খেরোখাতায় জীবন by মোজাফ্ফর আহমদ
১. আমার জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৭ মার্চ কলকাতায়। পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে আমি মেজ। বাবা বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে শিল্প মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করলেও আমাদের একটা বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জে। ব্রিটিশ আমলের শুরুতে বাবার দাদা সেটা করেছিলেন। কলকাতায় কিছুদিন থাকার পর আমরা শ্রীরামপুর, বনগাঁ এবং তারপর মাগুরায় আসি।
২. বনগাঁয় আমাদের বাড়িটা খোলামেলা ছিল। তখন আমার বয়স বছর দুয়েক হবে। একজন আরদালি ছিল। পার্কে বেড়াতে নিয়ে যেত। আমাদের বাড়িটা কলকাতার কাছাকাছি থাকায় কলেজপড়ূয়া চাচারা প্রায় বেড়াতে আসতেন।
৩. বনগাঁ থেকে আমরা মাগুরা আসি। মাগুরায়ও চাচারা বেড়াতে আসতেন। আমরা তখন তিন ভাই। তিন ভাই মিলে ট্রাই সাইকেলে চড়ে বারান্দায় রেস করতাম। তখন বাবাকে অনেক সময় মফস্বলে যেতে হতো। বাবা সাইকেল চালিয়ে যেতেন সব জায়গায়। বৃষ্টির দিনে গরুর গাড়িতে যেতে গিয়ে একবার অ্যাকসিডেন্ট করলেন বাবা। ডাক্তার বললেন, বাবার বেরিবেরি রোগ হয়েছে। ছুটিতে যেতে বললেন। এরপর আমরা ছুটিতে রাচিতে যাই। রাচিতে আমরা থাকতাম চৌচালা বাড়িতে। সামনে-পেছনে বারান্দা ছিল। সেখানে খেলাধুলাটাই মুখ্য ছিল। আমরা রাচিতে মাস ছয়েক ছিলাম।
৪. কলকাতা থেকে বাবার পোস্টিং হলো গোপালগঞ্জ। এ শহরে একটা নদী ছিল। সেখানে স্টিমার আসত। আমরা নদীর পাড়ে বেড়াতে যেতাম। ওখানে থাকতে একটা মজার ঘটনা হয়। এক রাতে বাসায় চোর আসে। মা টের পেয়ে চোর চোর বলে চেঁচালেন। চোর দেয়ালের ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে পালাল। ওর পায়ের ছাপটা ভেজা মাটিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। পুলিশ এসে দেখল বাবার অফিসের পাংখা পুলারের সঙ্গে তার পায়ের ছাপ মিলে গেছে। পুলিশ তাকে ধরতে চাইল; কিন্তু বাবা ছেড়ে দিতে বললেন।
৫. মা হলেন সব শিশুরই নিরাপদ আশ্রয়, ভরসা স্থল। আমার মার বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে, বিশ বছর না হতেই তিন ছেলের মা হয়েছিলেন। মার কাছে শুনেছি বিভিন্ন ছড়া, অনেক রকম গান। মা গল্পও শোনাতেন। কোরানের গল্প, নানা মহামতিদের জীবনের কথা, ঠাকুরমার ঝুলি এসব ছিল তার ভাণ্ডারে। আমরা শুয়ে-বসে সেসব শুনতাম। মা অনেক রকম সেলাই জানতেন। উলের কাঁটায় দ্রুত সোয়েটার বুনতেন, কুরুশ কাঁটায় বানাতেন সেলফের ঢাকনি, টেবিল ক্লথ, কাপড় কেটে ব্লাউজ পেটিকোট, ফ্রক, জামা সেলাই করতেন। শেখাতেনও পাড়া-পড়শির মেয়েদের। পড়তে ভালোবাসতেন। পড়তেন নানা গল্প, নভেল। শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবিঠাকুর_ তারা সবাই ছিলেন প্রিয় লেখক। রান্না করতেন ভালো। নানা রকম আচার বানাতেন, মোরব্বা বানাতেন, মিষ্টি বানাতেন। তবে তার বিশেষ রান্না ছিল খাস্তা-পরোটা, মোরগ মোসাল্লাম, দুদের ক্ষীর। ছানা কাটতেন ছানার পানিতে রসগোল্লা, পানতোয়া এসব আমাদের জিভে পানি আনত। ছিলেন মমতাময়ী। আমাদের তো বটেই, নিজের ছোট ভাইবোনদের মাতৃস্নেহে পালন করেছেন। গৃহকর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে ছিল বিশেষ দৃষ্টি। তাদেরও মা হয়ে উঠতেন।
