সমকালীন প্রসঙ্গ-কেমন হওয়া উচিত আসন্ন বাজেট by বদিউল আলম মজুমদার
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন হয় না। যেমন ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রদান ও প্রকাশ, তাদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন ইত্যাদি। এ জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা, যা বর্তমান সরকার গত প্রায় আড়াই বছর মেয়াদকালে বলিষ্ঠভাবে দেখাতে পারেনি
কেমন হওয়া উচিত আসন্ন বাজেট_ এ শিরোনামের একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করার আমার সম্প্রতি সুযোগ হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে আরও প্রশ্ন জাগে : কেমন ছিল আমাদের অতীতের, বিশেষত নিকট অতীতের বাজেট? কারণ সাম্প্রতিককালের বাজেট আসন্ন বাজেটের ওপর প্রভাব ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার ধারণা, সাম্প্রতিককালের আমাদের জাতীয় বাজেটগুলোতে তেমন বিরাট ধরনের কোনো বৈপরীত্য দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের আমলেই হোক, কিংবা বিএনপির সময়েই হোক, আমাদের বাজেটে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য বাজেটের কলেবর বেড়েছে। অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু নতুন খাত এতে যুক্ত হয়েছে এবং বিদ্যমান খাতগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণে কিছুটা পুনর্বিন্যাস হয়েছে। যেমন বিশ্বমন্দার কারণে বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য বিরাট অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ যুক্ত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের বাজেটের মূল কাঠামোতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। বস্তুত আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় বাজেট গতানুগতিকতার একটি ছকে আটকা পড়ে গেছে।
বিশ্ব পরিস্থিতি দিন দিন বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে আমাদের সমস্যাগুলোও। আমরা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। বস্তুত আমাদের পুরনো সমস্যাগুলোর সঙ্গে অনেক নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। দারিদ্র্য-বৈষম্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দেশের বিরাট এলাকা লোনা পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা। বিরাট জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতে 'জলবায়ু উদ্বাস্তু' হওয়ার ঝুঁকি। একই সঙ্গে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর উজানে বাঁধ দেওয়ার ফলে উত্তরাঞ্চলে মরুকরণের লক্ষণ। মিষ্টি পানিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আজ পানীয় জলের বিরাট অভাব। বাড়তি জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপও আমাদের জন্য এক মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজের সব স্তরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক প্রসার। এভাবে আরও অনেক সমস্যা প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে।
বাজেট শুধু বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাবই নয়, এটি জাতির অগ্রাধিকারের একটি তালিকাও বটে। তাই আমাদের বর্তমান সমস্যা ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার প্রস্তুতি বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। প্রতিফলিত হওয়া উচিত জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যেতে চাই, সে দিকনির্দেশনাও।
বিংশ শতাব্দীর চাবি দিয়ে যেমন একবিংশ শতাব্দীর তালা খোলা যায় না, তেমনিভাবে অতীতের ছকবাঁধা বাজেট দিয়েও জাতিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা যায় না। সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই আমি মনে করি, আমাদের বিরাজমান বাজেট কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করা আবশ্যক। আরও আবশ্যক বাজেটের অগ্রাধিকার খাতগুলোর পুনর্বিন্যাস। একই সঙ্গে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন জরুরি। বাজেটে যাতে বিভিন্ন স্বার্থসংশিল্গষ্টদের, শুধু ব্যবসায়ীদের নয়, অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাজেট শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, বাজেটে সব নাগরিকের স্বার্থ প্রতিফলিত হওয়া আবশ্যক।
বাজেটের কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে পারে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী 'জেলা বাজেট' প্রণয়নের কথা অনেকদিন থেকেই বলছেন। বাজেটের কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া জেলা বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয়। কারণ বর্তমান বাজেট 'টপ-ডাউন' বা নিম্নমুখী এবং জেলা বাজেট হতে হবে 'বটম-আপ' বা ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ জেলা বাজেট তৈরি হতে হবে ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালে উপজেলা পর্যায়ে নির্ধারিত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তার পরিবর্তে জাতীয় বাজেট শুধু জেলার জন্য ভাগ করে দেখানো একটি অর্থবহ এক্মারসাইজ হবে না। এ জন্য অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠন করতে হবে।
বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে মাননীয় সংসদ সদস্যদের ভূমিকা থাকা জরুরি। বর্তমানে বাজেট পাসের সময়ে 'হ্যাঁ/না' বলার বাইরে এবং নির্ধারিত বাজেট আলোচনার সময়ে দলীয় নেতানেত্রীদের তোষামোদ ও বিরোধীদের দোষারোপ এবং নিজস্ব নির্বাচনী এলাকার কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরা ছাড়া তারা তেমন কোনো ভূমিকাই পালন করেন না। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও বাজেট বিশ্লেষণ এবং এ সম্পর্কে কোনো গভীর আলোচনার সূত্রপাত করে না। ফলে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংসদের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না।
