ইতিহাসের দায়মুক্তি by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
ইতিহাসকে গল্পের কাঠামোয় নিয়ে আসতে পারাটা একটা জটিল কাজ। ইতিহাসের সত্যগুলো এতে আড়ালে চলে যেতে পারে, কোনো গৌণ চরিত্র অথবা ঘটনা অকারণ গুরুত্ব অর্জন করতে পারে। গল্প-উপন্যাসের আখ্যান এগোয় তার সূত্র ধরে, ইতিহাসের আখ্যান নির্দিষ্ট হয় ইতিহাসের নিজস্ব অনিবার্যতায়।
ফলে একজন গল্পলেখকের হাতে ইতিহাস তার গতিপথ হারাতে পারে, তার সূত্রগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। আবার অন্যদিকে, গল্পের কাঠামোয় ইতিহাসকে স্থাপন করে একজন লেখক ইতিহাসকে অতিরঞ্জন এবং বিকৃতি থেকে রেহাই দিতে পারেন, ইতিহাসের লুকানো সত্যগুলো দিনের আলোয় তুলে আনতে পারেন। গল্পলেখকের শক্তি এবং কল্পনার ওপর নির্ভর করে ইতিহাস তার ওপর আরোপিত শৃঙ্খল ভাঙতে পারে, যে শৃঙ্খল পরাতে পারে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান, অথবা ক্ষমতার রাজনীতি।
আমাদের জীবনকালের যে ইতিহাসে আমরা ছিলাম, তা নিয়ে যখন বিতর্ক সৃষ্টি হয়, নানা বিকৃতির রং তার ওপর চাপানো হয়, তখন একজন ইতিহাসবিদের ভূমিকা নিশ্চয় হওয়া উচিত সত্যসন্ধানীর। যখন সে রকম উদ্যোগ চোখে পড়ে না, অথচ ইতিহাসের সত্যগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়, তখন একজন লেখক নামতে পারেন সেই সত্যসন্ধানীর ভূমিকায়। দেয়াল উপন্যাসে সেই কাজটি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ এবং আমাদের অনেকের স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটে যাওয়া একটি বছরের ঘটনাবহুল কয়েকটি দিনের ইতিহাস একটি গল্পের আবরণে সাজিয়েছেন অপূর্ব নিপুণতায়। এই উপন্যাসে তিনি কোনো ইতিহাসবিদের জায়গা নেননি, যদিও একজন ইতিহাসবিদের নির্মোহ দৃষ্টি, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্যনির্ভরতা তিনি বজায় রেখেছেন। তাঁর দৃষ্টি বরং ইতিহাসের মানবিক অঞ্চলটিতে যেখানে ব্যক্তিমানুষই প্রধান, রাষ্ট্র অথবা কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান নয়। এই মানবিক অঞ্চল থেকে যে সত্য তিনি তুলে আনেন, তাতে একদিকে আছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অহমিকা, শঠতা এবং মানুষের নানাবিধ বিপন্নতা; অন্যদিকে প্রেম-প্রীতি, মানুষের ভালোত্ব এবং অম্লান চিত্তের বিভিন্ন প্রকাশ। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে কিছু উর্দিধারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের অনেকের সঙ্গে ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলে। তারপর দীর্ঘ দেড় যুগ গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়; স্বনামে, বেনামে চলে সামরিক শাসন। ১৯৭৫ সাল নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি নিজেদের মতো গল্প সাজিয়েছে, দীর্ঘদিন দেশের মানুষকে সেসব সাজানো গল্প শোনানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়েছে। ফলে এই ঘটনাটির ট্র্যাজিক দিকটি চাপা পড়ে গেছে রাজনৈতিক বিতর্কে। হুমায়ূন আহমেদ রাজনীতির মানুষ নন। তিনি রাজনৈতিক বিতর্কে যাননি, সাজানো আখ্যানগুলোর অনেক দূরে রেখেছেন নিজের অবস্থান এবং শুধু মানবসত্যের প্রতি অবিচল থেকে ওই বিষণ্ন ইতিহাস থেকে রসদ নিয়ে দেয়াল উপন্যাসটি লিখেছেন। একাত্তর নিয়ে যেমন লিখেছিলেন এক মন ছুঁয়ে যাওয়া উপন্যাস, জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, যা উপন্যাসের কাঠামোয় ইতিহাসের নানা উপাদানকে পরিবর্তন না করে, তাদের ওপর কল্পনার রং না চড়িয়ে উপকৃত করেছিলেন। দেয়াল উপন্যাসেও ইতিহাসের কাছে তেমনি বিশ্বস্ত থেকেছেন। তার পরও দেয়াল কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। একে বড়জোর ইতিহাস-আশ্রিত বলা যেতে পারে। এ উপন্যাসে ইতিহাস প্রধানত এর মানবিকতা-অমানবিকতার দ্বন্দ্বেই প্রকাশিত। পাত্রপাত্রী আছে, ঘটনা-উপঘটনা আছে। কিন্তু বাকিটুকু গল্প।
অথচ এই গল্পটুকু আমাদের যা জানায়, আগস্টের ওই ভয়াবহ রাতের আগের ও পরের ঘটনাপ্রবাহের, তার প্রধান-অপ্রধান চরিত্রদের ঘটনাসম্পাদক ও ক্রীড়নকদের, এর চক্রান্তকারী ও সুবিধাভোগীদের সম্বন্ধে তা এতটা অভিঘাত নিয়ে ইতিহাসও হয়তো পারে না। গল্পলেখক হুমায়ূন আহমেদের সফলতা এবং শক্তি ওই জায়গাতেই।
জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। সে জন্য হয়তো দেয়াল-এর প্রেসকপিটাও আমাকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আমি দেয়াল পড়ে তাঁকে জানালাম, ক্যানসার করাল ব্যাধিটি তাঁকে যে কিছুমাত্র নিঃস্ব করতে পারেনি, পরাজিত হয়েছে বরং, উপন্যাসটি তার প্রমাণ। ১৯৭৫ আমরা ভুলে যেতে বসেছি, অথচ ওই বছরের আগস্টের ঘটনার সঙ্গে জাতি হিসেবে আমাদের নানাবিধ অপূর্ণতা, অমানবিকতা, অকৃতজ্ঞতার বিষয়গুলো জড়িত। একাত্তরের বীর জাতি পঁচাত্তরে এক ভয়ানক কাপুরুষতার জন্ম দিয়েছে। একটি ১০ বছরের শিশুকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে যখন তা নিয়ে গর্ব করা হয়, তখন আয়নার সামনে আর দাঁড়াতে সাহস হয় না। অথচ বাঙালি তো কাপুরুষ নয়, খুনি নয়, বাংলাদেশ অসংখ্য মীর জাফরের ঠিকানা নয়। তাহলে?
