রবীন্দ্রনাথের রান্নাঘরে-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাচক by আখতার হুসেন
আমাদের প্রসঙ্গিত মানুষটির খোঁজ পেয়েছিলাম বিশ শতকের আটের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে। খোদ রবীন্দ্রনাথের রসুইঘরে ঠাঁই পাওয়া মুসলমান পাচক গেদু মিয়ার খোঁজ দিয়েছিলেন প্রয়াত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক। বলেছিলেন বটে, তবে কোথায় তিনি থাকেন, সে কথা ঠিকঠাকমতো বলতে পারেননি।
কেবল বলেছিলেন, পিয়নের কাজ করেন সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে। সেই সূত্র ধরেই ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে তাঁকে পেয়ে যাই গ্রিন রোডের গ্রিন সুপার মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত উল্লিখিত দপ্তরের দোরগোড়া লাগোয়া নিরিবিলি একটা কক্ষে। আপন মনে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। আমি তাঁর সঙ্গে একটুক্ষণ কথা বলতে চাই, এ অভিপ্রায় জানাতেই বলছিলেন, তাঁর খোঁজ কে দিয়েছেন? আমি ওয়াহিদুল হক ভাইয়ের কথা বলতেই বলেছিলেন, ‘তাহলে তো আর আপনাকে ফেরানো যাবে না।’
আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, আপনি রবীন্দ্রনাথের একেবারে অন্দরমহলে কীভাবে ঢুকে পড়েছিলেন, সে কথা জানতে চাই। জানতে চাই, কীভাবে তাঁর বাবুর্চি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন? অসম্ভব নম্র ও ভদ্র স্বভাবের আবদুন নূর, গেদু মিয়া নামেই যিনি সমধিক পরিচিত, বলেছিলেন, ‘সে তো গল্পকাহিনির মতো ঘটনা!’
গোড়ার কথা
গেদু মিয়া বলেছিলেন, ‘আমার বাড়ি বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শাহবাজপুরের মিঞাহাটিতে। বর্তমান উপজেলা সরাইল। দারিদ্র্যের সংসার। অবিভক্ত ভারতে ঢাকার চেয়ে কলকাতাতেই কাজকর্মের সুযোগ ছিল বেশি। ফলে ১৪ বছর বয়সে মামার হাত ধরে কলকাতা মহানগরে গিয়ে উপস্থিত হই ১৯৩০ কি ১৯৩১ সালের দিকে। মামার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল কলকাতার কাজ করেন, এমন একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের। যত দূর মনে করতে পারি, তার নাম ছিল জর্জ গ্রেগরি। ‘এই জর্জ সাহেব একজন লোক খুঁজছিলেন, যে তাঁকে রান্নাবান্নার কাজে সাহায্য করবে। বিশেষ করে, ঝাল-মসলাহীন সেদ্ধ খাবার। লোক পেলে তিনি তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবেন। আমার মামা আমার কথা জর্জ সাহেবকে বলতেই তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে যেতে বলেন। আমাকে দেখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পছন্দ করেন। তাঁর স্ত্রী আমাকে মসলাছাড়া সেদ্ধ খাবার রাঁধাবাড়ার কাজ অল্প দিনের মধ্যেই শিখিয়ে দেন। আমার রান্না খেয়ে খুব খুশি সেই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। পরে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ তখন হজমশক্তির গোলমালজনিত পেটের পীড়ায় ভুগছিলেন। এ কথা কথাচ্ছলে একদিন তিনি সেই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান। বলতেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁকে মসলাবিহীন সেদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জবাবে বলেছিলেন, তেমন বাবুর্চি পাব কোথায়? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তখন আমার কথা রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি আমাকে নিতে রাজি থাকলে তাঁর কাছে আমাকে যখন-তখন হাজির করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ এককথায় রাজি হয়ে যান। ইংরেজ সেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমি কাজ করেছিলাম মোট আট বছর। তাঁর বাগানের পরিচর্যাও করতাম আমি।’
রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি
গেদু মিয়া স্মৃতি হাতড়ে বলে চলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেগরি তাঁর মোটরগাড়িতে করেই আমাকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সালটা মনে হয় ১৯৩৯। নিয়ে গিয়েছিলেন ছায়াঢাকা পরিবেশ শান্তিনিকেতনে। আমি তো ভয়ে জবুথবু। আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই দারোয়ান গোছের একটা লোক এসে আমাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি ঘরে ঢুকে ‘আদাব’ দিতেই রবীন্দ্রনাথ আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন আমার নাম। এবং যখন জানলেন আমি জাতে মুসলমান, তখন তিনি বললেন, “শোনো গেদু মিয়া, আমার কাছে জাতপাত বলে কিছু নেই। কিন্তু আমার রান্নাঘরে আরও দুজন বাবুর্চি আছে—একজন ব্রাহ্মণ, অন্যজন উড়িয়া। ওরা এখন থেকে আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য রান্না করবে। আর তুমি বিশেষভাবে রান্না করবে আমার জন্য। তবে খুব সাবধানে থাকবে, ব্রাহ্মণ ও উড়িয়া পাচক দুজনের কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখবে। বলবে, তুমি বাঙালি, রবীন্দ্রনাথের ধর্ম তোমার ধর্ম।” এ কথা বলেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলের বউকে ডেকে আনেন এবং আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে যেতে। এভাবেই শুরু হলো রবীন্দ্রনাথের বাবুর্চি বা পাচক হিসেবে আমার নতুন কাজের জীবন। মোট দুবছর তাঁর সান্নিধ্যে ছিলাম—১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত। ১৯৪০ সালের পর থেকে তিনি ঘন ঘন অসুস্থ হতে থাকলে আমাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুরোপুরি ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে চলে যান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাকে একটা সার্টিফিকেট বা প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন নিজের হাতে লিখে। আমি তাঁকে যেসব পাত্রে স্যুপ রেঁধে খাওয়াতাম, সেই সব পাত্র থেকে একটা পাত্র তিনি আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন একটা হুঁকো। আমাকে বিদায় করার দিন বলেছিলেন, “গেদু (‘মিয়া’ বলতেন না ইচ্ছে করেই), আমার তো দিন শেষ। আমি এখন পুরোপুরি ডাক্তারের কবলে। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাকে বিদায় দিতে হচ্ছে। উড়িয়া এবং ব্রাহ্মণ পাঁচক দুজনকেও একই কারণে বিদায় দিতে হচ্ছে।” আবার আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল সেই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। এবার পাচক হিসেবে নয়, বাগানের মালী হিসেবে। সেখানে কাজ করতে করতেই ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম। সারা কলকাতা শহর সেদিন ভেঙে পড়েছিল। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট দম্পতিকেও ভয়ানক বিষণ্ন হতে দেখেছিলাম। মনের অগোচরে আমারও দুচোখ ভিজে উঠেছিল।’
কবিগুরুর নিবিড় সান্নিধ্যে