শোনা যায়, আগামী বছরের বাজেটের কলেবর হবে আনুমানিক ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। এত বিরাট অঙ্কের বাজেট হলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যেকের বাজেটের হিস্যা হবে প্রায় ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের মোট হিস্যা প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ টাকা প্রত্যেক পরিবারের প্রাপ্য নয়, তবে এর সমপরিমাণ অঙ্কের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি সেবা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু তারা কি তা পায়? নাকি তার পরিবর্তে তারা তাদের অর্থপুষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়? অনেকের ধারণা, সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ জনগণের কল্যাণের পরিপন্থী (যেমন বাসে চলাচলকারী যাত্রীদের, পুঁজি বাজারে শেয়ার বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে) কাজ করে এবং অনেক সরকারি অর্থেরই অপব্যবহার ও অপচয় হয়। তাই সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাজেটের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আরেকটি কারণেও বাজেটে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে কতগুলো সুস্পষ্ট অঙ্গীকারের ভিত্তিতে, যেগুলো তাদের দিনবদলের সনদ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত। দিনবদলের সনদে ২৩টি অগ্রাধিকার রয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি হলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার : ১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দার মোকাবেলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা; ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা; ৩. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান করা; ৪. দারিদ্র্য ঘুচানো ও বৈষম্য রোখার লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করা; এবং ৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
নির্বাচনী ইশতেহার বস্তুত রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের মধ্যে সম্পাদিত একটি লিখিত চুক্তি, যদিও এটি স্বাক্ষরিত নয়। তাই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ইশতেহারে প্রদত্ত অঙ্গীকারগুলো, আইনগতভাবে না হলেও অন্তত নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই পালনীয়। তাই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ পাঁচটি অগ্রাধিকাার বাস্তবায়নের প্রতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। তবে অন্য অগ্রাধিকারগুলোও উপেক্ষা করলে চলবে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নই হওয়া উচিত বাজেট প্রণয়নের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
আসন্ন বাজেটে সরকারকে অবশ্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান, তেল ও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং আহরণ ইত্যাদির প্রতি অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থানের প্রতিও অধিক জোর দেওয়া আবশ্যক।
একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, উপরিউক্ত পাঁচটি অগ্রাধিকারের অনেকগুলোই সুশাসন সম্পর্কিত। যেমন দুর্নীতি দমন শিরোনামের অগ্রাধিকারে বলা হয়েছে : 'দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।' একই সঙ্গে বিরাজমান আয় ও সুযোগের বৈষম্য দূরীকরণের অঙ্গীকারও দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা আবার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।
এ ছাড়াও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রক্ষার লক্ষ্যে দিনবদলের সনদে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ শক্ত হাতে দমন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত, বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় কার্যকর ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার, বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার কথাও এতে বলা হয়েছে। উপরন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও এতে ব্যক্ত করা হয়েছে।
আরও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত রাখার, জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও এর মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করার এবং সংসদে মতামত ব্যক্ত করার ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের নিজস্ব বিবেক-বিবেচনা সীমিত আকারে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করার। রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ করার, ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষুষ্ণতা গড়ে তোলার, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ করার ও ক্ষমতাধরদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিও দিনবদলের সনদে রয়েছে।
দিনবদলের সনদে আরও বলা হয়েছে : 'দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে। প্রশাসনিক সংস্কার, তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ই-গভর্নেন্স চালু করা হবে ... জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে।'
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আরও প্রয়োজন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন। কেন্দ্রীভূত শাসন পদ্ধতি, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির এখতিয়ারে থাকে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটায়। তাই সম্পদ, ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব তৃণমূলের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে হস্তান্তর করার বিষয়টি, যা দিনবদলের সনদের ষষ্ঠতম অগ্রাধিকার, বাজেটে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। উল্লেখ্য, নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তৃণমূলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে, রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয় না।
দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি অগ্রাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রেও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বস্তুত মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেটুকু সফলতা অর্জন করেছে, তা ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখা বহুলাংশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করবে। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন অর্জিত হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। মানবাধিকার সংরক্ষিত হবে। সমাজে সমতা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন হয় না। যেমন ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রদান ও প্রকাশ, তাদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন ইত্যাদি। এ জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা, যা বর্তমান সরকার গত প্রায় আড়াই বছর মেয়াদকালে বলিষ্ঠভাবে দেখাতে পারেনি। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন। আমরা আশা করি, আসন্ন বাজেটে সেসব খাত অগ্রাধিকার পাবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক সুজন_ সুশাসনের জন্য নাগরিক
