দেশ ভাবনা-দুই পক্ষই সাধারণ মানুষকে জিম্মি ভাবছে? by আলী রীয়াজ
দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সবাই যে উদ্বিগ্ন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে, ব্লগে, ফেসবুকে এবং অন্যত্র যাঁরা মন্তব্য করছেন, তাঁদের অনেকে আশু সমাধানের পথ খুঁজছেন। যদিও তাঁরা এ-ও জানেন যে আশু, সাময়িক সমাধান দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে না।
কেননা, সংকটের চেহারাটা সাময়িক মনে হলেও এর কারণ সাময়িক নয়। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের কম সময়ের মধ্যে এ ধরনের একটা সংকট তৈরি হয়, তারপর সাময়িকভাবে একধরনের স্থিতিশীলতা এলেও সংকটটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে খুব দ্রুত। ২০০৬ সালে রাজনীতিবিদদের তৈরি সংকটের মাশুল অনেকভাবেই দিতে হয়েছে। ২০০৮ সালের সমাধান বেশি দিন টেকেনি, কেননা তা টেকার কোনো কারণ ছিল না।
যে কেউ লক্ষ করলে দেখবেন, গত কয়েক সপ্তাহে, বলতে পারেন গত কয়েক মাসে, একটার পর একটা ঘটনা ঘটে চলেছে। একটা ঘটনা আরেকটাকে চাপা দিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। পরিস্থিতি নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা করছে। এর যত না বিরোধী দল সৃষ্টি করছে, তার চেয়ে বেশি সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের অস্থিরতা ও সরকারি কার্যক্রমের ফসল। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে বিরোধী পক্ষ এই সুযোগ নিতে পিছপা হচ্ছে বা তারা একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা। সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যে যে অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা যেকোনো দিনের পত্রিকা পড়লেই বোঝা যায়। প্রতিদিনই তারা নতুন প্রতিপক্ষ আবিষ্কার করছে। তৈরি করছে বললেও খুব ভুল হবে না। মনে হয়, সরকার ও সরকারি দল এখন পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। এটা খুব ভালো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে না।
অন্যদিকে, বিরোধী দলের আচরণ থেকে মনে হয়, তারা ধরে নিয়েছে যে তারা যা-ই করুক, দেশের মানুষ নিরুপায় হয়ে তাঁদেরই সমর্থন করবে। কেননা, সামগ্রিক পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে নয়। সাধারণ মানুষ ভীত, শঙ্কিত। এ পরিস্থিতি থেকে আশু মুক্তির কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। কেননা, কোনো দলই এর একটা সমাধান চায় এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে তারা চিন্তিত বলেও মনে হয় না। সরকারি দল যেকোনো ধরনের সমালোচনাকেই একধরনের ষড়যন্ত্রের অংশ বলে বর্ণনা করে, গোড়াতে একে রাজনৈতিক কৌশল মনে হলেও এখন মনে হয় সরকারি দলের, এমনকি জোটের নেতারা পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। এ ধরনের ষড়যন্ত্র থাকলে তা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করার চেয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে মোকাবিলা করার যে কৌশল সরকারি দল নিয়েছে, তা এখন স্পষ্ট। সরকারি দলের বক্তব্য হলো, এ সবই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য। তারা সম্ভবত ধরে নিয়েছে যে যেহেতু অধিকাংশ নাগরিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এবং এটা উপলব্ধি করতে পারে যে এই বিচার শুরু করতে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, সেহেতু তারা সরকারি দলের আর কোনো বিকল্প ভাবতে পারবে না। তারা বলার চেষ্টা করছে যে বিরোধী ব্যক্তিদের তৈরি করা ‘এই ডামাডোলে রেহাই পেয়ে যাবে একাত্তরের ঘাতক-দালালেরা’। এই আশঙ্কা এক বিবেচনায় বাস্তবসম্মত এবং সেটা কারোরই কাম্য হতে পারে না।
কিন্তু এ পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন, সেটা ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখা দরকার, এ পরিস্থিতি তৈরির আগে সরকারের প্রতিশ্রুতি কী ছিল। সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা। অন্তত স্বচ্ছভাবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সীমান্তে মানুষ হত্যা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যবস্থা করা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিদ্যুৎসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা, ছাত্রলীগ-যুবলীগের লাগাম ধরা। সর্বোপরি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য, এমনকি তার সমর্থকেরা পর্যন্ত বলবেন, সীমিত। এসব কাজে সরকার মনোনিবেশ না করে অন্যত্র অনেক বেশি সময় ও শ্রম দেওয়ায় কাজের কাজ হয়নি, বরং সমস্যা বেড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি দলের আচরণ এসব সমস্যা সমাধানের বদলে