রবীন্দ্রনাথের রসুইঘরে ঠাঁই পাওয়ার এক মাসের মাথাতেই গেদু মিয়াকে চলে আসতে হয় কালিম্পংয়ে। সঙ্গে তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। উঠেছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মহারাজার বাড়িতে। গেদু মিয়া বলতে থাকেন, ‘সেবার এখানে মাস তিনেকের মতো ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখানে থাকতে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যার স্মৃতি এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। যেমন, একবার আমার সঙ্গে সেই উড়িয়া ও ব্রাহ্মণ পাচক একটু দুর্ব্যবহার করার পর সে কথা তাঁকে বলতেই তিনি আমাকে বলেছিলেন, “শোনো গেদু, ওরা তোমাকে ঈর্ষা করে তুমি নোবেল পুরস্কার পাওয়া রবীন্দ্রনাথের জন্য রান্না করো বলে। ওদের গুরুত্ব তুমি আসার পর কমে গেছে বলে। আমি সাবধান করতে গেলে ওরা তোমাকে পদে পদে হেনস্তা করবে। ওদেরকে আমি শায়েস্তা করাব প্রতিমা আর রথীকে দিয়ে।” ফল ফলেছিল। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী সেই উড়িয়া আর ব্রাহ্মণ পাচককে এই বলে শাসিয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা যদি আমার সঙ্গে কোনো রকম দুর্ব্যবহার করে, তাহলে তাদেরকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে।
‘আরও একদিনের ঘটনা,’ গেদু মিয়া বলতে থাকেন, ‘রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। তখনো আমরা কালিম্পংয়ে। ওই রকম এক নির্জন এলাকাতেও তাঁর জন্মদিনে লোকজনের কমতি নেই। দর্শনার্থীর পর দর্শনার্থী। রবীন্দ্রনাথ সবাইকে আশীর্বাদ করছেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে। ভোর থেকে শুরু করে একই রকম ঘটনা ঘটে চলে প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত। কবির জন্য উপহার হিসেবেও অনেকে অনেক কিছু নিয়ে আসেন। কেউ কেউ কবিকে মিষ্টিমুখও করান। কবি নামেমাত্র মিষ্টি খেয়ে মিষ্টির পাত্র পাশে সরিয়ে রাখতে বলেন। যখন দর্শনার্থীরা আর আসেন না, একে একে তাঁরা চলে যান, কবি তখন একান্তে আমাকে ডেকে বলেন, “গেদু, মিষ্টিগুলো নিয়ে যাও। তুমি খেয়ো।” আমি মিষ্টির পাত্রগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই তিনি আমাকে ডেকে থামান, “শোনো, মিষ্টি উড়িয়া আর ব্রাহ্মণটাকেও দিয়ো। মনে রেখো, মিষ্টি যখন বিলোবে, তখন ওদের মুখে হাসি দেখবে। সুখে সবাইকে পাশে পাবে। দুঃখের সময় কাউকেই পাবে না। কথাটা ভুলো না।” রবীন্দ্রনাথের এই উপদেশের কথা এখনো ভুলে যাইনি।’ গেদু মিয়া তাঁর স্মৃতি হাতড়ে চলেন, ‘তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, “সব সময় সাবধানে থাকবে। আমার কাছে সব ধর্মের মানুষই সমান। বুদ্ধিমানের কাজ কি, জানো? তার কাজ হলো চোখ ও কান খোলা রাখা। মুখ বন্ধ রাখা। জুতমতো কথা বলা।” যত দিন তাঁর কাছে ছিলাম, তত দিন তাঁর এই উপদেশ মনে রাখার চেষ্টা করেছি।’
তাঁর জনপ্রিয়তা, শেষ বয়সেও
‘১৯৩৯ সালের দিকেই, যত দূর মনে করতে পারি,’ গেদু মিয়া বলে চলেন, ‘কালিম্পং থেকে ফেরার পথে আমাদের ট্রেন বদল করে করে নানা জায়গায় যেতে হয়েছিল। যেতে হয়েছিল উত্তরবঙ্গের নানা জায়গায়। ঈশ্বরদী স্টেশনের কথা মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথকে একনজর দেখার জন্য প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, ছেলে রথীন্দ্রনাথ এবং আরও বেশ কয়েকজন। সেবার তাঁকে কুষ্টিয়া ও রানাঘাটেও যেতে হয়েছিল। শিয়ালদা স্টেশন না আসা পর্যন্ত যে কত স্টেশনে তাঁকে বহন করা ট্রেনকে থামতে হয়েছিল, নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে স্টেশনের পর স্টেশন ছাড়তে হয়েছিল, সেসব কথা ভাবলে মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, মানুষও তাঁকে ভালোবাসত গভীরভাবে।’
