আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৫)-'শব্দসৈনিক' হয়ে বেঁচে থাকা by আলী যাকের
কাজলকে দেখামাত্র এ কথাগুলো বিদ্যুতের তরঙ্গের মতো আমার করোটিতে খেলে গেল। মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। 'এই দোকানে বসে আমি রোজই তোকে দেখি এর সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে। ইচ্ছে করেই ডাকি না। যদি চিনতে না পারিস?' 'বলিস কী কাজল! এখানে তোদের চেয়ে আপন আমার আর কে আছে? কাকাবাবু কেমন? কাকি মা?
দীপু, মনীষা ওরা?' 'দেখবি? চল আমাদের বাড়ি।' এরপর আর কোনো কথা হয় না। আমি গুটি গুটি চলতে থাকি কাজলের পেছনে পেছনে। গলি, গলি, তস্য গলি। যাদবপুরের প্রায় বস্তি অঞ্চলে একটা দুই কামরার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যায় কাজল। আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় কাজলদের গেণ্ডারিয়ার বাড়ির কথা। বারো ঘরওয়ালা চক মেলানো দোতলা বাড়ি। বাড়ির পেছনে বিস্তীর্ণ বাগান। হেন গাছ নেই যা ছিল না ওই বাগানে।
কাজলের বাবা জবুথবু হয়ে গেছেন যেন। কেবল ঘোলাটে চোখে চেয়ে থাকেন। কোনো কথাই বলেন না। কাজলের মা যেন দুই হাতে প্রাণপণ যুদ্ধ করে ধরে রেখেছেন সংসারটা। আমাকে বলেন, 'কেমন আছস তুই? তোর মা-বাবা?' আমার মা-বাবা গত হয়েছেন শুনে মর্মাহত হন। আমি জানতে পারি, দীপু বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় এক মোটর মেকানিকের সঙ্গে। তারপর আর তার কোনো খোঁজ নেই। মনীষার বিয়ে হয়ে গেছে। কলকাতা করপোরেশনে চাকরি করে ওর বর। থাকে পাইকপাড়ায়। কাজলের মায়ের হাতের নারিকেলের নাড়ু ভীষণ পছন্দ করতাম আমি। সে কথা আজও মনে আছে কাকি মার। বললেন, 'এখন তো নাই। কাজল ওরে আরেক দিন নিয়া আসিস।'
ফেরার পথে কাজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, 'কী থেকে কী হয়ে গেল। সব স্বপ্ন একেবারে ভেঙেচুড়ে শেষ।' 'তুই কী করিস?' 'কিচ্ছু না। এখানে আসার পর বাবা চাকরি-বাকরির কোনো হিল্লে করতে পারলেন না। অতএব, আমাকে একটা মোটর গ্যারেজে শিক্ষানবিসির চাকরি নিতে হলো। উদ্দেশ্য, মোটর মেকানিক যদি হওয়া যায়? ওইখানেই যতীনের সঙ্গে পরিচয়। আমার ওস্তাদ ছিল। দীপুকে নিয়ে সে চলে যায়। আমার আর মেকানিক হয়ে ওঠা হলো না। যখন যা পাই টুকটাক করি। জীবনের ওপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। তোরা আছিস বেশ। একটা কিছুর জন্য লড়ে যাচ্ছিস। জীবনের একটা পারপাস আছে।' মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল আমার। অথচ এই কাজল ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয়। মরণপণ যুদ্ধ করেও কখনো ওকে হারাতে পারিনি আমি। ওকে আমার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে বিদায় নিলাম।
এই কলকাতা চমৎকৃত করে আমাকে। এখানেই তো ঘটনাচক্রে মৈত্রেয়ী দেবীর মতো মানুষের সঙ্গে পরিচয়। বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রতি আছে যার অকণ্ঠ সমর্থন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি প্রচণ্ড মমত্ববোধ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁদের যখন পরিচয়, তখন তিনি নিতান্তই বালিকা। এরপর বিস্তর কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাঁর একটি গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা রবীন্দ্রজীবনের এক অধ্যায়ের ওপরে একটি সন্দর্ভই বলা যেতে পারে। তিনি প্রথম পরিচয়েই আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, 'এখানকার পত্রপত্রিকাকে কিন্তু একদম বিশ্বাস করবে না। ওদের যত আদিখ্যেতা ঠোঁটের আগায় সীমাবদ্ধ। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কুচক্রী। আমাদের এখানকার সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে উসকানি দিতে ওদের জুড়ি নেই।' এখানেই আলাপ প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী নিলীমা সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ছান্দসিক প্রবোধ চন্দ্র সেনের মেয়ে সংঘমিত্রা এবং জামাতা দ্বিজদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁদের বাড়িতে যে কত দিন, কত রাত কেটেছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে তার হিসাব নেই। দূর থেকে শ্রদ্ধাভরে দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাসকে।
