দৃক গ্যালারি-বিশ্বসেরা আলোকচিত্র এখন ঢাকায়! by মনিরুল আলম

ছবিগুলো নির্বাক! কিন্তু একই সময়ে তা যেন কত বাঙ্ময়! পৃথিবীতে নানা সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার প্রামাণ্য দলিল যেন সব। একজন দর্শক যখন এ ছবিগুলো দেখছেন, দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে তাঁর মন আবার কোনো ছবি তাঁকে বিস্মিত করে দিচ্ছে। যিনি আলোকচিত্রী, তিনি মনে করেন ছবি দেখার প্রতিক্রিয়া তো এমনই হওয়ার কথা।


বিশেষ করে সংবাদ আলোকচিত্র অনেক আগে থেকেই গোটা দুনিয়ায় একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।
যে ছবিগুলোর কথা বলা হলো সেসব ছবিই এখন বাংলাদেশে, এগুলো ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো-২০১২ প্রদর্শনীর ছবি। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অংশ নেওয়া সংবাদ আলোকচিত্রগুলোর এ প্রদর্শনী চলছে ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে। আর এর আয়োজক—নেদারল্যান্ডভিত্তিক ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো। ২৬ এপ্রিল এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো মূলত একটি স্বাধীন ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পেশাদার ফটোসাংবাদিকদের কাজের মূল্যায়নের স্বীকৃত দান। ১৯৫৫ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টার্ডাম শহরে এ সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। ফটোসাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়ন এবং বিশ্বের সব ফটোসাংবাদিকের একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা হিসেবেই প্রতিবছর এ সংস্থাটি একটি উঁচুমানের প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের আছে ফটোসাংবাদিকতার ওপর নানা রকম শিক্ষা কার্যক্রম।
এবার ১২৪টি দেশ থেকে মোট পাঁচ হাজার ২৪৭ জন আলোকচিত্রীর এক লাখ এক হাজার ২৫৪টি ছবি জমা পড়েছিল, সেখান থেকে ১৬০টি ছবি নয়টি বিভাগে পুরস্কৃত হয় এবং প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়। বার্ষিক এ প্রদর্শনী বিশ্বের প্রায় ১০০টি স্থানে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সেই সূত্র ধরেই দৃক গ্যালারি নেদারল্যান্ড দূতাবাসের সহযোগিতায় ঢাকায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। আমস্টার্ডামে এই প্রদর্শনীর প্রথম উদ্বোধনের পর সারা বিশ্বের দর্শকদের জন্য প্রথম প্রদর্শনীটির উন্মোচন করা হলো ঢাকাতেই, এরপর ভ্রাম্যমাণ এই প্রদর্শনী যথাক্রমে পোল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালিসহ অন্যান্য দেশে প্রদর্শিত হবে।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রদর্শনীর বাংলাদেশের সমন্বয়ক আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তাঁর মতে, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে ফটোসাংবাদিকতার জন্য অসাধারণ একটা ঘটনা। এতগুলো দেশের ফটোগ্রাফারদের কাজ একসঙ্গে দেখা। আবার ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে এটা একটা প্রামাণ্য দলিলও। গত ৫৫ বছরের ওয়ার্ল্ড প্রেসের ছবিগুলো দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায় পৃথিবী কীভাবে বদলেছে। বাংলাদেশে এই প্রদর্শনী আসার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে—ফটোসাংবাদিকতায় বাংলাদেশ অসাধারণ ভূমিকা পালন করছে এখন। বাংলাদেশের অনেক আলোকচিত্রী আন্তর্জাতিকভাবে নানা স্বীকৃতি পাচ্ছে। বাংলাদেশ আলোকচিত্রীদের জন্য এখন তীর্থস্থান বলা যায়।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর সাবেক বিচারক (২০১১) আলোকচিত্রী আবীর আবদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশি আলোকচিত্রী হিসেবে ওয়ার্ল্ড প্রেসে জুরি হিসেবে কাজ করা অনেক সম্মানের বিষয়। এই কাজ করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমা ফটোগ্রাফাররা কীভাবে ছবির বিচার বিশ্লেষণ করে, সেটা জানার সুযোগ হয়েছে। এবার যে ছবিটিকে সেরা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, সেটা খুব সাধারণ একটা ছবি; কিন্তু এর বিশেষত্ব হলো, এর মধ্যে মানবিক আবেদন ফুটে উঠেছে অনেক তীব্রভাবে।