‘বিশ্বের সব ধর্মগ্রন্থ আমি পড়েছি’
গেদু মিয়া থেমে থেমে বলতে থাকেন তাঁর স্বভাবসুলভ নম্র ভঙ্গিতে, ‘১৯৪০ সালের শুরুর দিক সেটা। তখন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা লাগালাগির উপক্রম হয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে। এই অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন তাঁর শোবার ঘরে। যেতেই বললেন, “গেদু, সাবধানে চলবে। ধর্মান্ধ সব বর্বরের দল কীসব করছে, যেকোনো সময় রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। আমি বুঝি না, এরা কি ধর্মগ্রন্থ ভালো করে পড়েনি! তোমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ আমি বাংলায় পড়েছি। বেদ-বাইবেল থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ পড়েছি। সেখানে মানুষে মানুষে ভালোবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথাকেই বড় করে দেখানো হয়েছে। এরা ধর্ম বোঝে না। ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ লুটতে চায়।” আমি মাথা নত করে থাকি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ব্রাহ্মণের বাচ্চাটা কী বলে?” আমি বলি, সত্যি কথাই বলি, উড়িয়া আর ব্রাহ্মণ বাবুর্চি এখন আমাকে পাক্কা হিন্দু ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। তাই নিরাপদেই আছি। রবীন্দ্রনাথ আমার কথা শুনে একটু জোরেই হো হো করে সেদিন হেসে উঠেছিলেন।’
বাঙালি মুসলমান-সমাজ নিয়ে ভাবনা
‘কালিম্পংয়ে থাকতেই ব্যাপারটা আমার চোখে ধরা পড়ে বেশি করে,’ বলতে থাকেন গেদু মিয়া, ‘কবি সঙ্গে করে যে ট্রাংক নিয়ে যেতেন, সেটা থাকত প্রয়োজনীয় বইপত্রে ঠাসা। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তিনি বই পড়তেন। পড়তে পড়তে পানির পিপাসা লাগলে কিংবা হালকা কিছু খাবারের প্রয়োজন হলে আমাকে, উড়িয়া বা ব্রাহ্মণ পাচককে ডাকতেন। তখুনি ব্যাপারটা নজরে আসত। একদিন এইভাবে ডাকার পর আমাকে তিনি বললেন, “গেদু, বাঙালি মুসলমান-সমাজের নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকাটা আমার মোটেই ভালো লাগে না। কবে যে জাতটা জাগবে! তোমাদের এলাকার মুসলমানদের অবস্থা কেমন?” আমি আমাদের সাধারণ মুসলমান-সমাজের, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কথা বলতেই তিনি বললেন, “সংখ্যায় বাঙালি হিন্দুদের চাইতে মুসলমান বাঙালিরা বেশি, তবু তাদের মধ্যে জাগরণের চিহ্নমাত্র নেই। তবে আমি একজনের দেখা পেয়েছি, তাকে দিয়ে যদি কিছু হয়। তিনি ফজলুল হক (শেরেবাংলা)। ভবিষ্যতে তুমি বিয়ে করলে তোমার ছেলেমেয়েকে মানুষ করার চেষ্টা করবে, গেদু।” খুবই আন্তরিকতার সুরে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। এই তো আমার স্মৃতি সেই মহান মানুষটির সঙ্গে। আমি তো আর ভাষাটাষা বুঝি না। আপনি ঠিকঠাক করে দেবেন।’
শেষ জীবন
আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা শাহাদাৎ হোসেন বিস্তর ঘোরাঘুরি ও কাঠখড় পোড়ানো শেষে হদিস পেয়েছেন গেদু মিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। তিনি ছিলেন দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি ১৯১৬ সালে। মারা যান ২০০১ সালের ২৯ অক্টোবর। ১৯৬৬ সালের দিকে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরে চাকরি নেন। সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালের দিকে। বিরোধী দলে থাকার সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও গেদু মিয়ার একবার দেখা হয়েছিল। তিনি তাঁর হাতের করা কিছু কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ির আশপাশের প্রাঙ্গণকে তিনি জীবদ্দশায় পরিণত করেছিলেন একটা মনোরম উদ্যানে। যাপন করতেন সহজ-সরল জীবন। নিয়মিত পালন করতেন নামাজ ও রোজা। স্বল্পভাষী ছিলেন। এলাকায় কারও সঙ্গে তাঁর কোনো ধরনের বিবাদ-বিসম্বাদ ছিল না।
আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, আপনি রবীন্দ্রনাথের একেবারে অন্দরমহলে কীভাবে ঢুকে পড়েছিলেন, সে কথা জানতে চাই। জানতে চাই, কীভাবে তাঁর বাবুর্চি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন? অসম্ভব নম্র ও ভদ্র স্বভাবের আবদুন নূর, গেদু মিয়া নামেই যিনি সমধিক পরিচিত, বলেছিলেন, ‘সে তো গল্পকাহিনির মতো ঘটনা!’
গোড়ার কথা
গেদু মিয়া বলেছিলেন, ‘আমার বাড়ি বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শাহবাজপুরের মিঞাহাটিতে। বর্তমান উপজেলা সরাইল। দারিদ্র্যের সংসার। অবিভক্ত ভারতে ঢাকার চেয়ে কলকাতাতেই কাজকর্মের সুযোগ ছিল বেশি। ফলে ১৪ বছর বয়সে মামার হাত ধরে কলকাতা মহানগরে গিয়ে উপস্থিত হই ১৯৩০ কি ১৯৩১ সালের দিকে। মামার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল কলকাতার কাজ করেন, এমন একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের। যত দূর মনে করতে পারি, তার নাম ছিল জর্জ গ্রেগরি। ‘এই জর্জ সাহেব একজন লোক খুঁজছিলেন, যে তাঁকে রান্নাবান্নার কাজে সাহায্য করবে। বিশেষ করে, ঝাল-মসলাহীন সেদ্ধ খাবার। লোক পেলে তিনি তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবেন। আমার মামা আমার কথা জর্জ সাহেবকে বলতেই তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে যেতে বলেন। আমাকে দেখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পছন্দ করেন। তাঁর স্ত্রী আমাকে মসলাছাড়া সেদ্ধ খাবার রাঁধাবাড়ার কাজ অল্প দিনের মধ্যেই শিখিয়ে দেন। আমার রান্না খেয়ে খুব খুশি সেই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। পরে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ তখন হজমশক্তির গোলমালজনিত পেটের পীড়ায় ভুগছিলেন। এ কথা কথাচ্ছলে একদিন তিনি সেই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান। বলতেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁকে মসলাবিহীন সেদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জবাবে বলেছিলেন, তেমন বাবুর্চি পাব কোথায়? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তখন আমার কথা রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি আমাকে নিতে রাজি থাকলে তাঁর কাছে আমাকে যখন-তখন হাজির করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ এককথায় রাজি হয়ে যান। ইংরেজ সেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমি কাজ করেছিলাম মোট আট বছর। তাঁর বাগানের পরিচর্যাও করতাম আমি।’
রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি
গেদু মিয়া স্মৃতি হাতড়ে বলে চলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেগরি তাঁর মোটরগাড়িতে করেই আমাকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সালটা মনে হয় ১৯৩৯। নিয়ে গিয়েছিলেন ছায়াঢাকা পরিবেশ শান্তিনিকেতনে। আমি তো ভয়ে জবুথবু। আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই দারোয়ান গোছের একটা লোক এসে আমাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি ঘরে ঢুকে ‘আদাব’ দিতেই রবীন্দ্রনাথ আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন আমার নাম। এবং যখন জানলেন আমি জাতে মুসলমান, তখন তিনি বললেন, “শোনো গেদু মিয়া, আমার কাছে জাতপাত বলে কিছু নেই। কিন্তু আমার রান্নাঘরে আরও দুজন বাবুর্চি আছে—একজন ব্রাহ্মণ, অন্যজন উড়িয়া। ওরা এখন থেকে আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য রান্না করবে। আর তুমি বিশেষভাবে রান্না করবে আমার জন্য। তবে খুব সাবধানে থাকবে, ব্রাহ্মণ ও উড়িয়া পাচক দুজনের কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখবে। বলবে, তুমি বাঙালি, রবীন্দ্রনাথের ধর্ম তোমার ধর্ম।” এ কথা বলেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলের বউকে ডেকে আনেন এবং আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে যেতে। এভাবেই শুরু হলো রবীন্দ্রনাথের বাবুর্চি বা পাচক হিসেবে আমার নতুন কাজের জীবন। মোট দুবছর তাঁর সান্নিধ্যে ছিলাম—১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত। ১৯৪০ সালের পর থেকে তিনি ঘন ঘন অসুস্থ হতে থাকলে আমাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুরোপুরি ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে চলে যান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাকে একটা সার্টিফিকেট বা প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন নিজের হাতে লিখে। আমি তাঁকে যেসব পাত্রে স্যুপ রেঁধে খাওয়াতাম, সেই সব পাত্র থেকে একটা পাত্র তিনি আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন একটা হুঁকো। আমাকে বিদায় করার দিন বলেছিলেন, “গেদু (‘মিয়া’ বলতেন না ইচ্ছে করেই), আমার তো দিন শেষ। আমি এখন পুরোপুরি ডাক্তারের কবলে। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাকে বিদায় দিতে হচ্ছে। উড়িয়া এবং ব্রাহ্মণ পাঁচক দুজনকেও একই কারণে বিদায় দিতে হচ্ছে।” আবার আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল সেই ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। এবার পাচক হিসেবে নয়, বাগানের মালী হিসেবে। সেখানে কাজ করতে করতেই ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম। সারা কলকাতা শহর সেদিন ভেঙে পড়েছিল। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট দম্পতিকেও ভয়ানক বিষণ্ন হতে দেখেছিলাম। মনের অগোচরে আমারও দুচোখ ভিজে উঠেছিল।’
কবিগুরুর নিবিড় সান্নিধ্যে
রবীন্দ্রনাথের রসুইঘরে ঠাঁই পাওয়ার এক মাসের মাথাতেই গেদু মিয়াকে চলে আসতে হয় কালিম্পংয়ে। সঙ্গে তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। উঠেছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মহারাজার বাড়িতে। গেদু মিয়া বলতে থাকেন, ‘সেবার এখানে মাস তিনেকের মতো ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখানে থাকতে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যার স্মৃতি এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। যেমন, একবার আমার সঙ্গে সেই উড়িয়া ও ব্রাহ্মণ পাচক একটু দুর্ব্যবহার করার পর সে কথা তাঁকে বলতেই তিনি আমাকে বলেছিলেন, “শোনো গেদু, ওরা তোমাকে ঈর্ষা করে তুমি নোবেল পুরস্কার পাওয়া রবীন্দ্রনাথের জন্য রান্না করো বলে। ওদের গুরুত্ব তুমি আসার পর কমে গেছে বলে। আমি সাবধান করতে গেলে ওরা তোমাকে পদে পদে হেনস্তা করবে। ওদেরকে আমি শায়েস্তা করাব প্রতিমা আর রথীকে দিয়ে।” ফল ফলেছিল। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী সেই উড়িয়া আর ব্রাহ্মণ পাচককে এই বলে শাসিয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা যদি আমার সঙ্গে কোনো রকম দুর্ব্যবহার করে, তাহলে তাদেরকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে।
‘আরও একদিনের ঘটনা,’ গেদু মিয়া বলতে থাকেন, ‘রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। তখনো আমরা কালিম্পংয়ে। ওই রকম এক নির্জন এলাকাতেও তাঁর জন্মদিনে লোকজনের কমতি নেই। দর্শনার্থীর পর দর্শনার্থী। রবীন্দ্রনাথ সবাইকে আশীর্বাদ করছেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে। ভোর থেকে শুরু করে একই রকম ঘটনা ঘটে চলে প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত। কবির জন্য উপহার হিসেবেও অনেকে অনেক কিছু নিয়ে আসেন। কেউ কেউ কবিকে মিষ্টিমুখও করান। কবি নামেমাত্র মিষ্টি খেয়ে মিষ্টির পাত্র পাশে সরিয়ে রাখতে বলেন। যখন দর্শনার্থীরা আর আসেন না, একে একে তাঁরা চলে যান, কবি তখন একান্তে আমাকে ডেকে বলেন, “গেদু, মিষ্টিগুলো নিয়ে যাও। তুমি খেয়ো।” আমি মিষ্টির পাত্রগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই তিনি আমাকে ডেকে থামান, “শোনো, মিষ্টি উড়িয়া আর ব্রাহ্মণটাকেও দিয়ো। মনে রেখো, মিষ্টি যখন বিলোবে, তখন ওদের মুখে হাসি দেখবে। সুখে সবাইকে পাশে পাবে। দুঃখের সময় কাউকেই পাবে না। কথাটা ভুলো না।” রবীন্দ্রনাথের এই উপদেশের কথা এখনো ভুলে যাইনি।’ গেদু মিয়া তাঁর স্মৃতি হাতড়ে চলেন, ‘তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, “সব সময় সাবধানে থাকবে। আমার কাছে সব ধর্মের মানুষই সমান। বুদ্ধিমানের কাজ কি, জানো? তার কাজ হলো চোখ ও কান খোলা রাখা। মুখ বন্ধ রাখা। জুতমতো কথা বলা।” যত দিন তাঁর কাছে ছিলাম, তত দিন তাঁর এই উপদেশ মনে রাখার চেষ্টা করেছি।’
তাঁর জনপ্রিয়তা, শেষ বয়সেও
‘১৯৩৯ সালের দিকেই, যত দূর মনে করতে পারি,’ গেদু মিয়া বলে চলেন, ‘কালিম্পং থেকে ফেরার পথে আমাদের ট্রেন বদল করে করে নানা জায়গায় যেতে হয়েছিল। যেতে হয়েছিল উত্তরবঙ্গের নানা জায়গায়। ঈশ্বরদী স্টেশনের কথা মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথকে একনজর দেখার জন্য প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, ছেলে রথীন্দ্রনাথ এবং আরও বেশ কয়েকজন। সেবার তাঁকে কুষ্টিয়া ও রানাঘাটেও যেতে হয়েছিল। শিয়ালদা স্টেশন না আসা পর্যন্ত যে কত স্টেশনে তাঁকে বহন করা ট্রেনকে থামতে হয়েছিল, নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে স্টেশনের পর স্টেশন ছাড়তে হয়েছিল, সেসব কথা ভাবলে মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, মানুষও তাঁকে ভালোবাসত গভীরভাবে।’
‘বিশ্বের সব ধর্মগ্রন্থ আমি পড়েছি’
