বিশেষ অধিকার by ইফতেখার আমিন
কানের কাছে সেলফোন বেজে উঠতে সকালের ঘুম ঘুম মিষ্টি আমেজটা চলে গেল কবিরের। না শোনার ভান করে পড়ে থাকার চেষ্টা করল সে। চাইছে, জেনি ধরুক। কিন্তু ধরছে না। তার মানে ও রান্নাঘরে। একবার, দুবার বেজে থেমে গেল রিং। তৃতীয়বার শুরু হতে ‘ধ্যাত্তোরি!’ বলে হাত বাড়াল কবির।
‘হ্যালো!’
‘আমি হিমেল, কবির ভাই।’
তার প্রতিবেশী ছেলেটা। ‘হিমেল! এত সকালে কী মনে করে?’
হাসি শোনা গেল হিমেলের। ‘১০টা বাজে। এখনো সকাল?’
সে-ও হাসল। ‘কেন ফোন করেছ বলো।’
‘আজকের পত্রিকা দেখেছেন?’
‘না, এখনো দেখা হয়নি।’
‘বাসায় কোন পত্রিকা রাখেন?’
‘ভোরের আলো। কেন?’
‘না...জনতার কণ্ঠে আপনাকে নিয়ে খবর আছে।’
‘আমাকে নিয়ে খবর?’ কৌতূহল জাগল কবিরের। ‘কিসের?’
হিমেল আমতা আমতা করতে লাগল। ‘ইয়ে...আপনি নিজে পড়ে দেখেন, ভাই।’ বুঝতে অসুবিধা হলো না, বিব্রত বোধ করছে।
ঘুম মাথায় উঠল। তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল কবির। কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে ব্রাশ বোলাল চুলে। তারপর গলির মাথার খবরের কাগজ-বিক্রেতার দোকানের দিকে চলল ব্যস্ত পায়ে। হিমেলের হাসিটা ভালো লাগেনি। মনে হয়, তাকে নিয়ে বাজে কিছু লিখেছে জনতার কণ্ঠ। রাস্তায় দাঁড়িয়েই পত্রিকায় চোখ বোলাল সে। বেশি খুঁজতে হলো না, প্রথম পৃষ্ঠাতেই আছে খবরটা। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন শিরোনামে।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল কবির। তারপর স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল চোখ বড় করে। ‘আশ্চর্য!’ হুঁশ ফিরতে তাড়াতাড়ি পত্রিকা ভাঁজ করে ডানে-বাঁয়ে তাকাল, আর কেউ দেখে ফেলল কি না বোঝার জন্য। না, সে রকম কেউ নেই।
জেনি নাশতা সাজাচ্ছিল, স্বামীকে ফ্যাকাশে চেহারায় ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, ‘কী হয়েছে?’
কবির পত্রিকা এগিয়ে দিল। ‘পড়ো!’ টোকা দিয়ে খবরটা দেখাল।
পড়তে পড়তে জেনির স্নিগ্ধ চেহারা কালো হয়ে উঠল। ‘সে কী! এরা বলতে চাইছে তুমিও এসবের সঙ্গে জড়িত!’
‘বলতে চাইছে মানে কী? বলে ফেলেছে, চোখে পড়ছে না!’ অসহ্য রাগ অদৃশ্য ধোঁয়ার মতো ফেনিয়ে উঠছে তার বুকের মধ্যে। ‘শালার সাংবাদিক! এমনভাবে লিখেছে যেন আমিও এই নোংরামির সঙ্গে জড়িত! ইশ্! মানুষের সামনে মুখ দেখানোর উপায় থাকল না...ব্যাটা আমার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে পারত। ‘রিপোর্টারের নাম কী যেন?’
‘সাগর গুপ্ত।’
রাগে দিশেহারা অবস্থা হলো কবিরের। নাশতা খাওয়ার সময় নেই। এক কাপ চা কোনোমতে গিলে চেনা এক আইনজীবীর বাড়িতে ছুটল সে। ঘটনা শুনল আইনজীবী, খবরে চোখ বোলাল।
‘এর প্রতিকার কী?’ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে কবির।
‘আগে বলুন, এমন অভিযোগ উঠল কেন।’
‘আমি জানি না। সত্যি বলছি। আমার এক বন্ধুর বায়িং হাউস আছে...মানে ছিল! ওর নাম হাবিব। ও আমার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা ধার নিয়েছিল তিন মাস পর ফেরত দেবে বলে। দিতে না পারলে আমাকে কোম্পানির ২৫ পারসেন্টের মালিক করে নেবে। আমি জানতাম না, ও আরও অনেকের কাছ থেকে একই কথা বলে টাকা নিয়েছে। যখন জেনেছি তখন সব শেষ।’
‘কিন্তু...খবরে লিখেছে, হাবিবের সঙ্গে আপনিও জড়িত। আপনারা দুজন সবার টাকা মেরে খেয়েছেন। এমন অভিযোগ উঠবে কেন?’
‘আমি এসবের কিছু জানিই না! হয়তো অন্যরা অভিযোগ তুলেছে...আমি হাবিবের বন্ধু বলে। ব্যবসা নিয়ে হাবিব একমাত্র আমার সঙ্গেই পরামর্শ করত। ওর হয়ে মাঝেমধ্যে এখানে-সেখানে ছোটাছুটি করতাম, তাই হয়তো ধরে নিয়েছে...’
‘সেসব এ রকম সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলার কারণ হতে পারে না।’
‘তা জানি না।’ জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লেখা একটা চুক্তি বের করে দেখাল কবির। ‘এই যে, আমি যে হাবিবকে টাকা দিয়েছি, তার ডিড।’
ওটা ভালো করে দেখল উকিল। ‘আপনার বন্ধু কোথায়?’
‘খোঁজ নেই।’
‘তার বায়িং হাউস?’
‘ওর কাছে আর যারা টাকা পাবে, তারা তালা লাগিয়ে দিয়েছে। এখন এর প্রতিকার কী?’
‘নিয়ম অনুযায়ী পত্রিকাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে হবে। মিথ্যা খবর ছাপানোর জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে যেখানে খবরটা ছাপা হয়েছে, ঠিক সেখানে প্রতিবাদ ছাপাতে বলতে হবে। আর যদি ওদের কাছে অন্য কোনো প্রমাণ থাকে, যা আপনার বিরুদ্ধে যেতে পারে, তাহলে...’
‘অসম্ভব! যার অস্তিত্বই নেই, তা থাকবে কীভাবে?’
‘ঠিক আছে। তাহলে নোটিশ পাঠাচ্ছি।’
তাই করা হলো। তারপর অনিশ্চিত প্রতীক্ষায় ছটফট করে বেড়াতে লাগল কবির। একদিকে লোকসানের ধাক্কা, অন্যদিকে অকারণে বেইজ্জতি—সব মিলিয়ে অবস্থা বেহাল। চেনা-পরিচিতদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে লাগল সে। দুটো ব্যবসায়িক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হতে হতেও শেষ পর্যন্ত হলো না। লোকসানের ওপর লোকসান, কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায়ও থাকল না। রোজ সকালে জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদ খোঁজে কবির, তারপর হতাশ হয়। এক দিন-দুই দিন করে তিন সপ্তাহ কেটে গেল। কোনো খবর নেই।
আরও কয়েক দিন পর উকিলের ফোন পেয়ে দেখা করতে এল সে। পত্রিকার আইনজীবী তার নোটিশের জবাব দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কবির আলমের লিগ্যাল নোটিশ সম্পর্কে সম্পাদক সাহেব অবহিত আছেন। তবে দেরি হয়ে যাওয়ায় সেটা আর প্রথম পাতায় ছাপানোর উপায় নেই। তিনি এ বিষয়ে নতুন করে প্রতিবাদ পাঠালে চিঠিপত্র কলামে ছেপে দেওয়া হবে।
‘চিঠিপত্র কলামে মানে?’ কবির বলল।
‘এ ধরনের প্রভাবশালী পত্রিকা তাদের খবরের প্রতিবাদই পারতপক্ষে ছাপাতে চায় না, ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা। অবশ্য প্রতিবাদকারী খুব প্রভাবশালী হলে আলাদা কথা।’
‘তার মানে এর প্রতিকার হবে না?’