৬. গোপালগঞ্জ থেকে বাবা বদলি হয়ে আসেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ১৯৩৯ সালে। ছিলাম ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। মঠবাড়িয়ায় এক ভদ্রলোকের নাম ছিল অমূল্য ভূষণ সমদ্দার। তিনি অঙ্কে পারদর্শী ছিলেন। তিনি এসে একদিন আমাদের বাইরের ঘরে থাকতে চাইলেন। বাবা রাজি হলেন। তিনিই আমাদের অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি শিখাতেন। সাঁতারও আমরা তার কাছেই শিখেছিলাম। মঠবাড়িয়া সুন্দরবনের খুব কাছাকাছি থাকায় এখানে সাপের খুব উপদ্রব ছিল। একদিন রাতে আমাদের রাজহাঁসগুলোকে সাপে কেটেছিল। ওখানে থাকতে আরেক ঘটনা ঘটে। বাবা ওখানে হাকিম ছিলেন। একদিন এক লোকের জমি মামলার নিষ্পত্তি হয়। বিচারে বাবা দরিদ্র কৃষকের পক্ষেই রায় দেন। সন্ধ্যাবেলায় বাবা অফিস থেকে এসে দেখেন একটি লোক ঘটি হাতে নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? লোকটি বলল, ১০ বছর ধরে আমার জমি দখল করে রেখেছিল। আপনার কাছে এতদিন পর সুবিচার পেয়েছি। আমার তো কিছু নেই। একটা গরু আছে, তার দুধ নিয়ে এসেছি। বাবার ভয়াবহ রিঅ্যাকশন হলো। তিনি লাথি মেরে ঘটিটা ফেলে দিলেন। কারণ সরকারি অফিসারদের উপহার নেওয়ার উপায় ছিল না। লোকটি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাল। বাবা পিওন ডেকে ঘটিটা ফেরত দিলেন। সঙ্গে চার আনা পয়সা দিয়ে দিলেন।
এখানে স্কুলে ভর্তি হলাম। ওটা ছিল খাস মহলের স্কুল। স্কুলের জমিতে ধান চাষ হতো। ধান বিক্রির টাকা দিয়ে স্কুলের খরচ চলত। ওখানে শীতের সবজি করার জন্য প্লট ছিল। আমি ছাত্রদের সঙ্গে মিলে ওখানে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি গাছ লাগিয়েছিলাম। নিয়ম ছিল যারা লাগাবে তারা এক-তৃতীয়াংশ পাবে, এক-তৃতীয়াংশ হোস্টেলে যাবে আর এক-তৃতীয়াংশ বিক্রি করে স্কুল টাকা নেবে। আরেকটা নিয়ম ছিল, যারা সবচেয়ে ভালো প্লট করবে তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে। একবার আমার বড় ভাই এই প্রাইজ পেয়েছিলেন। আমরা তিন ভাই মিলে সবকিছু করতাম। মঠবাড়িয়ায় থাকতেই আমি লেখালেখি শুরু করি। কবিতা লিখতাম। মায়ের কাছে পত্রিকা আসত। স্কুলে সবুজপত্র ম্যাগাজিন আসত। সেগুলো দেখে যতটা বুঝতাম পড়তাম। এ ছাড়া ওই সময়ের অন্যতম আকর্ষণ ছিল পোস্ট অফিস। ডাকে চিঠি, কলকাতার পত্রিকা আসত। সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। মামার কাছে লাইফ ও টাইম ম্যাগাজিন থাকত। সেখানে যুদ্ধের সব ছবি, স্টালিন, চার্চিল, হিটলার, তোজোর ছবি দেখেছিলাম।
তেতালি্লশের মন্বন্তরের সময় সরকারের নির্দেশ ছিল কারও বাড়িতে বেশি চাল থাকতে পারবে না। সেসময় ওখানকার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে অনেক চাল ছিল। বাবা জেনে তাকে চাল দিয়ে দিতে বললেন। পরদিন তার বাড়িতে নিরন্নরা চাল আনতে গেলে তিনি অস্বীকার করলে বাবা পুলিশ পাঠিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এলেন। তারপর অফিসের সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখলেন। তারপর চাল ফেরত দিতে বললেন। ভদ্রলোক আধঘণ্টা পর চাল দিয়ে দিলেন। এরপর কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বাবার বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচার দেওয়া হলো। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবার পক্ষেই কথা বললেন। এরপর বাবা না চাইতেই বাবার জন্য রাম সিং নামে একজন ববিগার্ড বরাদ্দ হলো। রাম সিং বন্দুক হাতে বাবার পেছনে ঘুরত। বাবা একদিন রাম সিংকে ডাকতে পাঠালেন। আমি ওর ঘরে ঢুকতেই সে তার ঘরের সব রান্না ফেলে দিল। আমি মুসলমান আর সে ব্রাহ্মণ হওয়ায় এই কাণ্ড করেছিল। এটা আমার কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। কারণ সাম্প্রদায়িকতার এমন বহিঃপ্রকাশ আগে দেখিনি।
ছেলেবেলায় আমি খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলাম। মনে হতো বড় বলে বড় ভাই বেশি মনোযোগ পায় আর রোগা বলে আমার ছোট ভাই বেশি আদর পায়। আমি অতটা মনোযোগ পাই না। ছেলেবেলায় আমি মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলাম। আমি ড্রইং পারতাম না। ক্লাস ফোরে যে সেকেন্ড হয়েছিল তার থেকে আমি একশো নম্বর বেশি পেয়েছিলাম। কিন্তু ড্রইংয়ে পাস না করার কারণে আমাকে ফার্স্ট করা হয়নি। তাতে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। ১৯৪৬ সালে ক্লাস সেভেনে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে আমার ভালো বন্ধু ছিল আনিসউদ্দোলা। এ ছাড়া ছিল অলোক ও দীপক। তারা দু'জনেই ওপার বাংলায় চলে যায়। ওখানকার রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে সাহিত্য প্রতিযোগিতা, নাটক হতো। ১৯৪৭ সালে আমরা নোয়াখালী আসি। নদীর ভাঙন যে কতটা তীব্র হয় তা নোয়াখালীতে থাকা অবস্থায় মেঘনা নদীর ভাঙন দেখে বুঝলাম। নোয়াখালী থাকতে স্কুলে নিজে নাটক লিখে নিজে পরিচালনা করতাম, আবৃত্তিসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতাম। '৪৮-এর ভাষা আন্দোলন এখানে থাকা অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছি। বড় ভাইয়ের বন্ধু সাখাওয়াত হোসেন, আমিনুল হক তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। বিকেলে তাদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন, ভলিবল খেলতাম। এরপর ১৯৫০ সালে বরিশালে আসি। এখান থেকেই আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেই। এখানকার মুকুল ফৌজ বেশ স্মরণীয় হয়ে আছে। সাঈদ ভাই, সিরাজ ভাই তাদের সঙ্গে প্যারেড করতাম, গান করতাম। এখানে থাকতেই হাতের লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করলাম। এখানে থাকতেই একবার হাবিবুল্লাহ বাহার সাহেব এসেছিলেন। তার সঙ্গে ঢাকা থেকে আরও অনেকে আসেন। তারা গান, কৌতুক, অভিনয় করেছিলেন। অশ্বিনী কুমার হলে বেশ কয়েকদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। ১৯৫০ সালে একবার এখানে দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গা বেশ ভয়াবহ ছিল। কংগ্রেস নেতা সত্যেন সেনকে হত্যার প্রচেষ্টা ছিল। তৎকালীন প্রগতিশীল মানুষের চেষ্টায় সেটা আর সম্ভব হয়নি।
ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত মঠবাড়িয়ার এমদাদুল হকের সঙ্গে এখন মাঝে মধ্যে দেখা হয়। ফরিদপুর জেলা স্কুলের আনিসুদ্দৌলা বিরাট শিল্পপতি। এ ছাড়া ফরিদপুরের জেলা স্কুলের আরেক ছাত্র আবদুল্লাহ হোসেন রব্বানী যে পরবর্তীকালে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিল, তার সঙ্গে বেশ যোগাযোগ ছিল। নোয়াখালী জেলা স্কুলের আবদুল হালিমের সঙ্গে চট্টগ্রাম গেলে দেখা হয়।
