বিধানসভা নির্বাচন-মুসলিম বিশ্বে নৈরাজ্য কেন? by খালিদ আজিজ

পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলে শান্তি ও মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে মানব নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও অহিংসাভিত্তিক অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। অঞ্চলটির যুব সম্প্রদায়ের দাবিও তা-ই


চলতি মাসের প্রথমদিকে পশ্চিম এশিয়া-উত্তর আফ্রিকা (ওয়ানা) ফোরামের উদ্যোগে ওই অঞ্চলের বিরাজমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য আয়োজিত বিশেষজ্ঞ বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে পারাটা আমার কাছে একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। ওই অঞ্চলের বিশিষ্ট প্রগতিশীল চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত প্রিন্স হাসান বিন তালালের উদ্যোগে ২০০৯ সালে এ উদ্যোগের সূচনা হয়। ওয়ানা অঞ্চলটির রয়েছে প্রভূত জ্বালানিসম্পদ। অঞ্চলটি মরক্কো থেকে পাকিস্তান এবং তুরস্ক থেকে সুদান পর্যন্ত বিস্তৃত। আর শান্তি, সামাজিক ঐক্য-প্রবণতা, মানবিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে এ অঞ্চলের জরুরি সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান অ্যাড্রেস করার জন্যই এই বেসরকারি ও অদলীয় নাগরিক উদ্যোগ। বিভিন্ন ধর্ম ও বিচিত্র পটভূমির মানুষ নিয়ে এই অঞ্চল তিনটি ফ্যাক্টর দ্বারা ঐক্যবদ্ধ।
প্রথমটি হলো এই অঞ্চলের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পূর্ণ স্বাধীনতায় উত্তরণ, যেটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়েছিল এবং এখনও অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের হয় জ্বালানিসম্পদ রয়েছে, নতুবা তাদের রয়েছে ভৌগোলিক দিক থেকে বৃহৎ শক্তিবর্গকে আকর্ষণের মতো গুরুত্ব।
তৃতীয়ত, এই অঞ্চলের রয়েছে বিরাট যুবশক্তি। ২৫ বছরের কম বয়সীর সংখ্যা এখানে মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি। অথচ তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। এখানকার দেশগুলোয় তাদের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অধিকাংশ সময় একনায়কত্ববাদী শাসন পরিচালিত। প্রায় সব ক্ষেত্রেই সহিংসতার মাধ্যমেই ক্ষমতা বজায় রাখা হয়।
ইয়েমেন এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সৌদি আরবের যেন কোনো নড়নচড়ন নেই বা নিশ্চল অবস্থা। সরকারি আলোচনা থেকে গণতন্ত্র এখানে নির্বাসিত। তেল বিক্রিলব্ধ আয়ের মাধ্যমে অধিকাংশের বশ্যতা ও আনুগত্য আদায় করার মাধ্যমে এ ধরনের সরকার দৃশ্যত স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীল হলেও এহেন স্থিতিশীলতার মধ্যেও ব্যাপক দুঃখ-দুর্দশাজাত ক্ষোভের কারণে সহিংসতা ও জন-অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান। লেবানন ও ইরাকের মতো নমনীয় রাষ্ট্রযুদ্ধের আতঙ্কের অবস্থায় রয়েছে। এ দুটি দেশ সম্প্রতি যুদ্ধের ধকল সয়েছে এবং এরা এখন স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য ব্যগ্র। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে স্থিতিশীল দেশ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। তবে মাই ইয়ামানি মনে করেন, এই অঞ্চল তথা মুসলিম বিশ্বে প্রকৃত পরিবর্তন একমাত্র আসতে পারে সৌদি আরবের গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে। পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলে চলমান ওয়াহাবি মতবাদপ্রসূত সহিংসতাও এর ফলে কমে আসবে। যেসব নেতা ও তরুণ সম্মিলিতভাবে এই পরিবর্তন সাধনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ওপর সম্মেলনে আলোকপাত করা হয়। প্রিন্স তালাল নতুন মাইন্ডসেট গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এই মানসিকতা হবে হস্তক্ষেপবিরোধী ও নিবৃত্তিমূলক। আর এই মানসিকতা হতাশার অতলে তলিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক, আইনগত, পেশাগত, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক বর্ম তৈরি করবে। সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করতে