তা আরও বেশি অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সরকারের আচরণে যে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। সরকার কেবল যে বিরোধী দলের প্রতিই অসহিষ্ণু আচরণ করছে তা নয়, সমাজের একেবারে সাধারণ মানুষের সামান্য দাবিদাওয়া, অভাব-অভিযোগ পর্যন্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবিলা করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর পুলিশি নির্যাতন তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। একজন শিক্ষকের প্রাণহানির ঘটনা সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা সরকারি দলের মনোযোগ পর্যন্ত আকর্ষণ করেনি। এ ধরনের আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। এসব ঘটনা বিরোধী দলের দাবি থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যাবে বলে যারা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে, তারা দলের এবং সরকারের জন্য ইতিবাচক কিছু করছেন না, দেশের জন্য তো নয়ই। সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা ঢাকার উপায় নতুন ইস্যু নয়, বরং সমস্যা মোকাবিলা করা। পাশাপাশি নাগরিকের অধিকার রক্ষায় আদালতের কাছেও ন্যায়ানুগ ভূমিকা প্রত্যাশিত। কেননা, নাগরিকের ভিন্নমত প্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে আদালতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিরোধী দল, যারা এখন নিজেদের একটা বড় জোট বলে দাবি করতে বেশি পছন্দ করে, তারা যে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে না, তা তাদের দেওয়া কর্মসূচিতেই স্পষ্ট। কী বিষয়ে তারা বেশি উৎসাহী, সেটা বোঝা যায় যখন তারা কোনো দাবিতে হরতাল দেয়। বারবার হরতাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশিদের সফর একটা বিবেচনার বিষয়, কিন্তু লাখ লাখ শিশুর পরীক্ষা বিবেচ্য নয়। বিরোধী দল দাবি করে যে এ ছাড়া তাদের হাতে বিকল্প নেই এবং এসব দাবিতে সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে। বিরোধী দলের দাবি ও হরতালের প্রতি সাধারণের সমর্থন থাকলে হরতালের ডাক দিয়েই কেন সহিংসতার পথ বেছে নিতে হয় তার কোনো ব্যাখ্যা এখনো বিরোধী পক্ষ দেয়নি। সম্ভবত তারা তার প্রয়োজনও বোধ করে না। হরতালে দলীয় লোক নিহত হলে নেতারা অন্তত শোক প্রকাশ করেন, নিরপরাধ সাধারণ মানুষ হরতালের শিকার হলে, প্রাণ হারালে তা উল্লেখ করারও সামান্য প্রয়োজন হয় না!
দুই পক্ষের এসব আচরণ মোটেই নতুন নয়, কিন্তু এখন এটা এত স্পষ্ট এবং অশোভন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে তা অস্বীকার করার আর উপায় নেই। এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার কারণ, দুই পক্ষই এটা ভাবছে যে ২০০৭-০৮ সালের ঘটনাবলির পর সাধারণ নাগরিকদের সামনে আর বিকল্প নেই, ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটাররা এই দুই দলেরই শরণাপন্ন হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে রাজনীতিবিদেরা কোনো শিক্ষা নেন না বলে যাঁরা প্রায়ই অভিযোগ করেন তাঁদের জন্য সুখবর যে রাজনীতিবিদেরা এই শিক্ষা নিতে ভুল করেননি। দোষটা দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার না দলগুলোর সেটা বিবেচনার ভার নাগরিকদের হাতে থাকল। কিন্তু ইতিমধ্যে এটা বলা কি অতিরঞ্জন হবে যে, দুই দলই সাধারণ মানুষকে তাঁদের জিম্মি বলে ভাবছে?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
যে কেউ লক্ষ করলে দেখবেন, গত কয়েক সপ্তাহে, বলতে পারেন গত কয়েক মাসে, একটার পর একটা ঘটনা ঘটে চলেছে। একটা ঘটনা আরেকটাকে চাপা দিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। পরিস্থিতি নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা করছে। এর যত না বিরোধী দল সৃষ্টি করছে, তার চেয়ে বেশি সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের অস্থিরতা ও সরকারি কার্যক্রমের ফসল। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে বিরোধী পক্ষ এই সুযোগ নিতে পিছপা হচ্ছে বা তারা একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা। সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যে যে অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা যেকোনো দিনের পত্রিকা পড়লেই বোঝা যায়। প্রতিদিনই তারা নতুন প্রতিপক্ষ আবিষ্কার করছে। তৈরি করছে বললেও খুব ভুল হবে না। মনে হয়, সরকার ও সরকারি দল এখন পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। এটা খুব ভালো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে না।
