চারদিক-এখানে একটি স্কুল চাই by আকমল হোসেন নিপু
সেদিন সকালে কড়কড়ে রোদ ছিল। বৈশাখ মাস বলেই কিনা, দুপুর গড়াতে না-গড়াতেই আকাশের মুখ ভার। ছাইমেঘে আকাশখানি ছাওয়া। ঝড় ওঠেনি। শুরু হয় ছড়া ছাড়া বৃষ্টি। এই বাড়ে, এই কমে। গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়েও পথের ধারে থামতে হলো। বৈশাখ মাসে সাধারণত ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি আসে।
কিছুক্ষণ প্রকৃতিকে কাঁপিয়ে, দাপট দেখিয়ে একসময় থেমে যায়। আবার ঝকঝকে রোদ ওঠে। তবে সেদিন, ২ মে ২০১২, আকাশ ছিল অন্য মেজাজে। থামতে চাইছে না। কী আর করা! কবি জয় গোস্বামীর ‘বৃষ্টি তোমার বন্ধুকে মনে রেখো’ পঙিক্তগুলো মাথায় নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পথে নামা, পথচলা।
গন্তব্য, ইন্দানগর পানপুঞ্জি। এই পানপুঞ্জিটি পড়েছে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নে। বনের গভীরে, টিলার চূড়ায় আদিবাসী খাসিয়াদের একটি গ্রাম। পুঞ্জিটি রাজনগর উপজেলায় পড়লেও যেতে হয় অনেকটা পথ ঘুরে। সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার পাশ দিয়ে। বৃষ্টি থামছে না, বৃষ্টিস্নাত হয়েই আমরা (সঙ্গে আবদুর রহমান সোহেল) এগিয়ে চলছি। ইন্দানগর চা-বাগানের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা আঁকাবাঁকা, পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পথ পেরিয়ে তবে দেখা মেলে এক পাহাড়ের। সেই পাহাড়ের কোলে ইন্দানগর পানপুঞ্জি। পাহাড়ের ওপর গ্রাম। বাঁশ-কাঠের তৈরি সরু সিঁড়ি বেয়ে টিলার ওপর উঠতে হয়। তখনো অঝোর বর্ষণ। নির্জন পাহাড়ি বর্ষণের রিমঝিম শব্দ। চারদিকে গাছপালা, মাঝখানে টিলার ওপর ছড়ানো-ছিটানো ঘর।
সরকারি উদ্যোগে আদিবাসীদের বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চার জন্য ইন্দানগর পানপুঞ্জি কমিউনিটি সেন্টার তৈরি হয়েছে। সেটির উদ্বোধন হবে। বৃষ্টি কিছুটা থামলে সেই ভবনটি উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। আলোচকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন, কোলাহলের বাইরে এমন একটি শান্ত নিঝুম স্থান দেখছেন বলে। বলেছেন, আদিবাসীদের নিজেদের সরলতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষা করেই মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। আমার চোখের সামনে তখন একঝাঁক আদিবাসী সরল মুখ। এই পাহাড়ঘেরা জীবনের বাইরে যে এক কঠিন জগৎ, কালো ধোঁয়ার জগৎ, অসততা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, রাজনীতি, কূটনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, হানাহানির জগৎ—তার অনেকটাই এদের জানাশোনার বাইরে (দু-চারজন হয়তো নাগরিক জীবনকে এরই মধ্যে চিনে ফেলেছে)। ছোট এই কমিউনিটি সেন্টার ঘিরে তাদের মধ্যে তখন উৎসবের ছন্দ। শিশু, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ সবাই এসেছেন। বিষয়টি এত বড় কিছু নয়। কিন্তু তাদের উৎসবমুখরতা দেখে মনে হয়েছে, এ অনেক বড় একটি পাওয়া।
মানুষ এখনো কত সামান্যতে খুশি হতে পারে। সেই প্রাপ্তির কথাটা বললেন পুঞ্জির লিপটন মারাক। ইন্দানগর পানপুঞ্জির পুঞ্জিপ্রধান প্রিসিলা আমসে খাসিয়া ভাষায় কথা বললেন। তিনি ছিটেফোঁটা শব্দ ছাড়া বাংলা বলতে পারেন না। তাঁর কথাটা ভাষান্তর করলেন আদিবাসী নেত্রী ফ্লোরা বাবলী তালাং।
