বৈসাবি উৎসবের একদিন by সাদিয়া আরমান
সেদিন খাগড়াছড়ি শহরের এলজিইডি ভবনকে লাল-হলুদ-সবুজে সুসজ্জিত করা হয়েছে। রঙবেরঙের কাপড়ে মোড়ানো গেটে বড় করে লেখা আছে বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু উৎসব। ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা_ এ তিন জাতি বাংলার নতুন বছরের প্রথমাকে এ তিনটি নামে বরণ করে। সম্মিলিতভাবে যার নাম বৈ-সা-বি।
এলজিইডি ভবনে আদিবাসী মহিলারা বাসায় তৈরি নানা পিঠা ও মজার মজার খাবার এনে স্টল করেছে, যেমন চুমো (যেটা বাঁশের ভেতর রান্না করা মাছ) স্টল। আমরা ঢাকা থেকে আটজন এই উৎসব পালন করতে এপ্রিলের ১০ তারিখে খাগড়াছড়ি সদরে পেঁৗছলাম। সেখানে যাওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ৭টার দিকে। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় এলজিইডি ভবনে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী চলে আসায় উৎসবের আমেজটা সেদিনটার মতো ফিকে হয়ে গেল। পাহাড়িরা আমাদের জানাল, যাওয়াটা নিরাপদ হবে না। পরদিন ১১ তারিখ পাহাড়িরা বৈসাবি র্যালি করবে নানা জায়গায়। দলে দলে তরুণীরা বছরের নতুন পিনন ও হাদি গায়ে চুল সাজিয়ে গয়না কানে, মালা গলায় বের হয়েছে। চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা তিন জাতির সাজ একটু ভিন্ন হলেও কাছাকাছি। ওরা এলাকা অনুযায়ী একই রকম রঙের ডিজাইনের জামা পরে, যেন থোকা থোকা রজনীগন্ধা, গাদা গোলাপ, মাধবীলতা। পাহাড়ি টমটম, পিকআপ গাড়ি এবং মানুষের পদচারে মিছিলের বন্যা বয়ে যাচ্ছে সদরে। ও মা সেকি উল্লাস! আনন্দের পল্গাবন! সেকি উৎসবীয় চিৎকার বেজে ওঠে গান ও পাহাড়ি-সুরে! গোলাপি ঠোঁটের চিত্তিবো স্বরচিত এক গান গেয়ে ওঠে। সে তার গানের মাঝে তার সুগঠিত ডান বাহু উঁচু করে এক গগনভেদী চিৎকার দেয়, যাতে হৃদয় শিউরে ওঠে। সে স্লোগান দেয়, 'লনাসাই, লনাসাই, লনাসাই'_ 'আমরা নেবই, নেবই, নেবই।' কী সেই অমৃতের ফুল যে এই রূপসী নেবেই? সেদিন যুবক-যুবতীদের চোখে এক সংগ্রামী চমক দেখতে পেয়েছি। সাত বছর ধরে কেউ বৈসাবি উৎসব পালন করেনি। সে বৈসাবি যার উন্মুক্ত আমেজ আমাদের ঈদুল ফিতরকে ফিকে করে দেয়। সেই বৈসাবি যাতে দিনের পর দিন উৎসবের আয়োজন চলে, বাসায় বাসায় রকমারি খাবারের সে বৈসাবি যাতে মারমা যুবক-যুবতীরা নেচে নেচে পানি খেলা করে, কাছা-মেলা পুরুষরা খেলে গিলা খেলা, মহিলারা খেলে ধ-চি খেলা, সেই বৈসাবি যাতে হাঁস-মুরগিকেও স্মরণ করে ভোরবেলা পেটভরে খাওয়ানো হয়, বাসায় বাসায় গিয়ে বৃদ্ধদের গোসল করিয়ে দেয় শ্রদ্ধার সঙ্গে তরুণ-তরুণীরা।
সাত বছর আগে ২৬ আগস্ট ২০০৩ খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার ১নং ইউনিয়নে লেমুছড়ি, বাবুপাড়া, নাখালপাড়া, নোয়াপাড়া এবং দুরবুচ্চনালায় ৩৬৪টি বাসা পুুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাহাড়িরা বলে, 'আমাদের ভাইবোনদের বাসা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা সব হারিয়েছে, তারা কীভাবে বৈসাবি করবেন? আমরাও-বা কীভাবে করব?' গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাঙামাটির বাঘাচরি থানার সাজেক ইউনিয়নে প্রায় ৪০০ পাহাড়ি বাসাবাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। পাহাড়ি