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার ধারণা, সাম্প্রতিককালের আমাদের জাতীয় বাজেটগুলোতে তেমন বিরাট ধরনের কোনো বৈপরীত্য দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের আমলেই হোক, কিংবা বিএনপির সময়েই হোক, আমাদের বাজেটে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য বাজেটের কলেবর বেড়েছে। অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু নতুন খাত এতে যুক্ত হয়েছে এবং বিদ্যমান খাতগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণে কিছুটা পুনর্বিন্যাস হয়েছে। যেমন বিশ্বমন্দার কারণে বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য বিরাট অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ যুক্ত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের বাজেটের মূল কাঠামোতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। বস্তুত আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় বাজেট গতানুগতিকতার একটি ছকে আটকা পড়ে গেছে।
বিশ্ব পরিস্থিতি দিন দিন বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে আমাদের সমস্যাগুলোও। আমরা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। বস্তুত আমাদের পুরনো সমস্যাগুলোর সঙ্গে অনেক নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। দারিদ্র্য-বৈষম্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দেশের বিরাট এলাকা লোনা পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা। বিরাট জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতে 'জলবায়ু উদ্বাস্তু' হওয়ার ঝুঁকি। একই সঙ্গে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর উজানে বাঁধ দেওয়ার ফলে উত্তরাঞ্চলে মরুকরণের লক্ষণ। মিষ্টি পানিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আজ পানীয় জলের বিরাট অভাব। বাড়তি জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপও আমাদের জন্য এক মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজের সব স্তরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক প্রসার। এভাবে আরও অনেক সমস্যা প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে।
বাজেট শুধু বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাবই নয়, এটি জাতির অগ্রাধিকারের একটি তালিকাও বটে। তাই আমাদের বর্তমান সমস্যা ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার প্রস্তুতি বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। প্রতিফলিত হওয়া উচিত জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যেতে চাই, সে দিকনির্দেশনাও।
বিংশ শতাব্দীর চাবি দিয়ে যেমন একবিংশ শতাব্দীর তালা খোলা যায় না, তেমনিভাবে অতীতের ছকবাঁধা বাজেট দিয়েও জাতিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা যায় না। সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই আমি মনে করি, আমাদের বিরাজমান বাজেট কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করা আবশ্যক। আরও আবশ্যক বাজেটের অগ্রাধিকার খাতগুলোর পুনর্বিন্যাস। একই সঙ্গে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন জরুরি। বাজেটে যাতে বিভিন্ন স্বার্থসংশিল্গষ্টদের, শুধু ব্যবসায়ীদের নয়, অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাজেট শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, বাজেটে সব নাগরিকের স্বার্থ প্রতিফলিত হওয়া আবশ্যক।
বাজেটের কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে পারে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী 'জেলা বাজেট' প্রণয়নের কথা অনেকদিন থেকেই বলছেন। বাজেটের কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া জেলা বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয়। কারণ বর্তমান বাজেট 'টপ-ডাউন' বা নিম্নমুখী এবং জেলা বাজেট হতে হবে 'বটম-আপ' বা ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ জেলা বাজেট তৈরি হতে হবে ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালে উপজেলা পর্যায়ে নির্ধারিত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তার পরিবর্তে জাতীয় বাজেট শুধু জেলার জন্য ভাগ করে দেখানো একটি অর্থবহ এক্মারসাইজ হবে না। এ জন্য অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠন করতে হবে।
বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে মাননীয় সংসদ সদস্যদের ভূমিকা থাকা জরুরি। বর্তমানে বাজেট পাসের সময়ে 'হ্যাঁ/না' বলার বাইরে এবং নির্ধারিত বাজেট আলোচনার সময়ে দলীয় নেতানেত্রীদের তোষামোদ ও বিরোধীদের দোষারোপ এবং নিজস্ব নির্বাচনী এলাকার কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরা ছাড়া তারা তেমন কোনো ভূমিকাই পালন করেন না। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও বাজেট বিশ্লেষণ এবং এ সম্পর্কে কোনো গভীর আলোচনার সূত্রপাত করে না। ফলে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংসদের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না।
শোনা যায়, আগামী বছরের বাজেটের কলেবর হবে আনুমানিক ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। এত বিরাট অঙ্কের বাজেট হলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যেকের বাজেটের হিস্যা হবে প্রায় ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের মোট হিস্যা প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ টাকা প্রত্যেক পরিবারের প্রাপ্য নয়, তবে এর সমপরিমাণ অঙ্কের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি সেবা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু তারা কি তা পায়? নাকি তার পরিবর্তে তারা তাদের অর্থপুষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়? অনেকের ধারণা, সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ জনগণের কল্যাণের পরিপন্থী (যেমন বাসে চলাচলকারী যাত্রীদের, পুঁজি বাজারে শেয়ার বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে) কাজ করে এবং অনেক সরকারি অর্থেরই অপব্যবহার ও অপচয় হয়। তাই সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাজেটের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আরেকটি কারণেও বাজেটে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে কতগুলো সুস্পষ্ট অঙ্গীকারের ভিত্তিতে, যেগুলো তাদের দিনবদলের সনদ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত। দিনবদলের সনদে ২৩টি অগ্রাধিকার রয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি হলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার : ১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দার মোকাবেলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা; ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা; ৩. