গহন গহীন-বাঘের মুখে ঘাসের হাসি! পিছু হটলেন বুশ সাহেব-ফখরুজ্জামান চৌধুরী by টেক্সাসের ডব্লিউ
ভয়ংকর মাংসাশি প্রাণী বাঘ কখনো বিপন্ন হলে তার মুখে ঘাস নামের নিরীহ ছাগ-খাদ্য ঘাসের জোগান দেখে আর্তপ্রাণের জীবন রক্ষার চেয়ে দর্শক মনে রসবোধ যে বেশি সক্রিয় থাকে, তা বোধ করি বলা নিষ্প্রয়োজন।
হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষার শব্দ, প্রবাদ প্রবচন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা যে কী পরিমাণ সমৃদ্ধ তা বিশ্বব্যাপী জানা।
হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষার শব্দ, প্রবাদ প্রবচন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা যে কী পরিমাণ সমৃদ্ধ তা বিশ্বব্যাপী জানা।
বাংলা ভাষার অন্যতম সমৃদ্ধ সংগ্রহভাণ্ডারের লোকায়ত জ্ঞানলব্ধ প্রবাদ-প্রবচন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালি লোকায়ত জ্ঞানসমৃদ্ধ মুখে মুখে যেসব প্রবাদ-প্রবচন উচ্চারণ করেছেন, তার উত্তরাধিকার সূত্রে আজ আমাদের ভাষাগত সংগ্রহশালার লাল-নীল উজ্জ্বল এক একটি বাতি!
বিপদে পড়লে বাঘ নাকি ঘাস পর্যন্ত খায়, এমন প্রবাদ যার মস্তিষ্কপ্রসূত, তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় প্রাচীনকালে অরণ্যসংকুল এই জনপদে স্বচক্ষে এমন কোনো দৃশ্য দেখলে ভালো, না দেখলেও তার কল্পনাশক্তির তারিফ করতে কার্পণ্য করি না।
এই তো কিছু দিন আগেও যার অঙ্গুলি হেলনে পৃথিবীর আলো-বাতাস পর্যন্ত থেমে যেত তিনি এখন কারাবরণ এড়াতে নির্ধারিত বিদেশ ভ্রমণ বাতিল করে স্বদেশে, স্বরাজ্যে এবং স্থলনগরীতে স্টেডিয়ামে বসে নিরীহ চেহারা নিয়ে ন্যাশনাল ফুটবল লিগের (এনএফএল) ফাইনাল খেলা দেখবেন, এটা কি দুই বছর আগে কেউ দূরবর্তী কল্পনায়ও ভাবতে পেরেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের তেতাল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জর্জ ওয়াকার বুশের দুই মেয়াদে মোট আট বছর শেষ হয়েছে ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি।
তাঁর পিতা জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশও হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত ছিলেন দুই মেয়াদে আট বছরকাল (জানুয়ারি ২০, ১৯৮৯-জানুয়ারি ১৯৯৩)। পিতা-পুত্রের মধ্যে নামের মিল ছাড়া আর সব ব্যাপারেই গরমিল। নিজেদের অঙ্গরাজ্য টেঙ্াসে সিনিয়র বুশ এক সম্মানিত নাম, রাজ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁর নাম ধারণ করে আছে গৌরবের সঙ্গে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করি, বিগত শতকের ছয়ের দশকে ঢাকার টেলিভিশন দর্শকরা যাঁরা ডালাস নামের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালটি দেখেছেন মুগ্ধচিত্তে, তাঁরা কোনো রকম চিন্তাশক্তিতে জোর প্রয়োগ না করেও টাইটেল দৃশ্যে গোলকধাঁধার মতো উড়ালসেতুর কথা মনে করতে পারেন। আমরা যাকে বলি ফ্লাইওভার। মার্কিনিরা বলেন, টার্ন পাইক। টার্ন পাইকের আওতায় আসে উড়ালসেতু, আর টোল পরিশোধযোগ্য রাস্তা। টেক্সাসের ডালাস শহরের অনেক আগে থেকেই দিগন্ত রেখায় ভেসে ওঠে একটি বিজ্ঞপ্তি : জর্জ বুশ টার্ন পাইকে স্বাগত! এই বুশ পিতা বুশ। পুত্র বুশ কচিৎ কোথাও এমন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আট মাসের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা এবং পরবর্তী সময়ে তার জবাবে আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেন, তালেবানবিরোধী অভিযান ও জনবিধ্বংসী অস্ত্র খোঁজার নামে ইরাক আক্রমণ আজ সারা বিশ্বকে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করছে। এর হাত থেকে পরিত্রাণ কিভাবে মিলবে তা কেউ জানে না। সারা পৃথিবী আজ যুদ্ধের দায় বহন করে চলছে।
বুশ সাহেব নির্বিকার তাঁর কর্মকাণ্ডে।
বুশ সাহেব মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্টদের দীর্ঘ লালিত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেওয়ার পর লিখলেন তাঁর আত্মচরিত 'ডিসিশন পয়েন্টস'। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে বইটি বাজারে আনে ক্রাউন পাবলিশিং গ্রুপ, যুক্তরাষ্ট্র। ৪৯৭ পৃষ্ঠার বইটি বুশ সাহেব পাঠক সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেন তাঁর নিজ শহর টেক্সাসের ডালাসে। বইটি প্রত্যাশিত হৈচৈ ফেলতে পারেনি দেখে প্রকাশকের মতো এর লেখকও নাকি হতবাক। বই বাজারজাত করার এক সপ্তাহ আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ বহুল প্রচারিত প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিকে পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন দিয়েও পাঠক সাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ না করতে পারাটা বিস্ময়কর বৈকি!