বয়স বেড়ে গেলে স্মৃতিটা অনেক মধুর বলে মনে হয়। তখনকার মানুষের ভেতর যে হৃদ্যতা ছিল এখন তার বেশ অভাব রয়েছে।
স সমকাল 'ঈদ আনন্দ' ১৪ নভেম্বর ২০১০ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে পুনর্মুদ্রিত
৩. বনগাঁ থেকে আমরা মাগুরা আসি। মাগুরায়ও চাচারা বেড়াতে আসতেন। আমরা তখন তিন ভাই। তিন ভাই মিলে ট্রাই সাইকেলে চড়ে বারান্দায় রেস করতাম। তখন বাবাকে অনেক সময় মফস্বলে যেতে হতো। বাবা সাইকেল চালিয়ে যেতেন সব জায়গায়। বৃষ্টির দিনে গরুর গাড়িতে যেতে গিয়ে একবার অ্যাকসিডেন্ট করলেন বাবা। ডাক্তার বললেন, বাবার বেরিবেরি রোগ হয়েছে। ছুটিতে যেতে বললেন। এরপর আমরা ছুটিতে রাচিতে যাই। রাচিতে আমরা থাকতাম চৌচালা বাড়িতে। সামনে-পেছনে বারান্দা ছিল। সেখানে খেলাধুলাটাই মুখ্য ছিল। আমরা রাচিতে মাস ছয়েক ছিলাম।
৪. কলকাতা থেকে বাবার পোস্টিং হলো গোপালগঞ্জ। এ শহরে একটা নদী ছিল। সেখানে স্টিমার আসত। আমরা নদীর পাড়ে বেড়াতে যেতাম। ওখানে থাকতে একটা মজার ঘটনা হয়। এক রাতে বাসায় চোর আসে। মা টের পেয়ে চোর চোর বলে চেঁচালেন। চোর দেয়ালের ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে পালাল। ওর পায়ের ছাপটা ভেজা মাটিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। পুলিশ এসে দেখল বাবার অফিসের পাংখা পুলারের সঙ্গে তার পায়ের ছাপ মিলে গেছে। পুলিশ তাকে ধরতে চাইল; কিন্তু বাবা ছেড়ে দিতে বললেন।
৫. মা হলেন সব শিশুরই নিরাপদ আশ্রয়, ভরসা স্থল। আমার মার বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে, বিশ বছর না হতেই তিন ছেলের মা হয়েছিলেন। মার কাছে শুনেছি বিভিন্ন ছড়া, অনেক রকম গান। মা গল্পও শোনাতেন। কোরানের গল্প, নানা মহামতিদের জীবনের কথা, ঠাকুরমার ঝুলি এসব ছিল তার ভাণ্ডারে। আমরা শুয়ে-বসে সেসব শুনতাম। মা অনেক রকম সেলাই জানতেন। উলের কাঁটায় দ্রুত সোয়েটার বুনতেন, কুরুশ কাঁটায় বানাতেন সেলফের ঢাকনি, টেবিল ক্লথ, কাপড় কেটে ব্লাউজ পেটিকোট, ফ্রক, জামা সেলাই করতেন। শেখাতেনও পাড়া-পড়শির মেয়েদের। পড়তে ভালোবাসতেন। পড়তেন নানা গল্প, নভেল। শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবিঠাকুর_ তারা সবাই ছিলেন প্রিয় লেখক। রান্না করতেন ভালো। নানা রকম আচার বানাতেন, মোরব্বা বানাতেন, মিষ্টি বানাতেন। তবে তার বিশেষ রান্না ছিল খাস্তা-পরোটা, মোরগ মোসাল্লাম, দুদের ক্ষীর। ছানা কাটতেন ছানার পানিতে রসগোল্লা, পানতোয়া এসব আমাদের জিভে পানি আনত। ছিলেন মমতাময়ী। আমাদের তো বটেই, নিজের ছোট ভাইবোনদের মাতৃস্নেহে পালন করেছেন। গৃহকর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে ছিল বিশেষ দৃষ্টি। তাদেরও মা হয়ে উঠতেন।