এরই মধ্যে আলাপ হয়েছে এককালের কমিউনিস্ট পার্টির নিরলস কর্মী জলিমোহন কল ও মনিকন্তলা কলের সঙ্গে। তাঁরা আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই আপন করে নিয়েছেন। ঘটনাচক্রে পরিচয় হয়েছে সফল বিজনেস এক্সিকিউটিভ অমিতাভ রায়ের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। অমিতরা ময়মনসিংহের মানুষ। দেশ ছেড়েছে ওর বয়স যখন ১০ কী ১২। অমিতের অনুরোধ কেবল একটাই, বাংলাদেশ যদি কখনো স্বাধীন হয়, তাহলে যেন একবার ওকে ময়মনসিংহ শহরে ওদের বাড়ি দেখার ব্যবস্থা করে দিই আমি। ও কেবল একবার যে ঘরে ওর জন্ম হয়েছিল, সেই ঘরটি দেখতে চায়।
কলকাতায় এ সময় প্রতিদিন বাংলাদেশকে নিয়ে একটা না একটা সুখবর কিংবা দুঃসংবাদ পাওয়া যেত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল সংবাদাগার। খবরগুলো সেখানেই প্রথম এসে পৌঁছত। এক দিন সকালবেলা আমি কেন্দ্রে ঢুকছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম সৈয়দ হাসান ইমাম বেরিয়ে আসছেন। ফ্যাকাসে চেহারা। যেন ভীষণ একটা দুঃসংবাদ বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে আমার। এই কয় দিন আগেই পৌঁছেছে লে. আশফাকুস সামাদের অকালে ঝরে যাওয়ার কথা। আমাকে দেখে হাসান ইমাম থমকে দাঁড়ান। কোনোমতে অশ্রু সংবরণ করে বলেন, 'খবর জানিস? আমাদের মাহবুব আর নেই।' 'কী!' চিৎকার করে উঠি আমি। কল্পনাও করা যায় না মাহবুব, মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, অন্তরঙ্গ বন্ধু, আর নেই।
সেই দিন কোনোমতে নিজের বরাদ্দ কাজ শেষ করে উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম। সন্ধ্যার ঠিক আগে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি। বহতা গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এই যে বেঁচে থাকা, 'শব্দসৈনিক' হয়ে, এটা বোধ হয় একধরনের আপস, জীবনের সঙ্গে। এ রকম আপস করেই কী বেঁচে থাকতে হবে আজীবন? সব কিছু অর্থহীন বলে
মনে হয়।
(চলবে...)
কাজলের বাবা জবুথবু হয়ে গেছেন যেন। কেবল ঘোলাটে চোখে চেয়ে থাকেন। কোনো কথাই বলেন না। কাজলের মা যেন দুই হাতে প্রাণপণ যুদ্ধ করে ধরে রেখেছেন সংসারটা। আমাকে বলেন, 'কেমন আছস তুই? তোর মা-বাবা?' আমার মা-বাবা গত হয়েছেন শুনে মর্মাহত হন। আমি জানতে পারি, দীপু বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় এক মোটর মেকানিকের সঙ্গে। তারপর আর তার কোনো খোঁজ নেই। মনীষার বিয়ে হয়ে গেছে। কলকাতা করপোরেশনে চাকরি করে ওর বর। থাকে পাইকপাড়ায়। কাজলের মায়ের হাতের নারিকেলের নাড়ু ভীষণ পছন্দ করতাম আমি। সে কথা আজও মনে আছে কাকি মার। বললেন, 'এখন তো নাই। কাজল ওরে আরেক দিন নিয়া আসিস।'
ফেরার পথে কাজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, 'কী থেকে কী হয়ে গেল। সব স্বপ্ন একেবারে ভেঙেচুড়ে শেষ।' 'তুই কী করিস?' 'কিচ্ছু না। এখানে আসার পর বাবা চাকরি-বাকরির কোনো হিল্লে করতে পারলেন না। অতএব, আমাকে একটা মোটর গ্যারেজে শিক্ষানবিসির চাকরি নিতে হলো। উদ্দেশ্য, মোটর মেকানিক যদি হওয়া যায়? ওইখানেই যতীনের সঙ্গে পরিচয়। আমার ওস্তাদ ছিল। দীপুকে নিয়ে সে চলে যায়। আমার আর মেকানিক হয়ে ওঠা হলো না। যখন যা পাই টুকটাক করি। জীবনের ওপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। তোরা আছিস বেশ। একটা কিছুর জন্য লড়ে যাচ্ছিস। জীবনের একটা পারপাস আছে।' মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল আমার। অথচ এই কাজল ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয়। মরণপণ যুদ্ধ করেও কখনো ওকে হারাতে পারিনি আমি। ওকে আমার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে বিদায় নিলাম।
