চালচিত্র-ইতিহাস ঘাতকদের ক্ষমা করে না by শুভ রহমান
ইতিহাস বড় নির্মম। ইতিহাস ঘাতকদের ক্ষমা করে না। উদ্ভট চিন্তা যদি কেউ করে, নতুন নাম নিয়ে নিজেদের ঘৃণ্য কুকর্ম, অপরাধ মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে, তাহলে বিস্ময়করভাবেই এখনো সে আহাম্মকের স্বর্গেই বাস করছে। কে ভুলে গেছে ইতিহাসে চেঙ্গিস, হালাকু, নাদির শাহের নৃশংসতা-বর্বরতার কথা।
হিটলার-মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, সভ্যতাবিধ্বংসী হত্যাযজ্ঞ-ধংসযজ্ঞের কথা! যেখানে যখনই সম্ভব হয়েছে, ক্ষমাহীনভাবে তাদের এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারীদের ধরে কাঠগড়ায় বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নতুন নাম গ্রহণ করে, কৌশল পাল্টে ইতিহাসে কখনোই তারা রেহাই পায়নি। জারতান্ত্রিক রাশিয়ায় 'ব্ল্যাক হানড্রেড'রা, জার্মানিতে গুপ্ত পুলিশ গেস্টাপোরা, 'এসএস' নাৎসিবাহিনী, ইতালির ফ্যাসিস্টরা, স্পেনের একনায়ক ফ্রাংকোর গুণ্ডাবাহিনী ফালাঞ্জিস্টরা ইতিহাসে চিরকালের ঘৃণার বস্তু। ইতিহাসের রক্তকুসুম কবি লোরকা ফালাঞ্জিস্টদের নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। ফ্রান্সের ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্পেন গণপ্রজাতন্ত্রের পক্ষে মুখোমুখি লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক রাইটার্স ব্রিগেডের র্যালফ ফক্স, কডওয়েল প্রমুখ আত্মাহুতি দিয়েছেন। স্পেনে ফ্রাংকোর গণহত্যার সব সাক্ষ্য মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয়েছে। তেমনি ইরানের শাহের 'সাবাক' গুপ্ত পুলিশ, ইংল্যান্ডের স্কিন হেড বা 'ন্যাড়া মাথা', আমেরিকার কুঠার ও মুখোশধারী 'কু ক্লাঙ্ ক্ল্যান'_এসব গুপ্তঘাতক দলের অত্যাচার-নির্যাতন-হিংস্রতা-বর্বরতা অনন্তকাল সভ্য ও গণতান্ত্রিকসমাজের কাছে ঘৃণ্য ও বিভীষিকার প্রতীক হয়েই থাকবে। রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতন ঘটেছে, পরে দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে টিকে থাকা সমাজতান্ত্রিকব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও জারতন্ত্র আর কোনো দিন সেখানে ফিরে আসবে! কিছুতেই না।
তেমনি এ উপমহাদেশেও পাশের দেশের 'আরএসএস', 'শিবসেনা', কিংবা এ দেশের একাত্তরের 'আলবদর', 'রাজাকার', 'আলশামস' বাহিনীর স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ, নারীধর্ষণ, হানাদার পাকিস্তানিদের কুকর্মের দোসর হয়ে এ দেশকে তাদের পদানত রাখতে সর্বতোভাবে সহায়তা করা কখনোই ইতিহাসে বিস্মৃত হওয়ার ও ক্ষমা পাওয়ার বিষয় নয়। নতুন নাম গ্রহণ করে তাদের গ্রেপ্তারকৃত নেতারা যদি ভাবে, মানুষ তাদের অতীত ইতিহাস ও চেহারা ভুলে যাবে, সমাজ তাদের একটি নিয়মতান্ত্রিক সভ্য শক্তি হিসেবে মেনে নেবে, তাহলে বুঝতে হবে, যুদ্ধাপরাধের অলঙ্ঘনীয় বিচার এবং তার রায় থেকে বাঁচার জন্য মরিয়া ও দিশেহারা হয়ে তাদের বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে গেছে।
তারই আভাস পাওয়া গেল কারাভ্যন্তর থেকে লেখা বলে প্রচারিত একাত্তরের আটক এক আলবদর কমান্ডারের চিঠিতে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের প্রতি দলীয় নেতৃত্ব ছাড়ার জন্য পরামর্শ প্রদান ও দলের নতুন কৌশল অবলম্বনের হেদায়েত থেকে। এ পরামর্শ ও কৌশল আনুষ্ঠানিকভাবে সে দলের পক্ষ থেকে দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে প্রচারিত হোক বা না হোক, আসন্ন স্বাধীনতা দিবস এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনালের রায় প্রদানের লগ্ন ঘনিয়ে আসতে দেখে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের মনে যে মৃত্যুদণ্ড ও শাস্তির ভয়ভীতি চরমে উঠেছে, সেটা বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিরা যে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পায়নি, ইতিহাসের এ অমোঘ দণ্ড তাদের বিচলিত করে রেখেছে। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন ঘাতক দল আলবদর, আলশামস, রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক এ দেশের অগণিত বাঙালির যেভাবে বাড়িঘর, সহায়সম্বল ধ্বংস করেছে, তাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম পদদলিত করেছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় শুধু 'চেজ' করে বেড়িয়েছে, আজ ইতিহাসের চাকা ঘুরে গিয়ে তাদেরই সেই ধাওয়া খাওয়ার পালা এসে গেছে। কিছুতেই বাঁচতে পারবে না তারা, মনের ভেতর থেকেই ধাওয়া খাচ্ছে তারা। হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেছে ইতিহাসের অমোঘ রায়ের কথা ভেবে। কিসের নতুন কৌশল, কিসের নাম পরিবর্তন, কিসের নতুন নেতৃত্ব খাড়া করার অলীক সব চিন্তা আজ আর কোনো কিছুতেই কাজে দেবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে, টোকিও ট্রায়াল থেকে, অন্য সব যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় বিভিন্ন দেশে গঠিত ট্রায়াল, রুয়ান্ডা ট্রায়াল, বসনিয়া ট্রায়াল, রাসেল ভিয়েতনাম যুদ্ধাপরাধ ট্রায়াল, পরিশেষে আজ বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক মানের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল_কোথাও যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষমা প্রদর্শনের কোনো রকম অবকাশই সৃষ্টি হয়নি। চিলিতে অসুস্থ ও বৃদ্ধ পলাতক যুদ্ধাপরাধী আগুস্তো পিনোশেকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, তবে কি না বিচারকালেই তাঁর মৃত্যু ঘটে যাওয়ায় তাঁর নৃশংস যুদ্ধাপরাধের মাত্র মরণোত্তর শাস্তিই হতে পারে, কিন্তু অপরাধ থেকে কারো রেহাই পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জার সম্রাট হিরোহিতোকে কেন বার্ধক্যহেতু শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে, এ প্রশ্ন জনমনে থেকেই গেছে।
এটা নেহাতই কল্পনাবিলাস যে কোনো রকম রাজনৈতিক সুবিধা বিনিময়ের মাধ্যমে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গণস্বার্থবিরোধী কোনো রকম সমীকরণের মাধ্যমে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের কোনো রকম অনুকম্পা প্রদর্শন বা প্রাপ্য দণ্ড লঘুকরণের সুযোগ এসে যাবে! সেটা একেবারেই আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র।
এ দেশের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীরা স্বাধীনতার পর নিজেদের নৃশংস সব অপরাধকে লঘু করার নানা চেষ্টা চালিয়েছে, হাস্যকর যুক্তি দিয়ে বলেছে, তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, কিন্তু নেহাত রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসেবে একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছে। এমন সব বিকৃত, উদ্ভট ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে জনমতকে বিভ্রান্ত করার বারংবার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছে তারা। জিয়া সামরিকতন্ত্রের বদৌলতে সংবিধানের অবৈধ পঞ্চম সংশোধনীর সুযোগে রাজনৈতিকভাবে সাময়িক পুনর্বাসিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত আঁকড়ে ধরার এবং জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের অবমাননা করার স্পর্ধাও তারা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু তার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কলঙ্কের হাত থেকে তারা রেহাই পায়নি।
তাদের বিচারপ্রক্রিয়া অপ্রতিরোধ্যভাবেই এগিয়ে চলেছে এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা, বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদকালেই তাদের আইনানুযায়ী যথাযোগ্য শাস্তিও পেতে হবে, পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের বাঁচাতে পারবে না।