দেয়াল আমাদের জানাচ্ছে, পঁচাত্তরে বাঙালি চরিত্রে যে স্খলনগুলো দেখেছি, যে পচন, তা ধ্রুব নয়, চিরস্থায়ী নয়। পঁচাত্তরের অন্ধকারের বিপরীতে আলো আছে, যে আলো আমরা চোখ খুলে একটু তাকালেই দেখত পারি। আমরা আয়নায় চোখ ফেলতে আর ভয় পাই না। খুব সংবেদী বর্ণনায় হুমায়ূন আহমেদ তাঁর চরিত্রগুলো, ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন। তাঁর পাঠকেরা তাঁদের পরিচিত দু-একটি চরিত্র অথবা সেগুলোর আদলে তৈরি কিছু মানুষজন পাবেন এই উপন্যাসে। এর গল্পটি অজটিল, কিন্তু বোধ-অনুভূতিগুলো তীব্র এবং তীক্ষ�, মন আচ্ছন্ন করা অথবা অশান্ত করা। শফিক এই গল্পের কেন্দ্রীয় এক চরিত্র, অনেকটা হিমুর মতো—সত্যবাদী কিন্তু কিছুটা ভীতু। সে যার গৃহশিক্ষক, যার নাম অবন্তী, বয়স ১৬, সে আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাদের ভেতর একটি সম্পর্ক হয়, আবার পুরো যে হয়, তা-ও নয়। এই কাছে আসা-দূরে থাকার ভেতর একটা রহস্য এবং রোমাঞ্চ আছে, যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অটুট থাকে। অবন্তীর সঙ্গে বিয়ে হয় এক গদিনশীন যুবক পিরের, যাকে এক ট্র্যাজিক মানুষ হিসেবে পাঠক ভালোবাসবেন। গল্পে তাঁর নিঃশব্দ আনাগোনা আছে, যাতে অবন্তীর সম্মতি থাকে, অথচ অবন্তীর ওপর স্বামীসুলভ কোনো অধিকার খাটাতে আগ্রহী হয় না এই মানুষটি, যার নাম হাফেজ জাহাঙ্গীর। অবন্তীর বাবা নিরুদ্দেশ, তবে দীর্ঘদিন পর ভেসে ওঠেন স্পেনে, যেখানে অবন্তীর মা ইসাবেলা থাকেন এবং মাঝেমধ্যে মেয়েকে চিঠি লেখেন। অবন্তী থাকে তার দাদা সরফরাজ খানের সঙ্গে, যিনি কঠিন হূদয়ের একজন মানুষ এবং যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল তাহেরের। এই উপন্যাসে শফিক-অবন্তী-হাফেজ জাহাঙ্গীর-সরফরাজ খানের গল্পটাই প্রধান, কিন্তু একে চালিয়ে নিয়ে যায় পঁচাত্তরের নানা ঘটনা। ফলে বঙ্গবন্ধু গল্পের কয়েক জায়গায় আবির্ভূত হন। তাঁকে খুব অন্তরঙ্গ, কিছুটা আমোদপ্রিয় মানুষ হিসেবে আমরা দেখি, অথচ তাঁকে ঘিরে ভয়ানক যে কূটচালগুলো খেলতে থাকে খলনায়কেরা, সেগুলো যখন বর্ণনা করেন ঔপন্যাসিক, আমরা বুঝি বঙ্গবন্ধু মানুষ চিনতে কখনো কখনো ভয়ানক ভুল করেছেন, ট্র্যাজিক নায়কদের মতো, যেমন খন্দকার মোশতাক আহমদকে, খালেদ মোশাররফকে; হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছেন; কর্নেল তাহেরকে পুনরধিষ্ঠিত করেছেন তাঁর বীরের আসনটিতে। এ দুই চরিত্রের এক আশ্চর্য নিরাবেগ চিত্রায়ণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসের দায় থেকেই। এ উপন্যাসে জিয়াউর রহমানও আছেন এবং আছেন তাঁর ভূমিকাতেই। জিয়ার প্রাণ রক্ষাকারী বন্ধু কর্নেল তাহেরকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, দেখা গেল কর্নেল তাহেরের কোনো অভিযোগ নেই কারও বিরুদ্ধে, শুধু অসম্ভব এক স্থিরচিত্ততার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি বীরত্ব এবং দেশপ্রেম কাকে বলে তার এক অসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করে গেলেন।
উপন্যাসটিতে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও আছেন, যেহেতু নিজেও তিনি পঁচাত্তরের ইতিহাসে ছিলেন। এই ইতিহাসকে দেয়ালবন্দী হতে দেখেছেন, ফলে দেয়ালটা ভাঙার একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিহাসের কাছে হয়তো এ তাঁর নিজস্ব দায়মুক্তি।
No comments