‘আপনি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ জানান।’
‘ওরা কী করতে পারবে?’
‘বেশি কিছু না। ওদের ক্ষমতা তিরস্কার করা পর্যন্ত।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কবির। ‘বিকল্প কী উপায় আছে?’
‘পত্রিকার বিরুদ্ধে রিট ইস্যু করানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। তাহলে বাড়াবাড়ি না করে হয়তো প্রতিবাদ ছেপে দেবে ওরা।’
‘হয়তো?’
মাথা দোলাল উকিল। ‘হয়তো। অথবা হয়তো গায়েই মাখবে না ওসব।’ মক্কেলের চেহারায় আঁধার ঘনাতে দেখে ঝুঁকে বসল সে। ‘আপনাকে খুলেই বলি। আসলে এসবের প্রতিকার করার মতো কোনো বিশেষ আইন নেই আমাদের দেশে।’
‘তার মানে যাকে চিনি না, জানি না, জীবনে কখনো হয়তো দেখিওনি, সে সাংবাদিক হয়েছে বলে যা খুশি তাই লিখে আমাকে সমাজের চোখে হেয় করবে। আর আমি নিরপরাধ হয়েও এতবড় অন্যায়ের প্রতিকার পাব না?’
‘এই সাংবাদিকের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত কোনো ঝগড়া নেই তো?’
‘ব্যাটাকে জীবনে কখনো চোখেও দেখিনি।’
‘তাহলে...মামলা করা যাবে না, বলছি না। করা যাবে। তবে এসবের জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় যেমন বিশেষ আইন আছে, আমাদের তা নেই। কিছু করতে হলে প্রচলিত আইনেই করতে হবে।’
‘তাই করুন।’
‘আপনি চাইলে করব। কিন্তু প্রতিবেশী হিসেবে আপনাকে একটা পরামর্শ দিই কবির সাহেব। এ ধরনের মামলায় অনেক খরচ হয়।’
‘কী রকম খরচ?’
‘অনেক। তার কোনো সীমা নেই।’
চুপ করে থাকল কবির।
‘আপনার টাকাপয়সা কেমন আছে?’
‘ছোটখাটো ব্যবসা করি। তার ওপর বন্ধুকে টাকা ধার দিয়ে বিপদে আছি। এই হলো অবস্থা।’
‘তাহলে এসবে আপনার না জড়ানোই ভালো।’
‘ক্ষতিপূরণের মামলা করা যায় না?’
‘যায়। তাতে যদি রায় আপনার পক্ষেও হয়, টাকা পেতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। তা ছাড়া মামলায় আপনি জিতে গেলেই জনতার কণ্ঠ হাত গুটিয়ে নেবে না। রিট নিশ্চয়ই করবে ওরা। তাহলে টাকার থলিটা আপনার নাকের সামনে ঝুলে থাকবে। কত বছরের জন্য কে জানে? সে ক্ষেত্রে আপনার খরচ...বুঝতেই পারছেন। ওদের গায়ে খরচের ধাক্কা লাগবে না। কিন্তু আপনার লাগবে।’
‘তা ঠিক।’
‘তা ছাড়া রিট হলে মামলা প্রথম থেকে নতুন করে শুরু হবে। পত্রিকা তখন সুনাম ধরে রাখতে নিজেকে ডিফেন্ড করবে। মামলা যত দিন চলবে, তত দিন বিষয়টা নিয়ে লেখালেখি করবে। ফাঁক খুঁজে নিয়ে আপনার গায়ে কাদার ছিটা লাগাতেও চেষ্টা করবে তার সঙ্গে। যারা তত দিনে বিষয়টা ভুলে গেছে, তারা আবার নতুন করে সব জানবে। বাসি হয়ে যাওয়া বিষয়টা তাজা হবে...আলোচনা হবে।’
‘ওরা তাই করবে?’
‘করবে না কেন? পত্রিকা নিজেকে ডিফেন্ড করবে না? অন্য পত্রিকাও এ নিয়ে লিখবে। সব পত্রিকাই তো আইন-আদালত বিষয়ে প্রতিদিন খবর ছাপে।’
‘সবাই লিখবে?’ বলল কবির।
‘লিখবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া কোর্টের কার্যক্রম চলার সময় যা কিছু আলোচিত হয়, তা নিয়ে লেখা তো হয়-ই।’ বলতে বলতে কিছু একটা মনে পড়ল আইনজীবীর। ‘একটা উপায় পেয়েছি মনে হয়!’
এক ঘণ্টা পর আইনজীবীর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল কবির। বিকেলে জনতার কণ্ঠে টেলিফোন করল। ‘আমি সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
অপারেটর প্রশ্ন করল, ‘কে বলছেন, স্যার?’
‘আমার নাম কবির আলম।’
‘কোন বিষয়ে কথা বলতে চান?’
‘সেটা সম্পাদক সাহেবকেই বলব। আপনি ওনাকে বলুন আমার কথা।’
কয়েক মুহূর্তের জন্য লাইন নীরব হয়ে গেল। তারপর, ‘আপনাকে বিষয়টা বলতে হবে, স্যার। সম্পাদক সাহেব আপনার প্রয়োজনের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত কি না, আগে জানাতে হবে।’
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল কবির। বুঝতে পারছে, তার অনুরোধ নাকচ হতে যাচ্ছে। তবু কারণটা সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘আমার কিছু বলার ছিল। আমি সম্পাদক সাহেবকে...’
‘জাস্ট এ মিনিট।’ আবার কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল লাইন। তারপর, ‘সরি, স্যার। সম্পাদক সাহেব এখন মিটিংয়ে আছেন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। উনি খুব ব্যস্ত মানুষ, স্যার। খুবই ব্যস্ত। আপনি বরং তাকে চিঠিতে ঘটনাটা জানান।’
লাইন কেটে যাওয়ার শব্দ কানে আসতে চোখ বুজল কবির। দুটো গাল দিল সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। পরদিন বিকেলে সাগর গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে জনতার কণ্ঠের অফিসে হাজির হলো সে। কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। এক অফিস সহকারী জানাল, বাইরে ব্যস্ত আছেন তিনি। কখন ফিরবেন, রাতে আদৌ ফিরবেন কি না, ঠিক নেই। ‘কোনো মেসেজ থাকলে আমাকে বলে যান।’
কবির হতাশ চেহারায় বলল, ‘উনি নেই? একটা অনুসন্ধানী রিপোর্ট সম্পর্কে তথ্য দিতে চেয়েছিলাম।’
লেখার প্যাড টেনে নিল সহকারী। ‘আপনার নাম আর মোবাইল নম্বর বলুন, স্যার। আমি লিখে রাখি। উনি ফিরলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলব।’
না শোনার ভান করল কবির। ‘ওনার বাসার ঠিকানা দিন। আমি গিয়ে...’
মাথা নাড়ল সহকারী। ‘অপরিচিত কাউকে বাসার ঠিকানা দেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের। আপনি...’
না শোনার ভান করে কয়েকটা কাগজ বের করে চোখ বোলাল সে। ‘কাল দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি...খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর!’
‘আর কাউকে দিয়ে যেতে চাইলে...’
‘নাহ্। থাক তাহলে।’
‘স্যার, আপনার ফোন নম্বরটা?’
‘কী লাভ? বিদেশে চলে যাব বললাম না? দেখি, ভোরের আলোয় যদি...’