অভিযুক্ত ও কারারুদ্ধ বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীরা বৃথাই ভাবছে, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের একটা কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা বা সমীকরণ হয়ে যাবে এবং যুদ্ধাপরাধীর সিল-ছাপ্পড়মারা দলের নেতাদের পেছনে ঠেলে দিয়ে নতুন মুখ খাড়া করতে পারলেই তাদের পরিপূর্ণ রাজনৈতিক পুনর্বাসন সম্ভব হয়ে যাবে। এটা বস্তুত পৃথিবীর কোথাওই হয়নি।
হিটলারের দেশ জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘ ৬৫ বছর পর এবং বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ের দুই দশক পর আজ হাতেগোনা দুয়েকটি প্রদেশে নিওনাৎসিরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালালেও সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের জার্মানিতে আদৌ তারা কোনো থই পাচ্ছে না। সত্য বটে, সে রকম দুয়েকটি প্রদেশে বহিরাগত অতিথিরা 'হিটলার ইজ মাই ফুয়েরার', 'হিটলার আমার অধিনায়ক' গান গেয়ে 'হেইল' ধ্বনি দিয়ে বহ্ন্যুৎসবের মাধ্যমে নাৎসিবাদের পুনর্জাগরণের চেষ্টা চালিয়ে থাকে, কিন্তু গোটা জার্মান রাষ্ট্রে তাদের প্রভাব একেবারেই নগণ্য। ইন্টারনেট সূত্রে এ রকম একটা প্রদেশ বা ক্ষুদ্র পল্লী ইয়ামেল নিওনাৎসিদের দখলে রয়েছে। সেখানে চরম ডানপন্থী ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এনপিডি নামের আড়ালে নিওনাৎসিরা স্থানীয় পার্লামেন্টেও স্থান করে নিয়েছে এবং অন্য পার্টিগুলোর বিরুদ্ধে যখন-তখন বর্বর হামলা চালিয়ে হিটলারের নামে স্লোগান দিয়ে তারা স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার দাপট দেখাতে চেষ্টা করে। কিন্তু জার্মানিতে নাৎসিবাদ নিষিদ্ধ এবং জার্মানিসহ সারা দুনিয়ায় নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের কার্যত মৃত্যুই ঘটে গেছে। এনপিডির মতো কোথাও নতুন নামের ছদ্মাবরণে নাৎসিবাদ তথা ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ও পুনর্বাসনের আজ আর বস্তুত কোনো সুযোগ নেই। এখানেও একাত্তরের ফ্যাসিবাদী ঘাতকরা নতুন নাম ধারণ করে নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যাচার করে কিছুতেই জনমনে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারবে না। যে নামেই, যে পরিচয়েই একাত্তরের মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক ঘাতকরা স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের ফ্যাসিবাদী সত্তাকে শামুকের মতো ভেতরে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা চালাক, এ দেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষ তাদের অতীত সম্পর্কসূত্র ঠিকই টেনে বের করে ফেলবে। তাদের ফ্যাসিবাদী দর্শন, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী দর্শন তাদের পদে পদে প্রকাশ হয়ে পড়বে। নিওনাৎসিরা যেমন নাম পাল্টে নাৎসিবাদকে মুছে ফেলতে পারেনি, সুযোগ পেলেই হিটলারকেই তাদের 'ফুয়েরার' বা অধিনায়ক গণ্য করে প্রাধান্য বিস্তার করতে চেষ্টা করে, তেমনি এ দেশেও পরিবর্তিত নাম-কৌশল গ্রহণ করেও একাত্তরের ঘাতকরা সুযোগ পেলেই আবার পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্ব আর তাদের প্রবর্তক ও অনুসারী প্রভুদের গুণগান করতে ও এ দেশকে আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে জড়ানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকবে।