৬. গোপালগঞ্জ থেকে বাবা বদলি হয়ে আসেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ১৯৩৯ সালে। ছিলাম ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। মঠবাড়িয়ায় এক ভদ্রলোকের নাম ছিল অমূল্য ভূষণ সমদ্দার। তিনি অঙ্কে পারদর্শী ছিলেন। তিনি এসে একদিন আমাদের বাইরের ঘরে থাকতে চাইলেন। বাবা রাজি হলেন। তিনিই আমাদের অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি শিখাতেন। সাঁতারও আমরা তার কাছেই শিখেছিলাম। মঠবাড়িয়া সুন্দরবনের খুব কাছাকাছি থাকায় এখানে সাপের খুব উপদ্রব ছিল। একদিন রাতে আমাদের রাজহাঁসগুলোকে সাপে কেটেছিল। ওখানে থাকতে আরেক ঘটনা ঘটে। বাবা ওখানে হাকিম ছিলেন। একদিন এক লোকের জমি মামলার নিষ্পত্তি হয়। বিচারে বাবা দরিদ্র কৃষকের পক্ষেই রায় দেন। সন্ধ্যাবেলায় বাবা অফিস থেকে এসে দেখেন একটি লোক ঘটি হাতে নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? লোকটি বলল, ১০ বছর ধরে আমার জমি দখল করে রেখেছিল। আপনার কাছে এতদিন পর সুবিচার পেয়েছি। আমার তো কিছু নেই। একটা গরু আছে, তার দুধ নিয়ে এসেছি। বাবার ভয়াবহ রিঅ্যাকশন হলো। তিনি লাথি মেরে ঘটিটা ফেলে দিলেন। কারণ সরকারি অফিসারদের উপহার নেওয়ার উপায় ছিল না। লোকটি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাল। বাবা পিওন ডেকে ঘটিটা ফেরত দিলেন। সঙ্গে চার আনা পয়সা দিয়ে দিলেন।
এখানে স্কুলে ভর্তি হলাম। ওটা ছিল খাস মহলের স্কুল। স্কুলের জমিতে ধান চাষ হতো। ধান বিক্রির টাকা দিয়ে স্কুলের খরচ চলত। ওখানে শীতের সবজি করার জন্য প্লট ছিল। আমি ছাত্রদের সঙ্গে মিলে ওখানে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি গাছ লাগিয়েছিলাম। নিয়ম ছিল যারা লাগাবে তারা এক-তৃতীয়াংশ পাবে, এক-তৃতীয়াংশ হোস্টেলে যাবে আর এক-তৃতীয়াংশ বিক্রি করে স্কুল টাকা নেবে। আরেকটা নিয়ম ছিল, যারা সবচেয়ে ভালো প্লট করবে তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে। একবার আমার বড় ভাই এই প্রাইজ পেয়েছিলেন। আমরা তিন ভাই মিলে সবকিছু করতাম। মঠবাড়িয়ায় থাকতেই আমি লেখালেখি শুরু করি। কবিতা লিখতাম। মায়ের কাছে পত্রিকা আসত। স্কুলে সবুজপত্র ম্যাগাজিন আসত। সেগুলো দেখে যতটা বুঝতাম পড়তাম। এ ছাড়া ওই সময়ের অন্যতম আকর্ষণ ছিল পোস্ট অফিস। ডাকে চিঠি, কলকাতার পত্রিকা আসত। সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। মামার কাছে লাইফ ও টাইম ম্যাগাজিন থাকত। সেখানে যুদ্ধের সব ছবি, স্টালিন, চার্চিল, হিটলার, তোজোর ছবি দেখেছিলাম।
তেতালি্লশের মন্বন্তরের সময় সরকারের নির্দেশ ছিল কারও বাড়িতে বেশি চাল থাকতে পারবে না। সেসময় ওখানকার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে অনেক চাল ছিল। বাবা জেনে তাকে চাল দিয়ে দিতে বললেন। পরদিন তার বাড়িতে নিরন্নরা চাল আনতে গেলে তিনি অস্বীকার করলে বাবা পুলিশ পাঠিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এলেন। তারপর অফিসের সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখলেন। তারপর চাল ফেরত দিতে বললেন। ভদ্রলোক আধঘণ্টা পর চাল দিয়ে দিলেন। এরপর কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বাবার বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচার দেওয়া হলো। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবার পক্ষেই কথা বললেন। এরপর বাবা না চাইতেই বাবার জন্য রাম সিং নামে একজন ববিগার্ড বরাদ্দ হলো। রাম সিং বন্দুক হাতে বাবার পেছনে ঘুরত। বাবা একদিন রাম সিংকে ডাকতে পাঠালেন। আমি ওর ঘরে ঢুকতেই সে তার ঘরের সব রান্না ফেলে দিল। আমি মুসলমান আর সে ব্রাহ্মণ হওয়ায় এই কাণ্ড করেছিল। এটা আমার কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। কারণ সাম্প্রদায়িকতার এমন বহিঃপ্রকাশ আগে দেখিনি।