কবির দুই পা যেতে সিদ্ধান্ত পাল্টাল সহকারী। ‘দাঁড়ান। অচেনা কাউকে ঠিকানা দিই না আমরা। নিয়ম নেই। কিন্তু আপনি যখন...আপনাকে দিলাম খবরটা জরুরি বলে।’ সাগর গুপ্তের ঠিকানা, সেল নম্বর লিখে এগিয়ে দিল। ‘এই যে। কাল সাগর স্যারের ডে অফ। সকালে গেলে বাসায় পাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’
পরদিন সকাল ঠিক নয়টার সময় সাগর গুপ্তের বন্ধ দরজায় নক করল কবির। বাসাটা মগবাজারের এক সরু গলিতে। ভেতর থেকে গম্ভীর গলা সাড়া দিল, ‘কে?’
জবাব না দিয়ে আবার নক করল কবির। ঝট করে দরজা খুলে গেল। ঘোড়ার মতো লম্বাটে একটা মুখ উঁকি দিল। বদরাগি চেহারা। গালে দুই দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নাকের ডগায় লটকে আছে গোল চশমা। হাতে খবরের কাগজ। ‘কাকে চান?’
‘সাগর গুপ্তকে।’
তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল লোকটা। ‘কেন?’
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ! কী চাই?’
‘ও। দেখুন, পাঁচ সপ্তাহ আগে জনতার কণ্ঠে আপনার লেখা এই আর্টিকেলটার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি আমি।’ তার চোখের সামনে পেপার কাটিংটা তুলে ধরল কবির।
নাক কুঁচকে চশমাটা আধা ইঞ্চি খানেক ওপরে তুলে দেখল ওটা সাংবাদিক। ‘এ নিয়ে বলার কী আছে?’
‘এই আর্টিকেলে আপনি আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। অনেক আজেবাজে কথা লিখেছেন, যার কোনোটাই সত্যি নয়। এই রিপোর্টের কারণে আমাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে।’
রেগে উঠল সাংবাদিক। ‘আপনি কে বলুন তো!’
‘বলেইছি তো, যার বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট লিখেছেন আপনি।’
ধৈর্য হারিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল সাংবাদিক। ‘তো কী? কৈফিয়ত তলব করতে এসেছেন? আমার ঠিকানা কে দিয়েছে আপনাকে? কিছু বলার থাকলে অফিসে প্রতিবাদ পাঠাতে পারতেন আপনি, লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে পারতেন...’
‘আমি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলাম, আপনারা পাত্তা দেননি,’ শান্ত কণ্ঠে বলল সে। ‘সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম, পারিনি। আপনাকেও পাইনি যে...’
‘তাহলে আর কী? আমার মাথা কিনে নিয়েছেন! যান এখান থেকে!’
রাগ হলেও নিজেকে শান্ত রাখল সে। ‘আমার কথা...’
‘কোনো কথা নেই!’ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সাগর গুপ্ত। ‘এক্ষুনি চলে যান এখান থেকে। নইলে আমি পুলিশ ডাকব।’ লোকটার পেছনে একটা উদ্বিগ্ন নারীমুখ দেখা গেল। উঁকি দিয়ে কবিরকে দেখার চেষ্টা করছে।
মাথায় রক্ত চড়ে গেল ওর। তবু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, ‘আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি। সেটা অন্তত নিন।’
‘কী জিনিস?’
‘এই যে,’ বলে তার নাকের ডগায় দুম করে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল সে।
‘মা গো!’ বলে নাক চেপে ধরে বসে পড়ল লোকটা। দেখতে দেখতে তাজা রক্তে হাত ভরে উঠল তার। পরক্ষণে দড়াম করে দরজা লেগে গেল।
বড় রাস্তায় চলে এল কবির। সামনেই ছোকরা বয়সী এক পুলিশ দেখে বলল, ‘তাড়াতাড়ি আসেন। এই গলিতে একটা মারামারির ঘটনা ঘটেছে।’
‘মারামারি? কুন হানে?’
‘আসেন জলদি!’ বলে দ্রুত সাগর গুপ্তের বাড়ির সামনে ফিরে এল সে। বন্ধ দরজায় নক করে বলল, ‘এই বাড়িতে।’ একটু পর সেই মহিলা উঁকি দিল। এ মুহূর্তে আতঙ্কিত সে। কনস্টেবলকে দেখিয়ে কবির তাকে বলল, ‘ইনি গুপ্ত বাবুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন।’
মহিলা অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘোড়ামুখো দেখা দিল তার জায়গায়। বড় একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে নাকমুখ চেপে ধরে আছে। নাক টানছে ঘন ঘন। কবিরকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। ‘কী...!’
কনস্টেবল একবার কবিরকে, একবার সাগর গুপ্তকে দেখছে। ‘এই যে,’ কবির বলল। ‘এই ভদ্রলোককে মারা হয়েছে।’
সাংবাদিকের দিকে ফিরল কনস্টেবল। ‘সত্য নি?’
মাথা ঝাঁকাল সাংবাদিক। এক ফোঁটা রক্ত পড়ল মেঝেতে।
কবির বলল, ‘কে মেরেছে জানেন? আমি মেরেছি।’
‘অ্যাঁ!’ বেকুব হয়ে গেল কনস্টেবল। ‘কিয়ারে?’
‘সেটা আমি থানায় গিয়ে বলব।’
আধা ঘণ্টা পর রমনা থানার ডিউটি অফিসার একই প্রশ্ন করল তাকে। ‘মারলেন কেন?’
‘মারলাম!’ কবির নির্বিকার।
‘লোকটা কে?’
‘সাংবাদিক।’
‘অ। মেরে আবার অভিযোগ লেখাতে এলেন কেন?’
‘অন্যায় করলে তা স্বীকার করা প্রতিটি সুনাগরিকের কর্তব্য, তাই না? আমি অপরাধ স্বীকার করেছি। আপনি অভিযোগ লিখুন।’
কৌতুকের দৃষ্টিতে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল ডিউটি অফিসার। হাই তুলল অলস ভঙ্গিতে। তারপর কনস্টেবলের দিকে ফিরল। ‘বেশি মেরেছে? আঘাত কেমন?’
‘নাকের বারিন্দা ছুডায়া ’লাইছে, স্যার। ঘুষা দা।’
চেহারা ত্যাড়া করে কান চুলকালো ডিও। ‘ঠি-ই-ক আছে। এসব ছোটখাটো অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট লেখানোর প্রয়োজন নেই। চলে যান আপনি।’
‘লিখবেন না? তাহলে কিন্তু আমি গিয়ে আবার পেটাব ওই লোককে।’
নড়েচড়ে বসল ডিউটি অফিসার।
মামলা উঠল কোর্টে। বাড়িতে চড়াও হয়ে মারধরের মামলা। তার আগের দিন সন্ধ্যায় কে বা কারা যেন সব জাতীয় দৈনিক আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টেলিফোন করে মামলার খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল। ফলে সময়মতো দেখা গেল সাংবাদিক আর টিভি রিপোর্টার-ক্রুদের ভিড় লেগে গেছে। এত সতীর্থ দেখে বিভ্রান্ত হলো সাগর গুপ্ত। সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে এর-ওর দিকে। তারাও কৌতূহলের চোখে তাকে আর কবিরকে দেখছে। কবির নির্বিকার। আইনজীবীর পরামর্শ শুনছে মন দিয়ে।
কার্যক্রম শুরু হলো। পুলিশের কোর্ট জিআরও সাগর গুপ্তের হয়ে ঘটনার বর্ণনা দিল। আসামি নিজেই থানায় গিয়ে অভিযোগ লিখিয়েছে শুনে দর্শকদের একটু অবাক হতে দেখা গেল। কারণ, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। একটু পর কাঠগড়ায় তোলা হলো আসামি কবিরকে। শপথ করানো হলো। তারপর আরেকবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের অপরাধ কবুল করে নিল সে।
বিচারক তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। ‘আপনি বুঝেশুনে অপরাধ স্বীকার করছেন?’
‘করছি, মাননীয় আদালত।’ দর্শকদের মধ্যে বিস্ময়ের গুঞ্জন উঠল।
‘এতে আপনার সাজা হতে পারে জানেন তো?’