অভিন্ন মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক রীতির সংহতকরণ দরকার হয়। লিবিয়ার বিদ্রোহী অন্তর্বর্তী ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের গুমা এল-সামাতির মতে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পর কোনো সরকারের বৈধতা থাকে না। লিবিয়ায় সত্যিকারের কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান-সংস্থার অস্তিত্ব নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তার মতে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতা এ অঞ্চলের প্রভূত প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনে ব্যাপক অসাম্য সৃষ্টি করে। তার এই মন্তব্য পাকিস্তানের বেলায়ও খাটে।
মিসরের সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও মিসরীয় বিপ্লবের যুবজোটের কারিশম্যাটিক নেতা শ্যালি মুরি সম্মেলনে আবেগঘন বক্তব্য দেন। তিনি বিপ্লব চলার সময় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবাসহ পৌর ও অন্যান্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের চেয়েও বেশি দক্ষতার পরিচয় দেয় বলে উল্লেখ করেন। জনগণ পরস্পরের ও পরিবেশের যত্ন নেয়। বিপ্লবের কেন্দ্র তাহরির স্কয়ারের পাশের একটি মসজিদে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেখানে মানুষকে খাদ্যসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হতো। শুধু তা-ই নয়, মুসলমান ও খ্রিস্টানরা এই একই মসজিদে নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী নামাজ ও প্রার্থনা করত। এটা জনগণের মধ্যে বিপ্লব সঞ্চারিত ভ্রাতৃত্ববোধের প্রকাশ। অথচ এই চেতনা অত্যাচার ও শক্তির জোরে টিকে থাকা স্বৈরাচারী সরকারের আমলে ভেঙে পড়েছিল।
টুইটার, ফেসবুক ও ইন্টারনেটের মতো সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মানুষ অনেক কিছু জানতে পারে। এখান থেকেই মানুষ দিকনির্দেশনা পায়। আরবনেটের ওমর ক্রিস্টিডিসের মতে, সে সময় সেলফোন মুক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। এখন পশ্চিমা শক্তিকেও অনুধাবন করতে হবে, স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান বজায় রাখা যাবে না।
ওয়ানা অঞ্চলে জনগণের মনোভাবে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে, সেটা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। তবে এই পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বলে সবাই মনে করেন। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর পাকিস্তান এখন রাজনৈতিক ঝড়ের আবর্তের কেন্দ্রে রয়েছে। করাচিতে নৌঘাঁটিতে জঙ্গি হামলা যেমন দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতির বাস্তব আশঙ্কাজনক অবস্থাকে তুলে ধরছে, তেমনি জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হওয়াকেও মূর্ত করছে। ওয়ানার বিভিন্ন দেশের যুব শক্তির উত্তুঙ্গ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো গণআন্দোলনের মুখে পড়তে যাচ্ছে পাকিস্তান।
যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনকে চিরতরে সরিয়ে দিলেও তার অনুসৃত কট্টরপন্থা সৌদি ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদের মাধ্যমে অনুরণিত হচ্ছে। ১৯৭৯ সালে মক্কায় হামলার পর সৌদি আরব ওয়ানা ও বিশ্বের অন্যত্র ওয়াহাবি মতবাদ প্রচারের জন্য এ পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে। ফলে বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলে শান্তি ও মানব-উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে মানব নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও অহিংসাভিত্তিক অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার ও আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। অঞ্চলটির যুব সম্প্রদায়ের দাবিও তা-ই।

খালিদ আজিজ : পেশোয়ারে রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব পলিসি রিসার্চের চেয়ারম্যান
ডন থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.