যুদ্ধাপরাধ-পাকিস্তানবাদের ফেরিওয়ালারা by সোহরাব হাসান

এবার তাঁরা মূল ধরে টান দিয়েছেন। এত দিন বলতেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বলে কিছু নেই। এখন বলছেন, মুক্তিযুদ্ধই হয়নি। তাহলে একাত্তরে কী হয়েছে? গৃহযুদ্ধ? গন্ডগোল? ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য? ৩৯ বছর পর তা নিয়ে হইচই করার কিছু নেই।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী সে ধরনেরই ফরমান জারি করেছেন। গত শুক্রবার বিয়াম ভবনে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের প্রথম কাউন্সিলে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘একাত্তরে যা হয়েছে তা ছিল গৃহযুদ্ধ বা সিভিল ওয়ার। আর সিভিল ওয়ারে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই থাকে।’ (১৫ মে, ২০১০, ডেইলি স্টার)।
এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউসুফ শুধু মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করেননি, মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদকেও অপমান করেছেন। যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, জাতির কাছে তাঁরা পরম শ্রদ্ধেয়। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন বলেই তাঁরা শহীদ। মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে পারলে তাঁরা আর শহীদ থাকেন না; শহীদ না থাকলে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধও থাকে না। ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মানও জানাতে হয় না।
কী ভয়ংকর যুক্তি!
ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হয়, লাঠালাঠি হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হয় না। যেসব কথা এত দিন খোদ পাকিস্তানিরা বলতে সাহস পায়নি, সেসব কথাই সদম্ভে উচ্চারণ করছেন তাদের এ দেশীয় দোসর তথা পাকিস্তানবাদের ফেরিওয়ালারা।
অধ্যাপক ইউসুফ এখানেই ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এ বিচার তো অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে আবার কিসের বিচার?’ একই সঙ্গে তিনি আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, ‘স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যারা লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, ঘরবাড়ি লুট করেছে, তাদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আমাদের সরকার যখন ক্ষমতায় আসবে তখন তাদের আমরা বিচার করব।’ (১৫ মে, ডেইলি স্টার)।
এসব বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হলো: এক. একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, হয়েছে গৃহযুদ্ধ। দুই. যুদ্ধাপরাধের বিচার করা যাবে না। তিন. স্বাধীনতা-পরবর্তী অপরাধের বিচার করতে হবে এবং সে কাজটি করবে ‘তাদের’ সরকার ক্ষমতায় এসে। আমরা জানি, দেশে একটিই আইনানুগ সরকার থাকে। কারও পছন্দ হোক বা না হোক, ক্ষমতার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত সেই সরকারকে সব নাগরিক বৈধ সরকার হিসেবে মানে। এখানে ‘আমাদের’ বা ‘অন্যদের’ সরকার গঠনের সুযোগ নেই। একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহ ছাড়া কিছু নয়। সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়, সেটাই দেখতে চাই।
আমরা যত দূর জানি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি এখনো আদালত গঠন, তদন্তকারী ও আইনজীবী প্যানেল নিয়োগের মধ্যে সীমিত। কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, তদন্তকাজও ভালোভাবে শুরু হয়নি। এর আগেই একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেছেন। কেন? তাঁদের মনে কি ভীষণ ভয় ঢুকে গেছে? তাঁরা কি শাস্তির আতঙ্কে আছেন? একাত্তরের ‘গৃহযুদ্ধে’ কি তাঁরা পাকিস্তানি ভাইদের পক্ষ নিয়েছিলেন?
এই শিক্ষক সমাবেশে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা এখনো নিজেদের পাকিস্তানি ব্রাদারহুডের শরিক বলে মনে করেন। তাঁরা বাংলাদেশে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের উত্থানে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রগকাটা, হাতকাটার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন। খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে হিজবুত তাহরীরের তত্ত্ব প্রচার করছেন।
অধ্যাপক ইউসুফ স্বাধীনতা-পরবর্তী হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের বিচার চেয়েছেন। ভালো কথা। যেকোনো সময়ের যেকোনো অপরাধের বিচার চাওয়া প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী অপরাধ মেলানো কেন? এত দিন তাঁরা নিশ্চুপ ছিলেন কেন?
যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রস্তুতি চলছে তখন স্বাধীনতা-পরবর্তী অপরাধের কথা বলে গৃহযুদ্ধওয়ালারা কি সরকারের প্রতি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন? ‘জিম্মি’ করতে চাইছেন? সাধারণত মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে সন্ত্রাসীরা কাউকে জিম্মি করে থাকে। অপহূত ব্যক্তি তাদের লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র। তাদের লক্ষ্য হলো মুক্তিপণ আদায় করা। গৃহযুদ্ধওয়ালারা কি স্বাধীনতা-পরবর্তী অপরাধকে ‘মুক্তিপণ’ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন? তাঁদের মনোভাবটা হলো, ‘তোমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করলে আমরাও ছাড় দেব। তোমরা বিচার করলে আমরাও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের অপরাধের বিচার করে এক হাত দেখিয়ে দেব।’ বিচার কখনো দরকষাকষির বিষয় হতে পারে না। প্রশ্ন হলো, সরকার কতটা গুরুত্বের সঙ্গে তাঁদের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তরিক হলে তাঁদের হুমকি-ধমকিতে এতটুকু পিছপা হবে না।
অবাক লাগে। গৃহযুদ্ধওয়ালারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন যে আস্ফাালন করে যাচ্ছে সে সম্পর্কে কেউ টু শব্দ করছে না। দেশে নাকি এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। সরকারি অফিস, রাস্তাঘাট, শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বত্র তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার নামে বহু সংগঠনের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়। তাঁরা কি আখের গোছাতেই ব্যস্ত? মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নামের সংগঠনটিই বা কী করছে?
অধ্যাপক ইউসুফ আলী রসায়নের শিক্ষক। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে যদি বিশেষজ্ঞ না হয়েও থাকেন শিক্ষক পরিষদে মহাজ্ঞানী বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আছেন। তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের পার্থক্যটি জেনে নিতে পারেন। গৃহযুদ্ধ হয় একই দেশের মধ্যে বিবদমান দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি ছিল দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এ দেশের আক্রান্ত ও মুক্তিকামী জনমানুষের বাঁচা-মরার লড়াই। ২৫ মার্চ রাতেই এ ভূখণ্ডে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছিল। একে অস্বীকার করার অর্থ বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দখলদার পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছি; কিন্তু তাদের প্রেতাত্মা বা পাকিস্তানবাদের ফেরিওয়ালারা বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে। বিপদে পড়লে এরা গর্তে লুকায়, আর সুযোগ পেলেই ছোবল মারে। কথিত শিক্ষকনেতারা হয়তো সেদিন প্রাথমিক মহড়া দিলেন। ফাইনাল খেলাটা কবে খেলবেন এং কীভাবে খেলবেন সেটাই দেখার বিষয়।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।

sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.