‘জানি।’
‘আই সি!’
‘মাননীয় আদালত,’ কবির বলল। ‘আপনার অনুমতি পেলে আমি বিশেষ অধিকারবলে কিছু বলতে চাই।’
বিচারক বললেন, ‘মামলার সঙ্গে সেসবের সম্পর্ক আছে?’
‘জি, আছে।’
‘বেশ। অনুমতি দিলাম।’
কবিরের উকিল পেশকারের হাতে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিতে সে তা বিচারকের সামনে রাখল। তিনি চোখ বোলালেন সেগুলোয়।
‘ইয়োর অনার, আপনার হাতের ওটা একটা পেপার কাটিং। জনতার কণ্ঠে ছয় সপ্তাহ আগে আমার বিরুদ্ধে সাগর গুপ্তের লেখা। ওটার মাধ্যমে তিনি আমার নামে ভিত্তিহীন, মর্যাদাহানিকর কুৎসা রটিয়ে একটা চরম অন্যায় করেছেন। সামাজিকভাবে আমাকে হেয় করেছেন। আপনার সামনে একটা লেনদেনের অ্যাগ্রিমেন্টও আছে, মাননীয় আদালত। সাগর গুপ্ত যে কোম্পানির সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে আর্টিকেলটি লিখেছেন, ওই অ্যাগ্রিমেন্টই বলবে তা কত বড় মিথ্যা।’
বিচারককে ওগুলোয় চোখ বোলানোর সময় দিয়ে আবার শুরু করল সে। ‘ওই কোম্পানি কিছুদিন আগে পথে বসেছে। আমি ওটায় ২০ লাখ টাকা খাটিয়েছিলাম। টাকা খাটিয়ে আমি নিজেই বিপদে পড়েছি। কিন্তু পত্রিকায় কী লেখা হয়েছে, দেখুন। ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে এমনভাবে কেচ্ছা ফাঁদা হয়েছে, যেন কোম্পানির মালিকের মতো আমিও এ জন্য দায়ী। এটা ছাপানোর আগে একবারও ভেতরের কাহিনি জানার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি এই সাংবাদিক নামের কলঙ্ক।’
মৃদু গুঞ্জন উঠল কোর্টরুমে। সাংবাদিকেরা সাগর গুপ্তকে দেখল। তাদের দৃষ্টিতে বিদ্রূপ আর করুণা ছাড়া কিছু নেই। প্রভাবশালী পত্রিকার প্রভাবশালী সাংবাদিককে ফাটা বাঁশে আটকা পড়তে দেখে সবাইকে বেশ খুশি খুশি লাগছে।
‘ইয়োর অনার,’ কবিরের বক্তব্যে বাধা দেওয়ার দুর্বল চেষ্টা করল সাগর গুপ্ত, ‘এখানে...এসব নিয়ে টানাটানির...’
‘ডোন্ট টক!’ বিচারক গম্ভীর। ‘আপনাকে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিছু বলার থাকলে পরে সুযোগ পাবেন।’ কবিরের অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার ভালো করে দেখে তার দিকে ফিরলেন তিনি। ‘আপনার এই প্রতিবেদনের সূত্র কী? এতসব অভিযোগ কিসের ভিত্তিতে তোলা হয়েছে?’
গুপ্ত নীরব থাকল ত্রিশ সেকেন্ড। ‘আমি অন্য ভিকটিমদের কথার ওপর ভিত্তি করে এটা লিখেছি।’
‘কোনো ডকুমেন্ট...?’
আবারও খানিক নীরব থেকে মাথা নাড়ল সে। ‘না...ডকুমেন্ট নেই।’
বিচারকের দৃষ্টি কবিরের ওপর ফিরে এল। ‘সে ক্ষেত্রে আসামি কিছু বলতে চাইলে আমি আপত্তি তোলার কারণ দেখি না। কেননা, এই অ্যাগ্রিমেন্ট আপনার রিপোর্টিংয়ের বিপক্ষে বলছে।’
সাগর গুপ্ত নতমুখে বসে পড়ল। বিচারক কবিরকে বললেন, ‘আপনি বলুন।’
‘ধন্যবাদ, ইয়োর অনার। এই তথাকথিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক যদি রিপোর্টটা লেখার আগে আমার সঙ্গে কথা বলার কষ্ট স্বীকার করত, তাহলে আসল বিষয়টা সহজেই জেনে নিতে পারত। তা না করে কোথায় কোন মদের আড্ডায়, না জুয়ার...’
লাফিয়ে উঠল সাগর গুপ্ত। ‘ইয়োর অনার! লোকটা যা খুশি তাই...’
‘সাইলেন্স!’ ধমক মারলেন বিচারক। ‘বলেছি আপনার কথা পরে শোনা হবে।’ কবিরের দিকে ফিরলেন বিচারক। ‘আপনি সংযত ভাষায় কথা বলুন।’
‘জি, ইয়োর অনার। বলছিলাম, সাংবাদিকতার নামে চালিয়ে দেওয়া এই মিথ্যার ধাক্কায় আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আমি বুঝি না, এই লোকটা কোন অধিকারে আমার মতো খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষের জীবন বিষিয়ে তুলেছে। মাননীয় আদালত, এর নাম কি সাংবাদিকতা?’
বিচারক বললেন, ‘আপনার মনে ক্ষোভ জমার সংগত কারণ আছে। আমি বুঝি। কিন্তু এর প্রতিকার আর কোনোভাবে করা যেত না?’
‘আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, ইয়োর অনার। লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি প্রতিবাদ ছাপানোর দাবিতে, জনতার কণ্ঠ ছাপেনি। সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বোঝাতে চেয়েছি, তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত বলে আমাকে সময় দিতে পারেননি। পারেননি না, আসলে দেননি। এই লোকের সঙ্গে দেখা করতে অফিসে গিয়েছি। সেখানে না পেয়ে তার বাসায় যাই। কিন্তু...’
মাথা নাড়লেন বিচারক। ‘কিন্তু সহিংসতা কখনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।’
‘আমি গিয়েছিলাম এই লোকের সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়ে বলে যদি কোনো প্রতিকার করা যায়, সেই আশায়। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। সমাজে চলে-ফিরে খেতে হয়। কিন্তু এই একটা ভুয়া, বানোয়াট রিপোর্ট লিখে যে মারাত্মক ক্ষতি করেছে, তাতে আমার সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ইয়োর অনার। একের পর এক ব্যবসা ছুটে যাচ্ছিল হাত থেকে। বাইরে মুখ দেখাতে পারছিলাম না। আপনজনেরা পর্যন্ত আমাকে করুণা করছে। তাই গিয়েছিলাম। কিন্তু এ উল্টো আমাকেই পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেওয়াতে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।’
সাগর গুপ্তের দায়িত্বহীনতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকল না বিচারকের মনে। তাই তাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি।
দুপুরের বিরতির পর রায় ঘোষণা করা হলো। সাগর গুপ্তকে ভবিষ্যতে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে কলম ধরতে কঠোর ভাষায় সতর্ক করলেন বিচারক। আসামি কবির আলমকেও তার আচরণের জন্য সতর্ক করা হলো এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হলো সাগর গুপ্তের চিকিৎসার খরচ বাবদ।
উকিলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসছে কবির। সিঁড়িতে কেউ হাত টেনে ধরতে ঘুরে তাকাল। সাগর গুপ্ত। চোখ গরম করে চেয়ে আছে। কবির হাসল। ‘হাত সরাও। আজ এত সাংবাদিক এখানে হাওয়া খেতে আসেনি মনে রেখো।’
চোখ ছোট হয়ে এল সাগর গুপ্তের। ‘এদেরকে...তুমি ডেকেছ?’
‘না ডাকলে দেশবাসীকে কীভাবে জানাতাম, তুমি কেমন সাংঘাতিক? ওরা এসেছিল বলেই না কালকের পত্রিকা পড়ে সবাই তা জানতে পারবে।’
দাঁতে দাঁত চাপল সাগর গুপ্ত। ‘ভেবেছ...এভাবে পার পেয়ে যাবে তুমি?’