গেদু মিয়া থেমে থেমে বলতে থাকেন তাঁর স্বভাবসুলভ নম্র ভঙ্গিতে, ‘১৯৪০ সালের শুরুর দিক সেটা। তখন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা লাগালাগির উপক্রম হয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে। এই অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন তাঁর শোবার ঘরে। যেতেই বললেন, “গেদু, সাবধানে চলবে। ধর্মান্ধ সব বর্বরের দল কীসব করছে, যেকোনো সময় রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। আমি বুঝি না, এরা কি ধর্মগ্রন্থ ভালো করে পড়েনি! তোমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ আমি বাংলায় পড়েছি। বেদ-বাইবেল থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ পড়েছি। সেখানে মানুষে মানুষে ভালোবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথাকেই বড় করে দেখানো হয়েছে। এরা ধর্ম বোঝে না। ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ লুটতে চায়।” আমি মাথা নত করে থাকি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ব্রাহ্মণের বাচ্চাটা কী বলে?” আমি বলি, সত্যি কথাই বলি, উড়িয়া আর ব্রাহ্মণ বাবুর্চি এখন আমাকে পাক্কা হিন্দু ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। তাই নিরাপদেই আছি। রবীন্দ্রনাথ আমার কথা শুনে একটু জোরেই হো হো করে সেদিন হেসে উঠেছিলেন।’
বাঙালি মুসলমান-সমাজ নিয়ে ভাবনা
‘কালিম্পংয়ে থাকতেই ব্যাপারটা আমার চোখে ধরা পড়ে বেশি করে,’ বলতে থাকেন গেদু মিয়া, ‘কবি সঙ্গে করে যে ট্রাংক নিয়ে যেতেন, সেটা থাকত প্রয়োজনীয় বইপত্রে ঠাসা। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তিনি বই পড়তেন। পড়তে পড়তে পানির পিপাসা লাগলে কিংবা হালকা কিছু খাবারের প্রয়োজন হলে আমাকে, উড়িয়া বা ব্রাহ্মণ পাচককে ডাকতেন। তখুনি ব্যাপারটা নজরে আসত। একদিন এইভাবে ডাকার পর আমাকে তিনি বললেন, “গেদু, বাঙালি মুসলমান-সমাজের নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকাটা আমার মোটেই ভালো লাগে না। কবে যে জাতটা জাগবে! তোমাদের এলাকার মুসলমানদের অবস্থা কেমন?” আমি আমাদের সাধারণ মুসলমান-সমাজের, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কথা বলতেই তিনি বললেন, “সংখ্যায় বাঙালি হিন্দুদের চাইতে মুসলমান বাঙালিরা বেশি, তবু তাদের মধ্যে জাগরণের চিহ্নমাত্র নেই। তবে আমি একজনের দেখা পেয়েছি, তাকে দিয়ে যদি কিছু হয়। তিনি ফজলুল হক (শেরেবাংলা)। ভবিষ্যতে তুমি বিয়ে করলে তোমার ছেলেমেয়েকে মানুষ করার চেষ্টা করবে, গেদু।” খুবই আন্তরিকতার সুরে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। এই তো আমার স্মৃতি সেই মহান মানুষটির সঙ্গে। আমি তো আর ভাষাটাষা বুঝি না। আপনি ঠিকঠাক করে দেবেন।’
শেষ জীবন
আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা শাহাদাৎ হোসেন বিস্তর ঘোরাঘুরি ও কাঠখড় পোড়ানো শেষে হদিস পেয়েছেন গেদু মিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। তিনি ছিলেন দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি ১৯১৬ সালে। মারা যান ২০০১ সালের ২৯ অক্টোবর। ১৯৬৬ সালের দিকে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরে চাকরি নেন। সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালের দিকে। বিরোধী দলে থাকার সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও গেদু মিয়ার একবার দেখা হয়েছিল। তিনি তাঁর হাতের করা কিছু কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ির আশপাশের প্রাঙ্গণকে তিনি জীবদ্দশায় পরিণত করেছিলেন একটা মনোরম উদ্যানে। যাপন করতেন সহজ-সরল জীবন। নিয়মিত পালন করতেন নামাজ ও রোজা। স্বল্পভাষী ছিলেন। এলাকায় কারও সঙ্গে তাঁর কোনো ধরনের বিবাদ-বিসম্বাদ ছিল না।
No comments