ইন্দানগর পানপুঞ্জিতে আদিবাসী ২২ পরিবারের বাস। তাদের মধ্যে খাসি বা খাসিয়াই বেশি। দু-একটি পরিবার আছে গারো। সেদিন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছিলেন আদিবাসী গারো শিক্ষিকা ববিতা ডিও। এই পুঞ্জিতে তাঁর বাড়ি হলেও তিনি অন্য একটি পানপুঞ্জিতে আদিবাসী শিশুদের পড়ালেখা শেখান। ইন্দানগর পানপুঞ্জি বা আশপাশে বিদ্যালয় নেই, যে কারণে প্রায় সবারই কথা, একটা স্কুল চাই। আদিবাসী সংগঠন কুবরাজের সাধারণ সম্পাদক ও আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফ্লোরা বাবলী তালাং বললেন, ‘আদিবাসীদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে সংস্কৃতিচর্চার তেমন সুযোগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বায়নের এ যুগে আদিবাসীদের নিজেদের সংস্কৃতি একদিন হারিয়ে যাবে। তা ছাড়া শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এখানে একটা বিদ্যালয় থাকলে সেই সুযোগটা সবাই পেত।’ তিনি আরও একটি দিক তুলে ধরেন, ‘পানপুঞ্জিসমূহ দুর্গম স্থানে থাকে। এসব স্থানে নির্মাণকাজের ব্যয় সমতলের সমান ধরা হলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পরিবহনখরচ বেশি হওয়ায় পাঁচ টাকার জিনিস ১৫ টাকায় কিনতে হয়। বরাদ্দ ধরার সময় এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।’ বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তার দিকটি হয়তো উপস্থিত সবাইকেই স্পর্শ করে। স্কুল পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবসহ যা লাগে, তা সরবরাহের আশ্বাস দিলেন প্রশাসনের লোক ও জনপ্রতিনিধি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিয়মিত শিক্ষক নিয়ে। একজন নিয়মিত শিক্ষকের দিকটি কে দেখবে! এটা হয়তো পানপুঞ্জি, অথবা আদিবাসীদের মাঝ থেকে কেউ দায়িত্ব নিতে পারেন। সম্ভব হলে তাঁদের মধ্য থেকেই কাউকে সরকার নিয়োগ দিতে পারে। তাহলে তাঁদের মাতৃভাষা ও মূলধারার শিক্ষা দুটোই শিশুরা সহজে শিখতে পারবে।
বৃষ্টি থেমেছে অনেকটা বিকেল গড়িয়েই। ঝোপঝাড় থেকে তখন ভেসে আসছে বৃষ্টিভেজা গন্ধ। চকচকে গাছের পাতায় পাতায় একচিলতে রোদের চমক। টিলার সেই সরু সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কানে তখনো আদিবাসী শিশুদের গান। এই ভাষার অর্থ হয়তো বুঝি না, কিন্তু এটাও যে কারও মাতৃভাষা, সেই দরদটা বোঝা গেছে মান্ত্রী প্রিসিলা আমসের কথার মাঝেই।
আকমল হোসেন নিপু
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
গন্তব্য, ইন্দানগর পানপুঞ্জি। এই পানপুঞ্জিটি পড়েছে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নে। বনের গভীরে, টিলার চূড়ায় আদিবাসী খাসিয়াদের একটি গ্রাম। পুঞ্জিটি রাজনগর উপজেলায় পড়লেও যেতে হয় অনেকটা পথ ঘুরে। সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার পাশ দিয়ে। বৃষ্টি থামছে না, বৃষ্টিস্নাত হয়েই আমরা (সঙ্গে আবদুর রহমান সোহেল) এগিয়ে চলছি। ইন্দানগর চা-বাগানের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা আঁকাবাঁকা, পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পথ পেরিয়ে তবে দেখা মেলে এক পাহাড়ের। সেই পাহাড়ের কোলে ইন্দানগর পানপুঞ্জি। পাহাড়ের ওপর গ্রাম। বাঁশ-কাঠের তৈরি সরু সিঁড়ি বেয়ে টিলার ওপর উঠতে হয়। তখনো অঝোর বর্ষণ। নির্জন পাহাড়ি বর্ষণের রিমঝিম শব্দ। চারদিকে গাছপালা, মাঝখানে টিলার ওপর ছড়ানো-ছিটানো ঘর।