আবার হাসল কবির। ‘সমস্যা নেই। না পেলে প্রতিকারের অন্য কোনো উপায় খুঁজে নেব।’
বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে
‘আমি হিমেল, কবির ভাই।’
তার প্রতিবেশী ছেলেটা। ‘হিমেল! এত সকালে কী মনে করে?’
হাসি শোনা গেল হিমেলের। ‘১০টা বাজে। এখনো সকাল?’
সে-ও হাসল। ‘কেন ফোন করেছ বলো।’
‘আজকের পত্রিকা দেখেছেন?’
‘না, এখনো দেখা হয়নি।’
‘বাসায় কোন পত্রিকা রাখেন?’
‘ভোরের আলো। কেন?’
‘না...জনতার কণ্ঠে আপনাকে নিয়ে খবর আছে।’
‘আমাকে নিয়ে খবর?’ কৌতূহল জাগল কবিরের। ‘কিসের?’
হিমেল আমতা আমতা করতে লাগল। ‘ইয়ে...আপনি নিজে পড়ে দেখেন, ভাই।’ বুঝতে অসুবিধা হলো না, বিব্রত বোধ করছে।
ঘুম মাথায় উঠল। তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল কবির। কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে ব্রাশ বোলাল চুলে। তারপর গলির মাথার খবরের কাগজ-বিক্রেতার দোকানের দিকে চলল ব্যস্ত পায়ে। হিমেলের হাসিটা ভালো লাগেনি। মনে হয়, তাকে নিয়ে বাজে কিছু লিখেছে জনতার কণ্ঠ। রাস্তায় দাঁড়িয়েই পত্রিকায় চোখ বোলাল সে। বেশি খুঁজতে হলো না, প্রথম পৃষ্ঠাতেই আছে খবরটা। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন শিরোনামে।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল কবির। তারপর স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল চোখ বড় করে। ‘আশ্চর্য!’ হুঁশ ফিরতে তাড়াতাড়ি পত্রিকা ভাঁজ করে ডানে-বাঁয়ে তাকাল, আর কেউ দেখে ফেলল কি না বোঝার জন্য। না, সে রকম কেউ নেই।
জেনি নাশতা সাজাচ্ছিল, স্বামীকে ফ্যাকাশে চেহারায় ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, ‘কী হয়েছে?’
কবির পত্রিকা এগিয়ে দিল। ‘পড়ো!’ টোকা দিয়ে খবরটা দেখাল।
পড়তে পড়তে জেনির স্নিগ্ধ চেহারা কালো হয়ে উঠল। ‘সে কী! এরা বলতে চাইছে তুমিও এসবের সঙ্গে জড়িত!’
‘বলতে চাইছে মানে কী? বলে ফেলেছে, চোখে পড়ছে না!’ অসহ্য রাগ অদৃশ্য ধোঁয়ার মতো ফেনিয়ে উঠছে তার বুকের মধ্যে। ‘শালার সাংবাদিক! এমনভাবে লিখেছে যেন আমিও এই নোংরামির সঙ্গে জড়িত! ইশ্! মানুষের সামনে মুখ দেখানোর উপায় থাকল না...ব্যাটা আমার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে পারত। ‘রিপোর্টারের নাম কী যেন?’
‘সাগর গুপ্ত।’
রাগে দিশেহারা অবস্থা হলো কবিরের। নাশতা খাওয়ার সময় নেই। এক কাপ চা কোনোমতে গিলে চেনা এক আইনজীবীর বাড়িতে ছুটল সে। ঘটনা শুনল আইনজীবী, খবরে চোখ বোলাল।
‘এর প্রতিকার কী?’ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে কবির।
‘আগে বলুন, এমন অভিযোগ উঠল কেন।’
‘আমি জানি না। সত্যি বলছি। আমার এক বন্ধুর বায়িং হাউস আছে...মানে ছিল! ওর নাম হাবিব। ও আমার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা ধার নিয়েছিল তিন মাস পর ফেরত দেবে বলে। দিতে না পারলে আমাকে কোম্পানির ২৫ পারসেন্টের মালিক করে নেবে। আমি জানতাম না, ও আরও অনেকের কাছ থেকে একই কথা বলে টাকা নিয়েছে। যখন জেনেছি তখন সব শেষ।’
‘কিন্তু...খবরে লিখেছে, হাবিবের সঙ্গে আপনিও জড়িত। আপনারা দুজন সবার টাকা মেরে খেয়েছেন। এমন অভিযোগ উঠবে কেন?’
‘আমি এসবের কিছু জানিই না! হয়তো অন্যরা অভিযোগ তুলেছে...আমি হাবিবের বন্ধু বলে। ব্যবসা নিয়ে হাবিব একমাত্র আমার সঙ্গেই পরামর্শ করত। ওর হয়ে মাঝেমধ্যে এখানে-সেখানে ছোটাছুটি করতাম, তাই হয়তো ধরে নিয়েছে...’
‘সেসব এ রকম সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলার কারণ হতে পারে না।’
‘তা জানি না।’ জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লেখা একটা চুক্তি বের করে দেখাল কবির। ‘এই যে, আমি যে হাবিবকে টাকা দিয়েছি, তার ডিড।’
ওটা ভালো করে দেখল উকিল। ‘আপনার বন্ধু কোথায়?’
‘খোঁজ নেই।’
‘তার বায়িং হাউস?’
‘ওর কাছে আর যারা টাকা পাবে, তারা তালা লাগিয়ে দিয়েছে। এখন এর প্রতিকার কী?’
‘নিয়ম অনুযায়ী পত্রিকাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে হবে। মিথ্যা খবর ছাপানোর জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে যেখানে খবরটা ছাপা হয়েছে, ঠিক সেখানে প্রতিবাদ ছাপাতে বলতে হবে। আর যদি ওদের কাছে অন্য কোনো প্রমাণ থাকে, যা আপনার বিরুদ্ধে যেতে পারে, তাহলে...’
‘অসম্ভব! যার অস্তিত্বই নেই, তা থাকবে কীভাবে?’
‘ঠিক আছে। তাহলে নোটিশ পাঠাচ্ছি।’
তাই করা হলো। তারপর অনিশ্চিত প্রতীক্ষায় ছটফট করে বেড়াতে লাগল কবির। একদিকে লোকসানের ধাক্কা, অন্যদিকে অকারণে বেইজ্জতি—সব মিলিয়ে অবস্থা বেহাল। চেনা-পরিচিতদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে লাগল সে। দুটো ব্যবসায়িক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হতে হতেও শেষ পর্যন্ত হলো না। লোকসানের ওপর লোকসান, কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায়ও থাকল না। রোজ সকালে জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদ খোঁজে কবির, তারপর হতাশ হয়। এক দিন-দুই দিন করে তিন সপ্তাহ কেটে গেল। কোনো খবর নেই।
আরও কয়েক দিন পর উকিলের ফোন পেয়ে দেখা করতে এল সে। পত্রিকার আইনজীবী তার নোটিশের জবাব দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কবির আলমের লিগ্যাল নোটিশ সম্পর্কে সম্পাদক সাহেব অবহিত আছেন। তবে দেরি হয়ে যাওয়ায় সেটা আর প্রথম পাতায় ছাপানোর উপায় নেই। তিনি এ বিষয়ে নতুন করে প্রতিবাদ পাঠালে চিঠিপত্র কলামে ছেপে দেওয়া হবে।
‘চিঠিপত্র কলামে মানে?’ কবির বলল।
‘এ ধরনের প্রভাবশালী পত্রিকা তাদের খবরের প্রতিবাদই পারতপক্ষে ছাপাতে চায় না, ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা। অবশ্য প্রতিবাদকারী খুব প্রভাবশালী হলে আলাদা কথা।’
‘তার মানে এর প্রতিকার হবে না?’