বাঙালির এবং মানবতাবিরোধী সভ্যতা-সংস্কৃতির শত্রুদের কোনো অবশেষই এ দেশের মাটিতে আর ঠাঁই পাবে না। কারাভ্যন্তর থেকে পাঠানো আলবদর কমান্ডারের চিঠি নেহাতই একটা ঘৃণ্য কৌশল মাত্র, তাদের আটক বা বাইরে এখনো রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণরত নেতারা যতই এ সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রদর্শনের ভান করুক, সচেতন মানুষ তাদের নতুনভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার এ প্রচেষ্টাও ধরে ফেলতে দেরি করবে না এবং সর্বত্র প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করবে। ছাত্রশিবিরের ভেতর বিরোধ, বিভক্তি, এসবও যে জনমানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল মাত্র ছিল, সচেতন মানুষ তাও ধরে ফেলতে দেরি করেনি ।
৩০ লাখ শহীদ বাঙালি ও দুই লাখ নির্যাতিত নারী তাদের জীবনের সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এ দেশে স্বাধীনতার যে রক্তাক্ত ইতিহাস রচনা করেছে, তাদের চরম ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে এ দেশের উত্তর-প্রজন্ম কোনোক্রমেই মিথ্যা করে ফেলতে দেবে না। স্বাধীনতার ইতিহাস থাকবে চিরসমুজ্জ্বল, চিরঞ্জীব ও চিরস্মরণীয়। ঘাতকদের সব ঘৃণ্য প্রয়াসই মুছে যাবে, ইতিহাস মুছবে না।
০১.৩.২০১১
তেমনি এ উপমহাদেশেও পাশের দেশের 'আরএসএস', 'শিবসেনা', কিংবা এ দেশের একাত্তরের 'আলবদর', 'রাজাকার', 'আলশামস' বাহিনীর স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ, নারীধর্ষণ, হানাদার পাকিস্তানিদের কুকর্মের দোসর হয়ে এ দেশকে তাদের পদানত রাখতে সর্বতোভাবে সহায়তা করা কখনোই ইতিহাসে বিস্মৃত হওয়ার ও ক্ষমা পাওয়ার বিষয় নয়। নতুন নাম গ্রহণ করে তাদের গ্রেপ্তারকৃত নেতারা যদি ভাবে, মানুষ তাদের অতীত ইতিহাস ও চেহারা ভুলে যাবে, সমাজ তাদের একটি নিয়মতান্ত্রিক সভ্য শক্তি হিসেবে মেনে নেবে, তাহলে বুঝতে হবে, যুদ্ধাপরাধের অলঙ্ঘনীয় বিচার এবং তার রায় থেকে বাঁচার জন্য মরিয়া ও দিশেহারা হয়ে তাদের বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে গেছে।
তারই আভাস পাওয়া গেল কারাভ্যন্তর থেকে লেখা বলে প্রচারিত একাত্তরের আটক এক আলবদর কমান্ডারের চিঠিতে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের প্রতি দলীয় নেতৃত্ব ছাড়ার জন্য পরামর্শ প্রদান ও দলের নতুন কৌশল অবলম্বনের হেদায়েত থেকে। এ পরামর্শ ও কৌশল আনুষ্ঠানিকভাবে সে দলের পক্ষ থেকে দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে প্রচারিত হোক বা না হোক, আসন্ন স্বাধীনতা দিবস এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনালের রায় প্রদানের লগ্ন ঘনিয়ে আসতে দেখে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের মনে যে মৃত্যুদণ্ড ও শাস্তির ভয়ভীতি চরমে উঠেছে, সেটা বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিরা যে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পায়নি, ইতিহাসের এ অমোঘ দণ্ড তাদের বিচলিত করে রেখেছে। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন ঘাতক দল আলবদর, আলশামস, রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক এ দেশের অগণিত বাঙালির যেভাবে বাড়িঘর, সহায়সম্বল ধ্বংস করেছে, তাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম পদদলিত করেছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় শুধু 'চেজ' করে বেড়িয়েছে, আজ ইতিহাসের চাকা ঘুরে গিয়ে তাদেরই সেই ধাওয়া খাওয়ার পালা এসে গেছে। কিছুতেই বাঁচতে পারবে না তারা, মনের ভেতর থেকেই ধাওয়া খাচ্ছে তারা। হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেছে ইতিহাসের অমোঘ রায়ের কথা ভেবে। কিসের নতুন কৌশল, কিসের নাম পরিবর্তন, কিসের নতুন নেতৃত্ব খাড়া করার অলীক সব চিন্তা আজ আর কোনো কিছুতেই কাজে দেবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে, টোকিও ট্রায়াল থেকে, অন্য সব যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় বিভিন্ন