অধ্যাপক মোজাফ্ফরকে যেমন দেখেছি by বদিউল আলম মজুমদার
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে চিনি। তখন তিনি অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। আমি এ খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানে ছাত্র। সে সময়ে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েমের তাঁবেদাররা অর্থনীতি বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক আবু মোহামদের ওপর হামলা চালালে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় এবং সবাই ধিক্কার জানাতে থাকেন।
শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় একজন সম্মানিত শিক্ষকের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ ছেড়ে দেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি জীবন-জীবিকার উৎস বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি। যৌবনে তার এই যে প্রতিবাদী রূপ সেটা আমৃত্যু বজায় ছিল।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই ১৯৯১ সালে দীর্ঘ প্রবাস জীবন ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর। হাঙ্গার প্রজেক্টের সহকর্মী মুক্তা, মনোয়ার, মানিক, মডি প্রমুখের প্রচেষ্টায় এ সুযোগ সৃষ্টি হয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের প্রচেষ্টায় তিনি অর্থনীতিবিদ হিসেবে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করেন। বস্তুতই তিনি ছিলেন বড়মাপের একজন অর্থনীতিবিদ। বিশ্বখ্যাত শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় নোবেল লরিয়েট তৈরির কারখানা। সেখানে তিনি মিল্টন ফ্রিডম্যান, বাকার, জনসন প্রমুখ খ্যাতিমান পণ্ডিতের সংস্পর্শে আসেন। অর্থনীতি চর্চার পাশাপাশি তিনি শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়ানো এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিজেকে যুক্ত রাখেন।
তার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ ঘটে যখন আমরা অনেকেই এ উপলব্ধিতে আসি যে যদি রাজনীতি কলুষমুক্ত এবং সরকারি নীতি-কাঠামো দরিদ্রবান্ধব না হয় তাহলে এ দেশের অমিত সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হবে না। এ পরিবর্তন সাধনে সৎ, যোগ্য, জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়ী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ লক্ষ্যে ২০০২ সালে সিটিজেনস ফর ইলেকশন নামের নাগরিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এ সংগঠন ২০০৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় ৫৫টি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়্যারম্যান প্রার্থীদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে তা ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। একই সঙ্গে প্রার্থীরা মুখোমুখি হন ভোটারদের। এ অভিজ্ঞতা ছিল ইতিবাচক। পরে জরিপে দেখা গেছে, এ ধরনের উদ্যোগের কারণে অনেক ভোটার তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন এবং অপেক্ষাকৃত যোগ্যরা নির্বাচিত হয়ে আসেন। এ উদ্যোগের কারণে নির্বাচনী সহিংসতাও প্রায় ঘটেনি। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীদের শিক্ষা, পেশা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান, আয়-ব্যয় ইত্যাদি সর্বসমক্ষে প্রচারের দাবি তুলি এবং তার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা হতে থাকে। একই সঙ্গে উচ্চ আদালত থেকেও এর সপক্ষে মেলে ঐতিহাসিক রায়। এসব কাজের ফলে ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের যাবতীয় তথ্য তুলে ধরা সহজ হয়।
পরবর্তী সময়ে আমরা উপলব্ধি করি যে, শুধু সৎ-যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হলেই চলবে না, পদ্ধতিগত সংস্কারেরও প্রয়োজন রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা চাই। এ জন্য সার্বিক সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়, যার অংশ ছিল নির্বাচনী পদ্ধতি সংস্কার, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, প্রার্থীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য প্রদান ইত্যাদি। এ কাজের জন্য আমাদের নাগরিক সমাজের সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রাখা হয়। এ সংগঠন সারাদেশে ব্যাপক কার্যক্রম ও জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে চলেছে। অনেক বিশিষ্ট নাগরিক এ কাজে যুক্ত হতে থাকেন। প্রথম থেকেই ছিলেন হাফিজুদ্দিন আহমদ খান, এএসএম শাহজাহান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ। তবে সিপাহসালার ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। তার যোগ্য নেতৃত্বে ও উৎসাহে আমরা এ কাজ অব্যাহত রাখতে পারি। এখন সুজন সারাদেশে একটি পরিচিত ও মর্যাদাবান সংগঠনের নাম।
প্রত্যক্ষভাবে তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে তিনি ছিলেন সৎ, নির্ভীক ও আপসহীন ব্যক্তি। অন্যায়ের কাছে কখনও নতজানু হননি। বহুবার রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু নৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসেননি। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণে আমৃত্যু তিনি সোচ্চার ছিলেন। বিবেকের তাড়নায় যা সঠিক মনে করেছেন সেটাই বলেছেন এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। তার মৃত্যু দেশের অপূরণীয় ক্ষতি। তাকে যথার্থভাবেই বলতে পারি জাতির বিবেক ও অভিভাবক। তিনি সরকারি কোনো দায়িত্বে ছিলেন না, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছিলেন। এ শূন্য স্থান সহজে পূরণ হবে না। তিনি পরিবেশ উন্নত করা, শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়ানো, দুর্নীতি নির্মূল করা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সর্বক্ষেত্রে অনুসরণসহ যেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করেছেন তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আসুন সবাই আরও সক্রিয় হই। বিশেষভাবে বলব, যারা তাকে ভালোবেসেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন তারা সবাই এগিয়ে আসুন। এবাবেই তার প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারি।
স ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক
সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই ১৯৯১ সালে দীর্ঘ প্রবাস জীবন ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর। হাঙ্গার প্রজেক্টের সহকর্মী মুক্তা, মনোয়ার, মানিক, মডি প্রমুখের প্রচেষ্টায় এ সুযোগ সৃষ্টি হয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের প্রচেষ্টায় তিনি অর্থনীতিবিদ হিসেবে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করেন। বস্তুতই তিনি ছিলেন বড়মাপের একজন অর্থনীতিবিদ। বিশ্বখ্যাত শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় নোবেল লরিয়েট তৈরির কারখানা। সেখানে তিনি মিল্টন ফ্রিডম্যান, বাকার, জনসন প্রমুখ খ্যাতিমান পণ্ডিতের সংস্পর্শে আসেন। অর্থনীতি চর্চার পাশাপাশি তিনি শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়ানো এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিজেকে যুক্ত রাখেন।
তার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ ঘটে যখন আমরা অনেকেই এ উপলব্ধিতে আসি যে যদি রাজনীতি কলুষমুক্ত এবং সরকারি নীতি-কাঠামো দরিদ্রবান্ধব না হয় তাহলে এ দেশের অমিত সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হবে না। এ পরিবর্তন সাধনে সৎ, যোগ্য, জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়ী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ লক্ষ্যে ২০০২ সালে সিটিজেনস ফর ইলেকশন নামের নাগরিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এ সংগঠন ২০০৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় ৫৫টি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়্যারম্যান প্রার্থীদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে তা ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। একই সঙ্গে প্রার্থীরা মুখোমুখি হন ভোটারদের। এ অভিজ্ঞতা ছিল ইতিবাচক। পরে জরিপে দেখা গেছে, এ ধরনের উদ্যোগের কারণে অনেক ভোটার তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন এবং অপেক্ষাকৃত যোগ্যরা নির্বাচিত হয়ে আসেন। এ উদ্যোগের কারণে নির্বাচনী সহিংসতাও প্রায় ঘটেনি। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীদের শিক্ষা, পেশা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান, আয়-ব্যয় ইত্যাদি সর্বসমক্ষে প্রচারের দাবি তুলি এবং তার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা হতে থাকে। একই সঙ্গে উচ্চ আদালত থেকেও এর সপক্ষে মেলে ঐতিহাসিক রায়। এসব কাজের ফলে ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের যাবতীয় তথ্য তুলে ধরা সহজ হয়।
পরবর্তী সময়ে আমরা উপলব্ধি করি যে, শুধু সৎ-যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হলেই চলবে না, পদ্ধতিগত সংস্কারেরও প্রয়োজন রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা চাই। এ জন্য সার্বিক সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়, যার অংশ ছিল নির্বাচনী পদ্ধতি সংস্কার, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, প্রার্থীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য প্রদান ইত্যাদি। এ কাজের জন্য আমাদের নাগরিক সমাজের সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রাখা হয়। এ সংগঠন সারাদেশে ব্যাপক কার্যক্রম ও জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে চলেছে। অনেক বিশিষ্ট নাগরিক এ কাজে যুক্ত হতে থাকেন। প্রথম থেকেই ছিলেন হাফিজুদ্দিন আহমদ খান, এএসএম শাহজাহান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ। তবে সিপাহসালার ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। তার যোগ্য নেতৃত্বে ও উৎসাহে আমরা এ কাজ অব্যাহত রাখতে পারি। এখন সুজন সারাদেশে একটি পরিচিত ও মর্যাদাবান সংগঠনের নাম।
প্রত্যক্ষভাবে তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে তিনি ছিলেন সৎ, নির্ভীক ও আপসহীন ব্যক্তি। অন্যায়ের কাছে কখনও নতজানু হননি। বহুবার রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু নৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসেননি। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণে আমৃত্যু তিনি সোচ্চার ছিলেন। বিবেকের তাড়নায় যা সঠিক মনে করেছেন সেটাই বলেছেন এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। তার মৃত্যু দেশের অপূরণীয় ক্ষতি। তাকে যথার্থভাবেই বলতে পারি জাতির বিবেক ও অভিভাবক। তিনি সরকারি কোনো দায়িত্বে ছিলেন না, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছিলেন। এ শূন্য স্থান সহজে পূরণ হবে না। তিনি পরিবেশ উন্নত করা, শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়ানো, দুর্নীতি নির্মূল করা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সর্বক্ষেত্রে অনুসরণসহ যেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করেছেন তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আসুন সবাই আরও সক্রিয় হই। বিশেষভাবে বলব, যারা তাকে ভালোবেসেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন তারা সবাই এগিয়ে আসুন। এবাবেই তার প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারি।
স ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক
সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
No comments