সরকারি উদ্যোগে আদিবাসীদের বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চার জন্য ইন্দানগর পানপুঞ্জি কমিউনিটি সেন্টার তৈরি হয়েছে। সেটির উদ্বোধন হবে। বৃষ্টি কিছুটা থামলে সেই ভবনটি উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। আলোচকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন, কোলাহলের বাইরে এমন একটি শান্ত নিঝুম স্থান দেখছেন বলে। বলেছেন, আদিবাসীদের নিজেদের সরলতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষা করেই মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। আমার চোখের সামনে তখন একঝাঁক আদিবাসী সরল মুখ। এই পাহাড়ঘেরা জীবনের বাইরে যে এক কঠিন জগৎ, কালো ধোঁয়ার জগৎ, অসততা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, রাজনীতি, কূটনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, হানাহানির জগৎ—তার অনেকটাই এদের জানাশোনার বাইরে (দু-চারজন হয়তো নাগরিক জীবনকে এরই মধ্যে চিনে ফেলেছে)। ছোট এই কমিউনিটি সেন্টার ঘিরে তাদের মধ্যে তখন উৎসবের ছন্দ। শিশু, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ সবাই এসেছেন। বিষয়টি এত বড় কিছু নয়। কিন্তু তাদের উৎসবমুখরতা দেখে মনে হয়েছে, এ অনেক বড় একটি পাওয়া।
মানুষ এখনো কত সামান্যতে খুশি হতে পারে। সেই প্রাপ্তির কথাটা বললেন পুঞ্জির লিপটন মারাক। ইন্দানগর পানপুঞ্জির পুঞ্জিপ্রধান প্রিসিলা আমসে খাসিয়া ভাষায় কথা বললেন। তিনি ছিটেফোঁটা শব্দ ছাড়া বাংলা বলতে পারেন না। তাঁর কথাটা ভাষান্তর করলেন আদিবাসী নেত্রী ফ্লোরা বাবলী তালাং।
ইন্দানগর পানপুঞ্জিতে আদিবাসী ২২ পরিবারের বাস। তাদের মধ্যে খাসি বা খাসিয়াই বেশি। দু-একটি পরিবার আছে গারো। সেদিন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছিলেন আদিবাসী গারো শিক্ষিকা ববিতা ডিও। এই পুঞ্জিতে তাঁর বাড়ি হলেও তিনি অন্য একটি পানপুঞ্জিতে আদিবাসী শিশুদের পড়ালেখা শেখান। ইন্দানগর পানপুঞ্জি বা আশপাশে বিদ্যালয় নেই, যে কারণে প্রায় সবারই কথা, একটা স্কুল চাই। আদিবাসী সংগঠন কুবরাজের সাধারণ সম্পাদক ও আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফ্লোরা বাবলী তালাং বললেন, ‘আদিবাসীদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে সংস্কৃতিচর্চার তেমন সুযোগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বায়নের এ যুগে আদিবাসীদের নিজেদের সংস্কৃতি একদিন হারিয়ে যাবে। তা ছাড়া শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এখানে একটা বিদ্যালয় থাকলে সেই সুযোগটা সবাই পেত।’ তিনি আরও একটি দিক তুলে ধরেন, ‘পানপুঞ্জিসমূহ দুর্গম স্থানে থাকে। এসব স্থানে নির্মাণকাজের ব্যয় সমতলের সমান ধরা হলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পরিবহনখরচ বেশি হওয়ায় পাঁচ টাকার জিনিস ১৫ টাকায় কিনতে হয়। বরাদ্দ ধরার সময় এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।’ বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তার দিকটি হয়তো উপস্থিত সবাইকেই স্পর্শ করে। স্কুল পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবসহ যা লাগে, তা সরবরাহের আশ্বাস দিলেন প্রশাসনের লোক ও জনপ্রতিনিধি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিয়মিত শিক্ষক নিয়ে। একজন নিয়মিত শিক্ষকের দিকটি কে দেখবে! এটা হয়তো পানপুঞ্জি, অথবা আদিবাসীদের মাঝ থেকে কেউ দায়িত্ব নিতে পারেন। সম্ভব হলে তাঁদের মধ্য থেকেই কাউকে সরকার নিয়োগ দিতে পারে। তাহলে তাঁদের মাতৃভাষা ও মূলধারার শিক্ষা দুটোই শিশুরা সহজে শিখতে পারবে।
বৃষ্টি থেমেছে অনেকটা বিকেল গড়িয়েই। ঝোপঝাড় থেকে তখন ভেসে আসছে বৃষ্টিভেজা গন্ধ। চকচকে গাছের পাতায় পাতায় একচিলতে রোদের চমক। টিলার সেই সরু সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কানে তখনো আদিবাসী শিশুদের গান। এই ভাষার অর্থ হয়তো বুঝি না, কিন্তু এটাও যে কারও মাতৃভাষা, সেই দরদটা বোঝা গেছে মান্ত্রী প্রিসিলা আমসের কথার মাঝেই।
আকমল হোসেন নিপু
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
No comments