্য দেন। সিরামিকসের ব্যবহার্য তৈজসপত্রের উল্টো পিঠে শিল্পী দেবাশীষ ভাস্কর্যশিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। সিরামিকস মানে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী নয়। এ ধারণাকে পাল্টে দিয়ে নিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন নতুন শিল্পকর্ম। বাংলাদেশে শিল্পকলার বিভিন্ন শাখার মধ্যে সিরামিকস অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল। তাতে শিল্পী ক্লান্তিহীন চর্চা অব্যাহত রাখবেন আমাদেরই জন্য। ১১৫টি শিল্পকর্মের এ প্রদর্শনীটি শেষ হবে ১৫ মে।

দেবাশীষ পাল: জন্ম ১৯৭১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সিরামিকস বিভাগ থেকে ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ২০০৭-এ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে সকল মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন। দুটি একক ও ১২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সিরামিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।

No comments

Powered by Blogger.