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সমালোচক কিংবা সমর্থক যে যেখানে আছেন, ভেবেছিলেন আত্মচরিতে তিনি স্মৃতি রোমন্থন করবেন নির্মোহ চিত্তে। নিজের ভুল-ভ্রান্তি যদি কিছু এখন খুঁজে পান তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডে, এর সমালোচনা করবেন, অনুতপ্ত না হলেও দুঃখ দুঃখ ভাব দেখাবেন। (টেক্সানরা সাধারণত উগ্র স্বভাবী লোক। সহজে দোষ স্বীকার তাদের ঠিকুজিতে নেই)!
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা সারা বিশ্বকে শুধু যে হতবাক করেছে তা তো নয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার দিকেও সুস্পষ্টভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। মার্কিন এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা কী পরিমাণ ভঙ্গুর, তা যেন বিশ্ববাসী সকৌতুকে দেখলেন।
এই ঘটনার পরপর জর্জ ডব্লিউ বুশের মনমানসিকতায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। বলা চলে তা একধরনের ঔদ্ধত্যের পর্যায়েই চলে যায়। নিজেকে তিনি 'ওয়ারটাইম কমান্ডার' হিসেবে সব ধরনের সমালোচনার ঊধ্বর্ বিবেচনা করতে বলেছেন। পূর্বসূরি প্রেসিডেন্টদের মধ্যে একমাত্র তাঁর পিতা প্রেসিডেন্ট বুশ আর আব্রাহাম লিঙ্কনকেই তিনি মাঝেমধ্যে স্মরণে আনতেন।
বুশের সেই কথিত : 'হয় তুমি আছ আমার সঙ্গে, না হয় তোমার অবস্থান সন্ত্রাসীদের সঙ্গে' দম্ভোক্তির ফলে ওয়ার অন টেররের নামে পৃথিবী মোটা দাগে বিভক্ত হয়ে গেল।
রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে শুধু নয়, প্রেসিডেন্ট বুশ ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকেও অপসৃত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর শাসনামলের বিভিন্ন ঘটনা-অঘটন যেন তাঁর পিছু ছাড়তে চায় না। মানবাধিকারের জন্য পরিচিত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর শাসনকালে এক দানবীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গুয়ানতানামো বের জিন্দানখানা আর অধিকৃত ইরাকের আল গারাইব কারাগারের কুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে কাউকে অপরাধী মনে হলেই তাকে বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে জোর করে ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার মতো হাইজ্যাকধর্মী দস্যুতার অপকর্মটি নিয়মিত ঘটাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
প্রেসিডেন্ট বুশের মনে হয় নিজের ওষুধের তেতো স্বাদ পাওয়া শুরু হয়েছে। কথা ছিল বিদেশে তিনি দাতব্য কাজে অর্থ জোগাড়ে সহায়তা করতে চ্যারিটি বক্তৃতা দেবেন। এর বদলে তাঁকে দেখা গেল ৮ ফেব্রুয়ারি টেক্সাসের আর্লিংটনের ডালাস কাউবয় স্টেডিয়ামে বসে গ্রিন বে পেকারস উইসকনমিন, আর পিটাসবার্গ স্টিলার্সের মধ্যকার ন্যাশনাল ফুটবল লিগের ফাইনাল খেলা দেখছেন নির্ভার চিত্তে। পাশে ডালাস কাউবয়েজের মালিক জেরি জোনস। বুশের চেহারা দেখে বোঝা যায় না, তিনি তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন, বাধ্য হয়েছেন আটক হওয়ার ভয়ে।
মানবাধিকার কর্মীরা জেনেভায় প্রেসিডেন্ট বুশের বিরুদ্ধে অত্যাচার-নির্যাতনের দায়ে সুইস ফৌজদারি আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদিও মামলা এখন খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে এবং নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল রাইটস, ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এবং হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা শাখায় বন্দিদের ওপর যে ধরনের অমানবিক নির্যাতন, যার মধ্যে রয়েছে কুখ্যাত অমানবিক ওয়াটার বোল্ডিং, নির্ঘুম রাখা, জোর করে টানা দিয়ে রাখা, নির্জন অন্ধকার সেলে বন্দি করে রাখা তার দায়ে অভিযুক্ত করে প্রেসিডেন্ট বুশের বিরুদ্ধে অভিযোগের খসড়া দায়ের করা হয়েছে মাত্র।
বুশের আত্মজীবনী 'ডিসিশন পয়েন্টস' প্রকাশিত হওয়ার পর সুইজারল্যান্ডেই হতো তাঁর প্রথম বিদেশ সফর।
কিন্তু তা আর হলো না। আয়োজক জেনেভা ইহুদি চ্যারিটি তাদের অনুষ্ঠান বাতিল করেছে আগেভাগেই।
আর প্রেসিডেন্ট বুশ এনএফএল ফাইনাল খেলা দেখছেন।
এ যেন বাঘের মুখে সবুজ ঘাসের হাসি।
লেখক : অনুবাদক
fzamanchow@gmail.com
No comments