‘আপনি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ জানান।’
‘ওরা কী করতে পারবে?’
‘বেশি কিছু না। ওদের ক্ষমতা তিরস্কার করা পর্যন্ত।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কবির। ‘বিকল্প কী উপায় আছে?’
‘পত্রিকার বিরুদ্ধে রিট ইস্যু করানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। তাহলে বাড়াবাড়ি না করে হয়তো প্রতিবাদ ছেপে দেবে ওরা।’
‘হয়তো?’
মাথা দোলাল উকিল। ‘হয়তো। অথবা হয়তো গায়েই মাখবে না ওসব।’ মক্কেলের চেহারায় আঁধার ঘনাতে দেখে ঝুঁকে বসল সে। ‘আপনাকে খুলেই বলি। আসলে এসবের প্রতিকার করার মতো কোনো বিশেষ আইন নেই আমাদের দেশে।’
‘তার মানে যাকে চিনি না, জানি না, জীবনে কখনো হয়তো দেখিওনি, সে সাংবাদিক হয়েছে বলে যা খুশি তাই লিখে আমাকে সমাজের চোখে হেয় করবে। আর আমি নিরপরাধ হয়েও এতবড় অন্যায়ের প্রতিকার পাব না?’
‘এই সাংবাদিকের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত কোনো ঝগড়া নেই তো?’
‘ব্যাটাকে জীবনে কখনো চোখেও দেখিনি।’
‘তাহলে...মামলা করা যাবে না, বলছি না। করা যাবে। তবে এসবের জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় যেমন বিশেষ আইন আছে, আমাদের তা নেই। কিছু করতে হলে প্রচলিত আইনেই করতে হবে।’
‘তাই করুন।’
‘আপনি চাইলে করব। কিন্তু প্রতিবেশী হিসেবে আপনাকে একটা পরামর্শ দিই কবির সাহেব। এ ধরনের মামলায় অনেক খরচ হয়।’
‘কী রকম খরচ?’
‘অনেক। তার কোনো সীমা নেই।’
চুপ করে থাকল কবির।
‘আপনার টাকাপয়সা কেমন আছে?’
‘ছোটখাটো ব্যবসা করি। তার ওপর বন্ধুকে টাকা ধার দিয়ে বিপদে আছি। এই হলো অবস্থা।’
‘তাহলে এসবে আপনার না জড়ানোই ভালো।’
‘ক্ষতিপূরণের মামলা করা যায় না?’
‘যায়। তাতে যদি রায় আপনার পক্ষেও হয়, টাকা পেতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। তা ছাড়া মামলায় আপনি জিতে গেলেই জনতার কণ্ঠ হাত গুটিয়ে নেবে না। রিট নিশ্চয়ই করবে ওরা। তাহলে টাকার থলিটা আপনার নাকের সামনে ঝুলে থাকবে। কত বছরের জন্য কে জানে? সে ক্ষেত্রে আপনার খরচ...বুঝতেই পারছেন। ওদের গায়ে খরচের ধাক্কা লাগবে না। কিন্তু আপনার লাগবে।’
‘তা ঠিক।’
‘তা ছাড়া রিট হলে মামলা প্রথম থেকে নতুন করে শুরু হবে। পত্রিকা তখন সুনাম ধরে রাখতে নিজেকে ডিফেন্ড করবে। মামলা যত দিন চলবে, তত দিন বিষয়টা নিয়ে লেখালেখি করবে। ফাঁক খুঁজে নিয়ে আপনার গায়ে কাদার ছিটা লাগাতেও চেষ্টা করবে তার সঙ্গে। যারা তত দিনে বিষয়টা ভুলে গেছে, তারা আবার নতুন করে সব জানবে। বাসি হয়ে যাওয়া বিষয়টা তাজা হবে...আলোচনা হবে।’
‘ওরা তাই করবে?’
‘করবে না কেন? পত্রিকা নিজেকে ডিফেন্ড করবে না? অন্য পত্রিকাও এ নিয়ে লিখবে। সব পত্রিকাই তো আইন-আদালত বিষয়ে প্রতিদিন খবর ছাপে।’
‘সবাই লিখবে?’ বলল কবির।
‘লিখবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া কোর্টের কার্যক্রম চলার সময় যা কিছু আলোচিত হয়, তা নিয়ে লেখা তো হয়-ই।’ বলতে বলতে কিছু একটা মনে পড়ল আইনজীবীর। ‘একটা উপায় পেয়েছি মনে হয়!’
এক ঘণ্টা পর আইনজীবীর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল কবির। বিকেলে জনতার কণ্ঠে টেলিফোন করল। ‘আমি সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
অপারেটর প্রশ্ন করল, ‘কে বলছেন, স্যার?’
‘আমার নাম কবির আলম।’
‘কোন বিষয়ে কথা বলতে চান?’
‘সেটা সম্পাদক সাহেবকেই বলব। আপনি ওনাকে বলুন আমার কথা।’
কয়েক মুহূর্তের জন্য লাইন নীরব হয়ে গেল। তারপর, ‘আপনাকে বিষয়টা বলতে হবে, স্যার। সম্পাদক সাহেব আপনার প্রয়োজনের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত কি না, আগে জানাতে হবে।’
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল কবির। বুঝতে পারছে, তার অনুরোধ নাকচ হতে যাচ্ছে। তবু কারণটা সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘আমার কিছু বলার ছিল। আমি সম্পাদক সাহেবকে...’
‘জাস্ট এ মিনিট।’ আবার কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল লাইন। তারপর, ‘সরি, স্যার। সম্পাদক সাহেব এখন মিটিংয়ে আছেন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। উনি খুব ব্যস্ত মানুষ, স্যার। খুবই ব্যস্ত। আপনি বরং তাকে চিঠিতে ঘটনাটা জানান।’
লাইন কেটে যাওয়ার শব্দ কানে আসতে চোখ বুজল কবির। দুটো গাল দিল সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। পরদিন বিকেলে সাগর গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে জনতার কণ্ঠের অফিসে হাজির হলো সে। কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। এক অফিস সহকারী জানাল, বাইরে ব্যস্ত আছেন তিনি। কখন ফিরবেন, রাতে আদৌ ফিরবেন কি না, ঠিক নেই। ‘কোনো মেসেজ থাকলে আমাকে বলে যান।’
কবির হতাশ চেহারায় বলল, ‘উনি নেই? একটা অনুসন্ধানী রিপোর্ট সম্পর্কে তথ্য দিতে চেয়েছিলাম।’
লেখার প্যাড টেনে নিল সহকারী। ‘আপনার নাম আর মোবাইল নম্বর বলুন, স্যার। আমি লিখে রাখি। উনি ফিরলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলব।’
না শোনার ভান করল কবির। ‘ওনার বাসার ঠিকানা দিন। আমি গিয়ে...’
মাথা নাড়ল সহকারী। ‘অপরিচিত কাউকে বাসার ঠিকানা দেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের। আপনি...’
না শোনার ভান করে কয়েকটা কাগজ বের করে চোখ বোলাল সে। ‘কাল দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি...খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর!’
‘আর কাউকে দিয়ে যেতে চাইলে...’
‘নাহ্। থাক তাহলে।’
‘স্যার, আপনার ফোন নম্বরটা?’
‘কী লাভ? বিদেশে চলে যাব বললাম না? দেখি, ভোরের আলোয় যদি...’
কবির দুই পা যেতে সিদ্ধান্ত পাল্টাল সহকারী। ‘দাঁড়ান। অচেনা কাউকে ঠিকানা দিই না আমরা। নিয়ম নেই। কিন্তু আপনি যখন...আপনাকে দিলাম খবরটা জরুরি বলে।’ সাগর গুপ্তের ঠিকানা, সেল নম্বর লিখে এগিয়ে দিল। ‘এই যে। কাল সাগর স্যারের ডে অফ। সকালে গেলে বাসায় পাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’
পরদিন সকাল ঠিক নয়টার সময় সাগর গুপ্তের বন্ধ দরজায় নক করল কবির। বাসাটা মগবাজারের এক সরু গলিতে। ভেতর থেকে গম্ভীর গলা সাড়া দিল, ‘কে?’