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান করা; ৪. দারিদ্র্য ঘুচানো ও বৈষম্য রোখার লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করা; এবং ৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
নির্বাচনী ইশতেহার বস্তুত রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের মধ্যে সম্পাদিত একটি লিখিত চুক্তি, যদিও এটি স্বাক্ষরিত নয়। তাই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ইশতেহারে প্রদত্ত অঙ্গীকারগুলো, আইনগতভাবে না হলেও অন্তত নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই পালনীয়। তাই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ পাঁচটি অগ্রাধিকাার বাস্তবায়নের প্রতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। তবে অন্য অগ্রাধিকারগুলোও উপেক্ষা করলে চলবে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নই হওয়া উচিত বাজেট প্রণয়নের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
আসন্ন বাজেটে সরকারকে অবশ্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান, তেল ও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং আহরণ ইত্যাদির প্রতি অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থানের প্রতিও অধিক জোর দেওয়া আবশ্যক।
একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, উপরিউক্ত পাঁচটি অগ্রাধিকারের অনেকগুলোই সুশাসন সম্পর্কিত। যেমন দুর্নীতি দমন শিরোনামের অগ্রাধিকারে বলা হয়েছে : 'দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।' একই সঙ্গে বিরাজমান আয় ও সুযোগের বৈষম্য দূরীকরণের অঙ্গীকারও দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা আবার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।
এ ছাড়াও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রক্ষার লক্ষ্যে দিনবদলের সনদে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ শক্ত হাতে দমন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত, বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় কার্যকর ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পুনর্বিচার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার, বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার কথাও এতে বলা হয়েছে। উপরন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও এতে ব্যক্ত করা হয়েছে।
আরও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত রাখার, জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও এর মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করার এবং সংসদে মতামত ব্যক্ত করার ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের নিজস্ব বিবেক-বিবেচনা সীমিত আকারে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করার। রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ করার, ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষুষ্ণতা গড়ে তোলার, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ করার ও ক্ষমতাধরদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিও দিনবদলের সনদে রয়েছে।
দিনবদলের সনদে আরও বলা হয়েছে : 'দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে। প্রশাসনিক সংস্কার, তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ই-গভর্নেন্স চালু করা হবে ... জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে।'
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আরও প্রয়োজন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন। কেন্দ্রীভূত শাসন পদ্ধতি, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির এখতিয়ারে থাকে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটায়। তাই সম্পদ, ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব তৃণমূলের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে হস্তান্তর করার বিষয়টি, যা দিনবদলের সনদের ষষ্ঠতম অগ্রাধিকার, বাজেটে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। উল্লেখ্য, নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তৃণমূলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে, রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয় না।
দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি অগ্রাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রেও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বস্তুত মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেটুকু সফলতা অর্জন করেছে, তা ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখা বহুলাংশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করবে। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন অর্জিত হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। মানবাধিকার সংরক্ষিত হবে। সমাজে সমতা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন হয় না। যেমন ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রদান ও প্রকাশ, তাদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন ইত্যাদি। এ জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা, যা বর্তমান সরকার গত প্রায় আড়াই বছর মেয়াদকালে বলিষ্ঠভাবে দেখাতে পারেনি। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন। আমরা আশা করি, আসন্ন বাজেটে সেসব খাত অগ্রাধিকার পাবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক সুজন_ সুশাসনের জন্য নাগরিক
No comments