ছেলেবেলায় আমি খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলাম। মনে হতো বড় বলে বড় ভাই বেশি মনোযোগ পায় আর রোগা বলে আমার ছোট ভাই বেশি আদর পায়। আমি অতটা মনোযোগ পাই না। ছেলেবেলায় আমি মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলাম। আমি ড্রইং পারতাম না। ক্লাস ফোরে যে সেকেন্ড হয়েছিল তার থেকে আমি একশো নম্বর বেশি পেয়েছিলাম। কিন্তু ড্রইংয়ে পাস না করার কারণে আমাকে ফার্স্ট করা হয়নি। তাতে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। ১৯৪৬ সালে ক্লাস সেভেনে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে আমার ভালো বন্ধু ছিল আনিসউদ্দোলা। এ ছাড়া ছিল অলোক ও দীপক। তারা দু'জনেই ওপার বাংলায় চলে যায়। ওখানকার রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে সাহিত্য প্রতিযোগিতা, নাটক হতো। ১৯৪৭ সালে আমরা নোয়াখালী আসি। নদীর ভাঙন যে কতটা তীব্র হয় তা নোয়াখালীতে থাকা অবস্থায় মেঘনা নদীর ভাঙন দেখে বুঝলাম। নোয়াখালী থাকতে স্কুলে নিজে নাটক লিখে নিজে পরিচালনা করতাম, আবৃত্তিসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতাম। '৪৮-এর ভাষা আন্দোলন এখানে থাকা অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছি। বড় ভাইয়ের বন্ধু সাখাওয়াত হোসেন, আমিনুল হক তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। বিকেলে তাদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন, ভলিবল খেলতাম। এরপর ১৯৫০ সালে বরিশালে আসি। এখান থেকেই আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেই। এখানকার মুকুল ফৌজ বেশ স্মরণীয় হয়ে আছে। সাঈদ ভাই, সিরাজ ভাই তাদের সঙ্গে প্যারেড করতাম, গান করতাম। এখানে থাকতেই হাতের লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করলাম। এখানে থাকতেই একবার হাবিবুল্লাহ বাহার সাহেব এসেছিলেন। তার সঙ্গে ঢাকা থেকে আরও অনেকে আসেন। তারা গান, কৌতুক, অভিনয় করেছিলেন। অশ্বিনী কুমার হলে বেশ কয়েকদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। ১৯৫০ সালে একবার এখানে দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গা বেশ ভয়াবহ ছিল। কংগ্রেস নেতা সত্যেন সেনকে হত্যার প্রচেষ্টা ছিল। তৎকালীন প্রগতিশীল মানুষের চেষ্টায় সেটা আর সম্ভব হয়নি।
ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত মঠবাড়িয়ার এমদাদুল হকের সঙ্গে এখন মাঝে মধ্যে দেখা হয়। ফরিদপুর জেলা স্কুলের আনিসুদ্দৌলা বিরাট শিল্পপতি। এ ছাড়া ফরিদপুরের জেলা স্কুলের আরেক ছাত্র আবদুল্লাহ হোসেন রব্বানী যে পরবর্তীকালে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিল, তার সঙ্গে বেশ যোগাযোগ ছিল। নোয়াখালী জেলা স্কুলের আবদুল হালিমের সঙ্গে চট্টগ্রাম গেলে দেখা হয়।
বয়স বেড়ে গেলে স্মৃতিটা অনেক মধুর বলে মনে হয়। তখনকার মানুষের ভেতর যে হৃদ্যতা ছিল এখন তার বেশ অভাব রয়েছে।
স সমকাল 'ঈদ আনন্দ' ১৪ নভেম্বর ২০১০ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে পুনর্মুদ্রিত
No comments