দেশে গঠিত ট্রায়াল, রুয়ান্ডা ট্রায়াল, বসনিয়া ট্রায়াল, রাসেল ভিয়েতনাম যুদ্ধাপরাধ ট্রায়াল, পরিশেষে আজ বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক মানের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল_কোথাও যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষমা প্রদর্শনের কোনো রকম অবকাশই সৃষ্টি হয়নি। চিলিতে অসুস্থ ও বৃদ্ধ পলাতক যুদ্ধাপরাধী আগুস্তো পিনোশেকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, তবে কি না বিচারকালেই তাঁর মৃত্যু ঘটে যাওয়ায় তাঁর নৃশংস যুদ্ধাপরাধের মাত্র মরণোত্তর শাস্তিই হতে পারে, কিন্তু অপরাধ থেকে কারো রেহাই পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জার সম্রাট হিরোহিতোকে কেন বার্ধক্যহেতু শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে, এ প্রশ্ন জনমনে থেকেই গেছে।
এটা নেহাতই কল্পনাবিলাস যে কোনো রকম রাজনৈতিক সুবিধা বিনিময়ের মাধ্যমে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে গণস্বার্থবিরোধী কোনো রকম সমীকরণের মাধ্যমে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের কোনো রকম অনুকম্পা প্রদর্শন বা প্রাপ্য দণ্ড লঘুকরণের সুযোগ এসে যাবে! সেটা একেবারেই আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র।
এ দেশের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীরা স্বাধীনতার পর নিজেদের নৃশংস সব অপরাধকে লঘু করার নানা চেষ্টা চালিয়েছে, হাস্যকর যুক্তি দিয়ে বলেছে, তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, কিন্তু নেহাত রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসেবে একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছে। এমন সব বিকৃত, উদ্ভট ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে জনমতকে বিভ্রান্ত করার বারংবার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছে তারা। জিয়া সামরিকতন্ত্রের বদৌলতে সংবিধানের অবৈধ পঞ্চম সংশোধনীর সুযোগে রাজনৈতিকভাবে সাময়িক পুনর্বাসিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত আঁকড়ে ধরার এবং জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের অবমাননা করার স্পর্ধাও তারা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু তার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কলঙ্কের হাত থেকে তারা রেহাই পায়নি।
তাদের বিচারপ্রক্রিয়া অপ্রতিরোধ্যভাবেই এগিয়ে চলেছে এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা, বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদকালেই তাদের আইনানুযায়ী যথাযোগ্য শাস্তিও পেতে হবে, পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের বাঁচাতে পারবে না।
অভিযুক্ত ও কারারুদ্ধ বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীরা বৃথাই ভাবছে, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের একটা কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা বা সমীকরণ হয়ে যাবে এবং যুদ্ধাপরাধীর সিল-ছাপ্পড়মারা দলের নেতাদের পেছনে ঠেলে দিয়ে নতুন মুখ খাড়া করতে পারলেই তাদের পরিপূর্ণ রাজনৈতিক পুনর্বাসন সম্ভব হয়ে যাবে। এটা বস্তুত পৃথিবীর কোথাওই হয়নি।