এই কলকাতা চমৎকৃত করে আমাকে। এখানেই তো ঘটনাচক্রে মৈত্রেয়ী দেবীর মতো মানুষের সঙ্গে পরিচয়। বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রতি আছে যার অকণ্ঠ সমর্থন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি প্রচণ্ড মমত্ববোধ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁদের যখন পরিচয়, তখন তিনি নিতান্তই বালিকা। এরপর বিস্তর কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাঁর একটি গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা রবীন্দ্রজীবনের এক অধ্যায়ের ওপরে একটি সন্দর্ভই বলা যেতে পারে। তিনি প্রথম পরিচয়েই আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, 'এখানকার পত্রপত্রিকাকে কিন্তু একদম বিশ্বাস করবে না। ওদের যত আদিখ্যেতা ঠোঁটের আগায় সীমাবদ্ধ। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কুচক্রী। আমাদের এখানকার সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে উসকানি দিতে ওদের জুড়ি নেই।' এখানেই আলাপ প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী নিলীমা সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ছান্দসিক প্রবোধ চন্দ্র সেনের মেয়ে সংঘমিত্রা এবং জামাতা দ্বিজদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁদের বাড়িতে যে কত দিন, কত রাত কেটেছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে তার হিসাব নেই। দূর থেকে শ্রদ্ধাভরে দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাসকে।
এরই মধ্যে আলাপ হয়েছে এককালের কমিউনিস্ট পার্টির নিরলস কর্মী জলিমোহন কল ও মনিকন্তলা কলের সঙ্গে। তাঁরা আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই আপন করে নিয়েছেন। ঘটনাচক্রে পরিচয় হয়েছে সফল বিজনেস এক্সিকিউটিভ অমিতাভ রায়ের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। অমিতরা ময়মনসিংহের মানুষ। দেশ ছেড়েছে ওর বয়স যখন ১০ কী ১২। অমিতের অনুরোধ কেবল একটাই, বাংলাদেশ যদি কখনো স্বাধীন হয়, তাহলে যেন একবার ওকে ময়মনসিংহ শহরে ওদের বাড়ি দেখার ব্যবস্থা করে দিই আমি। ও কেবল একবার যে ঘরে ওর জন্ম হয়েছিল, সেই ঘরটি দেখতে চায়।
কলকাতায় এ সময় প্রতিদিন বাংলাদেশকে নিয়ে একটা না একটা সুখবর কিংবা দুঃসংবাদ পাওয়া যেত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল সংবাদাগার। খবরগুলো সেখানেই প্রথম এসে পৌঁছত। এক দিন সকালবেলা আমি কেন্দ্রে ঢুকছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম সৈয়দ হাসান ইমাম বেরিয়ে আসছেন। ফ্যাকাসে চেহারা। যেন ভীষণ একটা দুঃসংবাদ বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে আমার। এই কয় দিন আগেই পৌঁছেছে লে. আশফাকুস সামাদের অকালে ঝরে যাওয়ার কথা। আমাকে দেখে হাসান ইমাম থমকে দাঁড়ান। কোনোমতে অশ্রু সংবরণ করে বলেন, 'খবর জানিস? আমাদের মাহবুব আর নেই।' 'কী!' চিৎকার করে উঠি আমি। কল্পনাও করা যায় না মাহবুব, মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, অন্তরঙ্গ বন্ধু, আর নেই।
সেই দিন কোনোমতে নিজের বরাদ্দ কাজ শেষ করে উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম। সন্ধ্যার ঠিক আগে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি। বহতা গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এই যে বেঁচে থাকা, 'শব্দসৈনিক' হয়ে, এটা বোধ হয় একধরনের আপস, জীবনের সঙ্গে। এ রকম আপস করেই কী বেঁচে থাকতে হবে আজীবন? সব কিছু অর্থহীন বলে
মনে হয়।
(চলবে...)
No comments