এবার প্রতিযোগিতায় ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার-২০১১ হয়েছে স্পেনের ফটোসাংবাদিক স্যামুয়েল আরান্দা। নিউইর্য়ক টাইমস ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া এই ছবিকে জুরিরা ২০১১ সালের সেরা ছবি নির্বাচিত করেছেন। ছবিটির বিষয়বস্তু এ রকম: ১৫ অক্টোবর ইয়েমেনের সানা এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে ফাতিমা-আল-কাওস তাঁর আহত ছেলে জায়েদকে (১৮) কোলে নিয়ে বসে আছেন। ৩৩ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা রাষ্ট্রপতি আলী আবদুল্লাহ সালেহবিরোধী এ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নেমে এসেছিল সানার প্রায় সব নারী-পুরুষ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে একটি মিছিলে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনায় ১২ জন নিহত হয় আর আহত হয় ৩০ জন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ফাতিমা তাঁর ছেলেকে খুঁজে পান গুরুতর আহত অবস্থায়। পরবর্তী দুই দিন ছেলে তাঁর অচেতন ছিল।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি আইভান সালিভান তাঁর এক লেখায় বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে বলেন, ২০১১ ছিল উল্লেখযোগ্য একটি বছর—প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট শোকে, বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ বছর এটি। সুনামির ধ্বংস আর শোকের চিহ্ন পাই আমরা ছবিতে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্ত। অন্যদিকে ইউরোপের নরওয়েতে স্বঘোষিত খ্রিষ্টান মৌলবাদী কেড়ে নেয় ৬৯টি প্রাণ—চূড়ান্ত বিচারের সময় আমরা চাইছিলাম সব শোক আর বেদনা ছাপিয়ে একটি আশার ছবিও যেন খুঁজে পাই। বছরটা কেবল শুধু খারাপ ঘটনাপ্রবাহেরই নয়, অনুপ্রেরণা আর সান্ত্বনারও।
সামিওল আরান্দার বিজয়ী ছবিটি দেখলে ভেতরে নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়: রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ। আবার একই সঙ্গে এটা মায়ের কোলে বীর সন্তানের চিরন্তন এক ছবিও যেন।
রাশিয়ান ফটোসাংবাদিক ইযুরি কোজিরেভর ছবি স্পট নিউজ বিভাগে সিঙ্গেল ইমেজ হিসেবে জিতে নেয় প্রথম পুরস্কার। ইযুরি কাজ করেন নুর ইমেজে।
সাউথ আফ্রিকান ফটোসাংবাদিক ব্রেন্ট স্টার্টান—নেচার স্টোরিজ বিভাগে জিতে নেন প্রথম পুরস্কার। তাঁর ছবিটি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। তিনি গেটি ইমেজের হয়ে কাজ করেন। তাঁর ছবির গল্পটি ছিল অনেকটা এ রকম: দুনিয়াজোড়া গন্ডারের শিং কাটা নিষিদ্ধ। কিন্তু এশিয়ার নব্যধনীদের কারণে এর চাহিদা এখন ব্যাপক। সোনার চেয়েও দামি এখন এসব শিং। এ ছাড়া মার্কিন ফটোসাংবাদিক স্টেফানি সিনক্লেয়ারের ফটো স্টোরি প্রথম পুরস্কার জেতে সমকালীন আলোকচিত্র বিভাগে। জাপানি ফটোসাংবাদিক ইয়াশুওশি চিবা, তাঁর তোলা ফটো স্টোরিটি পিপলস ইন দ্য নিউজ স্টোরি বিভাগে প্রথম পুরস্কার পায়। তিনি আজঁস ফ্রান্স-প্রেস হয়ে কাজ করেন।
আলোকচিত্রপ্রেমী বা দর্শকদের জন্য প্রর্দশনীটি চলবে ১৮ মে পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.