জবাব না দিয়ে আবার নক করল কবির। ঝট করে দরজা খুলে গেল। ঘোড়ার মতো লম্বাটে একটা মুখ উঁকি দিল। বদরাগি চেহারা। গালে দুই দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নাকের ডগায় লটকে আছে গোল চশমা। হাতে খবরের কাগজ। ‘কাকে চান?’
‘সাগর গুপ্তকে।’
তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল লোকটা। ‘কেন?’
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ! কী চাই?’
‘ও। দেখুন, পাঁচ সপ্তাহ আগে জনতার কণ্ঠে আপনার লেখা এই আর্টিকেলটার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি আমি।’ তার চোখের সামনে পেপার কাটিংটা তুলে ধরল কবির।
নাক কুঁচকে চশমাটা আধা ইঞ্চি খানেক ওপরে তুলে দেখল ওটা সাংবাদিক। ‘এ নিয়ে বলার কী আছে?’
‘এই আর্টিকেলে আপনি আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। অনেক আজেবাজে কথা লিখেছেন, যার কোনোটাই সত্যি নয়। এই রিপোর্টের কারণে আমাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে।’
রেগে উঠল সাংবাদিক। ‘আপনি কে বলুন তো!’
‘বলেইছি তো, যার বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট লিখেছেন আপনি।’
ধৈর্য হারিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল সাংবাদিক। ‘তো কী? কৈফিয়ত তলব করতে এসেছেন? আমার ঠিকানা কে দিয়েছে আপনাকে? কিছু বলার থাকলে অফিসে প্রতিবাদ পাঠাতে পারতেন আপনি, লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে পারতেন...’
‘আমি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলাম, আপনারা পাত্তা দেননি,’ শান্ত কণ্ঠে বলল সে। ‘সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম, পারিনি। আপনাকেও পাইনি যে...’
‘তাহলে আর কী? আমার মাথা কিনে নিয়েছেন! যান এখান থেকে!’
রাগ হলেও নিজেকে শান্ত রাখল সে। ‘আমার কথা...’
‘কোনো কথা নেই!’ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সাগর গুপ্ত। ‘এক্ষুনি চলে যান এখান থেকে। নইলে আমি পুলিশ ডাকব।’ লোকটার পেছনে একটা উদ্বিগ্ন নারীমুখ দেখা গেল। উঁকি দিয়ে কবিরকে দেখার চেষ্টা করছে।
মাথায় রক্ত চড়ে গেল ওর। তবু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, ‘আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি। সেটা অন্তত নিন।’
‘কী জিনিস?’
‘এই যে,’ বলে তার নাকের ডগায় দুম করে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল সে।
‘মা গো!’ বলে নাক চেপে ধরে বসে পড়ল লোকটা। দেখতে দেখতে তাজা রক্তে হাত ভরে উঠল তার। পরক্ষণে দড়াম করে দরজা লেগে গেল।
বড় রাস্তায় চলে এল কবির। সামনেই ছোকরা বয়সী এক পুলিশ দেখে বলল, ‘তাড়াতাড়ি আসেন। এই গলিতে একটা মারামারির ঘটনা ঘটেছে।’
‘মারামারি? কুন হানে?’
‘আসেন জলদি!’ বলে দ্রুত সাগর গুপ্তের বাড়ির সামনে ফিরে এল সে। বন্ধ দরজায় নক করে বলল, ‘এই বাড়িতে।’ একটু পর সেই মহিলা উঁকি দিল। এ মুহূর্তে আতঙ্কিত সে। কনস্টেবলকে দেখিয়ে কবির তাকে বলল, ‘ইনি গুপ্ত বাবুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন।’
মহিলা অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘোড়ামুখো দেখা দিল তার জায়গায়। বড় একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে নাকমুখ চেপে ধরে আছে। নাক টানছে ঘন ঘন। কবিরকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। ‘কী...!’
কনস্টেবল একবার কবিরকে, একবার সাগর গুপ্তকে দেখছে। ‘এই যে,’ কবির বলল। ‘এই ভদ্রলোককে মারা হয়েছে।’
সাংবাদিকের দিকে ফিরল কনস্টেবল। ‘সত্য নি?’
মাথা ঝাঁকাল সাংবাদিক। এক ফোঁটা রক্ত পড়ল মেঝেতে।
কবির বলল, ‘কে মেরেছে জানেন? আমি মেরেছি।’
‘অ্যাঁ!’ বেকুব হয়ে গেল কনস্টেবল। ‘কিয়ারে?’
‘সেটা আমি থানায় গিয়ে বলব।’
আধা ঘণ্টা পর রমনা থানার ডিউটি অফিসার একই প্রশ্ন করল তাকে। ‘মারলেন কেন?’
‘মারলাম!’ কবির নির্বিকার।
‘লোকটা কে?’
‘সাংবাদিক।’
‘অ। মেরে আবার অভিযোগ লেখাতে এলেন কেন?’
‘অন্যায় করলে তা স্বীকার করা প্রতিটি সুনাগরিকের কর্তব্য, তাই না? আমি অপরাধ স্বীকার করেছি। আপনি অভিযোগ লিখুন।’
কৌতুকের দৃষ্টিতে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাল ডিউটি অফিসার। হাই তুলল অলস ভঙ্গিতে। তারপর কনস্টেবলের দিকে ফিরল। ‘বেশি মেরেছে? আঘাত কেমন?’
‘নাকের বারিন্দা ছুডায়া ’লাইছে, স্যার। ঘুষা দা।’
চেহারা ত্যাড়া করে কান চুলকালো ডিও। ‘ঠি-ই-ক আছে। এসব ছোটখাটো অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট লেখানোর প্রয়োজন নেই। চলে যান আপনি।’
‘লিখবেন না? তাহলে কিন্তু আমি গিয়ে আবার পেটাব ওই লোককে।’
নড়েচড়ে বসল ডিউটি অফিসার।
মামলা উঠল কোর্টে। বাড়িতে চড়াও হয়ে মারধরের মামলা। তার আগের দিন সন্ধ্যায় কে বা কারা যেন সব জাতীয় দৈনিক আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টেলিফোন করে মামলার খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল। ফলে সময়মতো দেখা গেল সাংবাদিক আর টিভি রিপোর্টার-ক্রুদের ভিড় লেগে গেছে। এত সতীর্থ দেখে বিভ্রান্ত হলো সাগর গুপ্ত। সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে এর-ওর দিকে। তারাও কৌতূহলের চোখে তাকে আর কবিরকে দেখছে। কবির নির্বিকার। আইনজীবীর পরামর্শ শুনছে মন দিয়ে।
কার্যক্রম শুরু হলো। পুলিশের কোর্ট জিআরও সাগর গুপ্তের হয়ে ঘটনার বর্ণনা দিল। আসামি নিজেই থানায় গিয়ে অভিযোগ লিখিয়েছে শুনে দর্শকদের একটু অবাক হতে দেখা গেল। কারণ, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। একটু পর কাঠগড়ায় তোলা হলো আসামি কবিরকে। শপথ করানো হলো। তারপর আরেকবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের অপরাধ কবুল করে নিল সে।
বিচারক তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। ‘আপনি বুঝেশুনে অপরাধ স্বীকার করছেন?’
‘করছি, মাননীয় আদালত।’ দর্শকদের মধ্যে বিস্ময়ের গুঞ্জন উঠল।
‘এতে আপনার সাজা হতে পারে জানেন তো?’
‘জানি।’
‘আই সি!’
‘মাননীয় আদালত,’ কবির বলল। ‘আপনার অনুমতি পেলে আমি বিশেষ অধিকারবলে কিছু বলতে চাই।’
বিচারক বললেন, ‘মামলার সঙ্গে সেসবের সম্পর্ক আছে?’