জনগণ যখন প্রতিবাদ মিছিল করেছে তখন তাদের তাড়া করে মহাজনপাড়া, নারিকেলপাড়া এবং সাতভাইয়াপাড়াতে তাদের বাসাবাড়ি এবং দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বৈসাবি আসলে অবৈধ গাছ কাটা, বাসা পোড়ানো এসব ঘটনা বেড়ে যায়। এবারও যখন বৈসাবির আমেজে সুরেশ চাকমার বাসায় আমরা সবাই গিয়েছি, তখন শুনেছি যে নানিয়ারচরের এক সংরক্ষিত বনানীতে বাঁশ কাটা হয়েছে। এ ঘটনাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হচ্ছে। মনে করা হয়েছে, বৈসাবিতে সব পাহাড়ি মেতে থাকবে, প্রতিবাদ করবে না। সুরেশ দাদা পুুরনো স্মৃতি স্মরণ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, 'এই রকম হতে থাকলে হয়তো বৈসাবি উৎসবই একদিন বিলীন হয়ে যাবে, কেউ আর বৈসাবী উদযাপন করবে না।'
আদি বাঙালি বসবাসকারী ও পাহাড়িদের মধ্যে যুগে যুগে এক বোঝাপড়া হয়ে এসেছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত নতুন লোকজনকে নোয়াখালী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ইত্যাদি জায়গা থেকে সরকার নিয়ে আসছে বসবাসের ভূমি এবং বাগানের সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ সব ধরনের লোকই তো আছে। তবে খুব বেশি স্বচ্ছ বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ নয়, হলে আর এভাবে আসত না। অনেক দুর্বৃত্ত রয়েছে যাদের আছে ভূমি গ্রাসের লোভ আছে, আছে লুটপাট ও ধর্ষণের মনোবৃত্তি।
পাহাড়ি জনগণের দুঃখ-বেদনা ও হাহাকারের কথা শোনার মতো, বোঝার মতো কেউ নেই। নিরপেক্ষ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের সেখানে তদন্ত করতে পাঠাতে হবে। সেটা হতে পারে খ্যাতনামা, সৎ এবং গুণী নাগরিকের একটি দল যাদের নিরপেক্ষতার ওপর সরকার এবং পাহাড়ি জনগণ দুই পক্ষেরই আস্থা আছে। অন্য দেশগুলোর মতো এটা একটি পাবলিক কমিশনও হতে পারে, যার সভাপতি হবেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অথবা কোনো নামকরা আইনজীবী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম মবড়-ংঃৎধঃবমরপধষষু এবং
মবড়-ঢ়ড়ষরঃরপধষষু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক মহলে কয়েক রাষ্ট্রের নজর এর ওপর রয়েছে। সেনাবাহিনী নিয়োগের এটাও একটি কারণ। কোনো এলাকা নিয়ে দুশ্চিন্তার প্রয়োজন হয় না; কিন্তু যখনই জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা যায় তখনই আন্তর্জাতিক দৃষ্টি তার ওপর পড়ে, এরপর কীভাবে দুর্বলতাকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো যায় সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। এটা হয়েছে এই দেশে একাত্তরের সময়, এটা হয়েছে ইরাকে, এটা হচ্ছে এখন লিবিয়াতে। তাহলে কেন আমরা ইতিহাস এবং বর্তমান থেকে শিক্ষা নেই না। গুলি, কামান এবং গোয়েন্দা হয়রানি যেখানে জেতে না, সেখানে জনগণের পক্ষের রাজনীতির জয় অবশ্যই হবে।
sadhna_3@yahoo.co.uk