হিটলারের দেশ জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘ ৬৫ বছর পর এবং বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ের দুই দশক পর আজ হাতেগোনা দুয়েকটি প্রদেশে নিওনাৎসিরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালালেও সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের জার্মানিতে আদৌ তারা কোনো থই পাচ্ছে না। সত্য বটে, সে রকম দুয়েকটি প্রদেশে বহিরাগত অতিথিরা 'হিটলার ইজ মাই ফুয়েরার', 'হিটলার আমার অধিনায়ক' গান গেয়ে 'হেইল' ধ্বনি দিয়ে বহ্ন্যুৎসবের মাধ্যমে নাৎসিবাদের পুনর্জাগরণের চেষ্টা চালিয়ে থাকে, কিন্তু গোটা জার্মান রাষ্ট্রে তাদের প্রভাব একেবারেই নগণ্য। ইন্টারনেট সূত্রে এ রকম একটা প্রদেশ বা ক্ষুদ্র পল্লী ইয়ামেল নিওনাৎসিদের দখলে রয়েছে। সেখানে চরম ডানপন্থী ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এনপিডি নামের আড়ালে নিওনাৎসিরা স্থানীয় পার্লামেন্টেও স্থান করে নিয়েছে এবং অন্য পার্টিগুলোর বিরুদ্ধে যখন-তখন বর্বর হামলা চালিয়ে হিটলারের নামে স্লোগান দিয়ে তারা স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার দাপট দেখাতে চেষ্টা করে। কিন্তু জার্মানিতে নাৎসিবাদ নিষিদ্ধ এবং জার্মানিসহ সারা দুনিয়ায় নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের কার্যত মৃত্যুই ঘটে গেছে। এনপিডির মতো কোথাও নতুন নামের ছদ্মাবরণে নাৎসিবাদ তথা ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ও পুনর্বাসনের আজ আর বস্তুত কোনো সুযোগ নেই। এখানেও একাত্তরের ফ্যাসিবাদী ঘাতকরা নতুন নাম ধারণ করে নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যাচার করে কিছুতেই জনমনে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারবে না। যে নামেই, যে পরিচয়েই একাত্তরের মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক ঘাতকরা স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের ফ্যাসিবাদী সত্তাকে শামুকের মতো ভেতরে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা চালাক, এ দেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষ তাদের অতীত সম্পর্কসূত্র ঠিকই টেনে বের করে ফেলবে। তাদের ফ্যাসিবাদী দর্শন, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী দর্শন তাদের পদে পদে প্রকাশ হয়ে পড়বে। নিওনাৎসিরা যেমন নাম পাল্টে নাৎসিবাদকে মুছে ফেলতে পারেনি, সুযোগ পেলেই হিটলারকেই তাদের 'ফুয়েরার' বা অধিনায়ক গণ্য করে প্রাধান্য বিস্তার করতে চেষ্টা করে, তেমনি এ দেশেও পরিবর্তিত নাম-কৌশল গ্রহণ করেও একাত্তরের ঘাতকরা সুযোগ পেলেই আবার পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্ব আর তাদের প্রবর্তক ও অনুসারী প্রভুদের গুণগান করতে ও এ দেশকে আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে জড়ানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকবে।
বাঙালির এবং মানবতাবিরোধী সভ্যতা-সংস্কৃতির শত্রুদের কোনো অবশেষই এ দেশের মাটিতে আর ঠাঁই পাবে না। কারাভ্যন্তর থেকে পাঠানো আলবদর কমান্ডারের চিঠি নেহাতই একটা ঘৃণ্য কৌশল মাত্র, তাদের আটক বা বাইরে এখনো রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণরত নেতারা যতই এ সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রদর্শনের ভান করুক, সচেতন মানুষ তাদের নতুনভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার এ প্রচেষ্টাও ধরে ফেলতে দেরি করবে না এবং সর্বত্র প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করবে। ছাত্রশিবিরের ভেতর বিরোধ, বিভক্তি, এসবও যে জনমানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল মাত্র ছিল, সচেতন মানুষ তাও ধরে ফেলতে দেরি করেনি ।
৩০ লাখ শহীদ বাঙালি ও দুই লাখ নির্যাতিত নারী তাদের জীবনের সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এ দেশে স্বাধীনতার যে রক্তাক্ত ইতিহাস রচনা করেছে, তাদের চরম ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে এ দেশের উত্তর-প্রজন্ম কোনোক্রমেই মিথ্যা করে ফেলতে দেবে না। স্বাধীনতার ইতিহাস থাকবে চিরসমুজ্জ্বল, চিরঞ্জীব ও চিরস্মরণীয়। ঘাতকদের সব ঘৃণ্য প্রয়াসই মুছে যাবে, ইতিহাস মুছবে না।
০১.৩.২০১১
No comments