‘জি, আছে।’
‘বেশ। অনুমতি দিলাম।’
কবিরের উকিল পেশকারের হাতে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিতে সে তা বিচারকের সামনে রাখল। তিনি চোখ বোলালেন সেগুলোয়।
‘ইয়োর অনার, আপনার হাতের ওটা একটা পেপার কাটিং। জনতার কণ্ঠে ছয় সপ্তাহ আগে আমার বিরুদ্ধে সাগর গুপ্তের লেখা। ওটার মাধ্যমে তিনি আমার নামে ভিত্তিহীন, মর্যাদাহানিকর কুৎসা রটিয়ে একটা চরম অন্যায় করেছেন। সামাজিকভাবে আমাকে হেয় করেছেন। আপনার সামনে একটা লেনদেনের অ্যাগ্রিমেন্টও আছে, মাননীয় আদালত। সাগর গুপ্ত যে কোম্পানির সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে আর্টিকেলটি লিখেছেন, ওই অ্যাগ্রিমেন্টই বলবে তা কত বড় মিথ্যা।’
বিচারককে ওগুলোয় চোখ বোলানোর সময় দিয়ে আবার শুরু করল সে। ‘ওই কোম্পানি কিছুদিন আগে পথে বসেছে। আমি ওটায় ২০ লাখ টাকা খাটিয়েছিলাম। টাকা খাটিয়ে আমি নিজেই বিপদে পড়েছি। কিন্তু পত্রিকায় কী লেখা হয়েছে, দেখুন। ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে এমনভাবে কেচ্ছা ফাঁদা হয়েছে, যেন কোম্পানির মালিকের মতো আমিও এ জন্য দায়ী। এটা ছাপানোর আগে একবারও ভেতরের কাহিনি জানার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি এই সাংবাদিক নামের কলঙ্ক।’
মৃদু গুঞ্জন উঠল কোর্টরুমে। সাংবাদিকেরা সাগর গুপ্তকে দেখল। তাদের দৃষ্টিতে বিদ্রূপ আর করুণা ছাড়া কিছু নেই। প্রভাবশালী পত্রিকার প্রভাবশালী সাংবাদিককে ফাটা বাঁশে আটকা পড়তে দেখে সবাইকে বেশ খুশি খুশি লাগছে।
‘ইয়োর অনার,’ কবিরের বক্তব্যে বাধা দেওয়ার দুর্বল চেষ্টা করল সাগর গুপ্ত, ‘এখানে...এসব নিয়ে টানাটানির...’
‘ডোন্ট টক!’ বিচারক গম্ভীর। ‘আপনাকে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিছু বলার থাকলে পরে সুযোগ পাবেন।’ কবিরের অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার ভালো করে দেখে তার দিকে ফিরলেন তিনি। ‘আপনার এই প্রতিবেদনের সূত্র কী? এতসব অভিযোগ কিসের ভিত্তিতে তোলা হয়েছে?’
গুপ্ত নীরব থাকল ত্রিশ সেকেন্ড। ‘আমি অন্য ভিকটিমদের কথার ওপর ভিত্তি করে এটা লিখেছি।’
‘কোনো ডকুমেন্ট...?’
আবারও খানিক নীরব থেকে মাথা নাড়ল সে। ‘না...ডকুমেন্ট নেই।’
বিচারকের দৃষ্টি কবিরের ওপর ফিরে এল। ‘সে ক্ষেত্রে আসামি কিছু বলতে চাইলে আমি আপত্তি তোলার কারণ দেখি না। কেননা, এই অ্যাগ্রিমেন্ট আপনার রিপোর্টিংয়ের বিপক্ষে বলছে।’
সাগর গুপ্ত নতমুখে বসে পড়ল। বিচারক কবিরকে বললেন, ‘আপনি বলুন।’
‘ধন্যবাদ, ইয়োর অনার। এই তথাকথিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক যদি রিপোর্টটা লেখার আগে আমার সঙ্গে কথা বলার কষ্ট স্বীকার করত, তাহলে আসল বিষয়টা সহজেই জেনে নিতে পারত। তা না করে কোথায় কোন মদের আড্ডায়, না জুয়ার...’
লাফিয়ে উঠল সাগর গুপ্ত। ‘ইয়োর অনার! লোকটা যা খুশি তাই...’
‘সাইলেন্স!’ ধমক মারলেন বিচারক। ‘বলেছি আপনার কথা পরে শোনা হবে।’ কবিরের দিকে ফিরলেন বিচারক। ‘আপনি সংযত ভাষায় কথা বলুন।’
‘জি, ইয়োর অনার। বলছিলাম, সাংবাদিকতার নামে চালিয়ে দেওয়া এই মিথ্যার ধাক্কায় আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আমি বুঝি না, এই লোকটা কোন অধিকারে আমার মতো খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষের জীবন বিষিয়ে তুলেছে। মাননীয় আদালত, এর নাম কি সাংবাদিকতা?’
বিচারক বললেন, ‘আপনার মনে ক্ষোভ জমার সংগত কারণ আছে। আমি বুঝি। কিন্তু এর প্রতিকার আর কোনোভাবে করা যেত না?’
‘আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, ইয়োর অনার। লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি প্রতিবাদ ছাপানোর দাবিতে, জনতার কণ্ঠ ছাপেনি। সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বোঝাতে চেয়েছি, তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত বলে আমাকে সময় দিতে পারেননি। পারেননি না, আসলে দেননি। এই লোকের সঙ্গে দেখা করতে অফিসে গিয়েছি। সেখানে না পেয়ে তার বাসায় যাই। কিন্তু...’
মাথা নাড়লেন বিচারক। ‘কিন্তু সহিংসতা কখনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।’
‘আমি গিয়েছিলাম এই লোকের সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়ে বলে যদি কোনো প্রতিকার করা যায়, সেই আশায়। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। সমাজে চলে-ফিরে খেতে হয়। কিন্তু এই একটা ভুয়া, বানোয়াট রিপোর্ট লিখে যে মারাত্মক ক্ষতি করেছে, তাতে আমার সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ইয়োর অনার। একের পর এক ব্যবসা ছুটে যাচ্ছিল হাত থেকে। বাইরে মুখ দেখাতে পারছিলাম না। আপনজনেরা পর্যন্ত আমাকে করুণা করছে। তাই গিয়েছিলাম। কিন্তু এ উল্টো আমাকেই পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেওয়াতে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।’
সাগর গুপ্তের দায়িত্বহীনতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকল না বিচারকের মনে। তাই তাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি।
দুপুরের বিরতির পর রায় ঘোষণা করা হলো। সাগর গুপ্তকে ভবিষ্যতে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে কলম ধরতে কঠোর ভাষায় সতর্ক করলেন বিচারক। আসামি কবির আলমকেও তার আচরণের জন্য সতর্ক করা হলো এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হলো সাগর গুপ্তের চিকিৎসার খরচ বাবদ।
উকিলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসছে কবির। সিঁড়িতে কেউ হাত টেনে ধরতে ঘুরে তাকাল। সাগর গুপ্ত। চোখ গরম করে চেয়ে আছে। কবির হাসল। ‘হাত সরাও। আজ এত সাংবাদিক এখানে হাওয়া খেতে আসেনি মনে রেখো।’
চোখ ছোট হয়ে এল সাগর গুপ্তের। ‘এদেরকে...তুমি ডেকেছ?’
‘না ডাকলে দেশবাসীকে কীভাবে জানাতাম, তুমি কেমন সাংঘাতিক? ওরা এসেছিল বলেই না কালকের পত্রিকা পড়ে সবাই তা জানতে পারবে।’
দাঁতে দাঁত চাপল সাগর গুপ্ত। ‘ভেবেছ...এভাবে পার পেয়ে যাবে তুমি?’
আবার হাসল কবির। ‘সমস্যা নেই। না পেলে প্রতিকারের অন্য কোনো উপায় খুঁজে নেব।’
বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে
No comments