সাত বছর আগে ২৬ আগস্ট ২০০৩ খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার ১নং ইউনিয়নে লেমুছড়ি, বাবুপাড়া, নাখালপাড়া, নোয়াপাড়া এবং দুরবুচ্চনালায় ৩৬৪টি বাসা পুুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাহাড়িরা বলে, 'আমাদের ভাইবোনদের বাসা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা সব হারিয়েছে, তারা কীভাবে বৈসাবি করবেন? আমরাও-বা কীভাবে করব?' গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাঙামাটির বাঘাচরি থানার সাজেক ইউনিয়নে প্রায় ৪০০ পাহাড়ি বাসাবাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। পাহাড়ি জনগণ যখন প্রতিবাদ মিছিল করেছে তখন তাদের তাড়া করে মহাজনপাড়া, নারিকেলপাড়া এবং সাতভাইয়াপাড়াতে তাদের বাসাবাড়ি এবং দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বৈসাবি আসলে অবৈধ গাছ কাটা, বাসা পোড়ানো এসব ঘটনা বেড়ে যায়। এবারও যখন বৈসাবির আমেজে সুরেশ চাকমার বাসায় আমরা সবাই গিয়েছি, তখন শুনেছি যে নানিয়ারচরের এক সংরক্ষিত বনানীতে বাঁশ কাটা হয়েছে। এ ঘটনাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হচ্ছে। মনে করা হয়েছে, বৈসাবিতে সব পাহাড়ি মেতে থাকবে, প্রতিবাদ করবে না। সুরেশ দাদা পুুরনো স্মৃতি স্মরণ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, 'এই রকম হতে থাকলে হয়তো বৈসাবি উৎসবই একদিন বিলীন হয়ে যাবে, কেউ আর বৈসাবী উদযাপন করবে না।'
আদি বাঙালি বসবাসকারী ও পাহাড়িদের মধ্যে যুগে যুগে এক বোঝাপড়া হয়ে এসেছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত নতুন লোকজনকে নোয়াখালী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ইত্যাদি জায়গা থেকে সরকার নিয়ে আসছে বসবাসের ভূমি এবং বাগানের সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ সব ধরনের লোকই তো আছে। তবে খুব বেশি স্বচ্ছ বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ নয়, হলে আর এভাবে আসত না। অনেক দুর্বৃত্ত রয়েছে যাদের আছে ভূমি গ্রাসের লোভ আছে, আছে লুটপাট ও ধর্ষণের মনোবৃত্তি।
পাহাড়ি জনগণের দুঃখ-বেদনা ও হাহাকারের কথা শোনার মতো, বোঝার মতো কেউ নেই। নিরপেক্ষ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের সেখানে তদন্ত করতে পাঠাতে হবে। সেটা হতে পারে খ্যাতনামা, সৎ এবং গুণী নাগরিকের একটি দল যাদের নিরপেক্ষতার ওপর সরকার এবং পাহাড়ি জনগণ দুই পক্ষেরই আস্থা আছে। অন্য দেশগুলোর মতো এটা একটি পাবলিক কমিশনও হতে পারে, যার সভাপতি হবেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অথবা কোনো নামকরা আইনজীবী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম মবড়-ংঃৎধঃবমরপধষষু এবং
মবড়-ঢ়ড়ষরঃরপধষষু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক মহলে কয়েক রাষ্ট্রের নজর এর ওপর রয়েছে। সেনাবাহিনী নিয়োগের এটাও একটি কারণ। কোনো এলাকা নিয়ে দুশ্চিন্তার প্রয়োজন হয় না; কিন্তু যখনই জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা যায় তখনই আন্তর্জাতিক দৃষ্টি তার ওপর পড়ে, এরপর কীভাবে দুর্বলতাকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো যায় সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। এটা হয়েছে এই দেশে একাত্তরের সময়, এটা হয়েছে ইরাকে, এটা হচ্ছে এখন লিবিয়াতে। তাহলে কেন আমরা ইতিহাস এবং বর্তমান থেকে শিক্ষা নেই না। গুলি, কামান এবং গোয়েন্দা হয়রানি যেখানে জেতে না, সেখানে জনগণের পক্ষের রাজনীতির জয় অবশ্যই হবে।
sadhna_3@yahoo.co.uk
No comments