অন্যদিকে, বিরোধী দলের আচরণ থেকে মনে হয়, তারা ধরে নিয়েছে যে তারা যা-ই করুক, দেশের মানুষ নিরুপায় হয়ে তাঁদেরই সমর্থন করবে। কেননা, সামগ্রিক পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে নয়। সাধারণ মানুষ ভীত, শঙ্কিত। এ পরিস্থিতি থেকে আশু মুক্তির কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। কেননা, কোনো দলই এর একটা সমাধান চায় এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে তারা চিন্তিত বলেও মনে হয় না। সরকারি দল যেকোনো ধরনের সমালোচনাকেই একধরনের ষড়যন্ত্রের অংশ বলে বর্ণনা করে, গোড়াতে একে রাজনৈতিক কৌশল মনে হলেও এখন মনে হয় সরকারি দলের, এমনকি জোটের নেতারা পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। এ ধরনের ষড়যন্ত্র থাকলে তা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করার চেয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে মোকাবিলা করার যে কৌশল সরকারি দল নিয়েছে, তা এখন স্পষ্ট। সরকারি দলের বক্তব্য হলো, এ সবই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য। তারা সম্ভবত ধরে নিয়েছে যে যেহেতু অধিকাংশ নাগরিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এবং এটা উপলব্ধি করতে পারে যে এই বিচার শুরু করতে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, সেহেতু তারা সরকারি দলের আর কোনো বিকল্প ভাবতে পারবে না। তারা বলার চেষ্টা করছে যে বিরোধী ব্যক্তিদের তৈরি করা ‘এই ডামাডোলে রেহাই পেয়ে যাবে একাত্তরের ঘাতক-দালালেরা’। এই আশঙ্কা এক বিবেচনায় বাস্তবসম্মত এবং সেটা কারোরই কাম্য হতে পারে না।
কিন্তু এ পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন, সেটা ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখা দরকার, এ পরিস্থিতি তৈরির আগে সরকারের প্রতিশ্রুতি কী ছিল। সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা। অন্তত স্বচ্ছভাবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সীমান্তে মানুষ হত্যা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যবস্থা করা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিদ্যুৎসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা, ছাত্রলীগ-যুবলীগের লাগাম ধরা। সর্বোপরি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য, এমনকি তার সমর্থকেরা পর্যন্ত বলবেন, সীমিত। এসব কাজে সরকার মনোনিবেশ না করে অন্যত্র অনেক বেশি সময় ও শ্রম দেওয়ায় কাজের কাজ হয়নি, বরং সমস্যা বেড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি দলের আচরণ এসব সমস্যা সমাধানের বদলে তা আরও বেশি অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সরকারের আচরণে যে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পাচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। সরকার কেবল যে বিরোধী দলের প্রতিই অসহিষ্ণু আচরণ করছে তা নয়, সমাজের একেবারে সাধারণ মানুষের সামান্য দাবিদাওয়া, অভাব-অভিযোগ পর্যন্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবিলা করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর পুলিশি নির্যাতন তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। একজন শিক্ষকের প্রাণহানির ঘটনা সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা সরকারি দলের মনোযোগ পর্যন্ত আকর্ষণ করেনি। এ ধরনের আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। এসব ঘটনা বিরোধী দলের দাবি থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যাবে বলে যারা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে, তারা দলের এবং সরকারের জন্য ইতিবাচক কিছু করছেন না, দেশের জন্য তো নয়ই। সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা ঢাকার উপায় নতুন ইস্যু নয়, বরং সমস্যা মোকাবিলা করা। পাশাপাশি নাগরিকের অধিকার রক্ষায় আদালতের কাছেও ন্যায়ানুগ ভূমিকা প্রত্যাশিত। কেননা, নাগরিকের ভিন্নমত প্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে আদালতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিরোধী দল, যারা এখন নিজেদের একটা বড় জোট বলে দাবি করতে বেশি পছন্দ করে, তারা যে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে না, তা তাদের দেওয়া কর্মসূচিতেই স্পষ্ট। কী বিষয়ে তারা বেশি উৎসাহী, সেটা বোঝা যায় যখন তারা কোনো দাবিতে হরতাল দেয়। বারবার হরতাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশিদের সফর একটা বিবেচনার বিষয়, কিন্তু লাখ লাখ শিশুর পরীক্ষা বিবেচ্য নয়। বিরোধী দল দাবি করে যে এ ছাড়া তাদের হাতে বিকল্প নেই এবং এসব দাবিতে সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে। বিরোধী দলের দাবি ও হরতালের প্রতি সাধারণের সমর্থন থাকলে হরতালের ডাক দিয়েই কেন সহিংসতার পথ বেছে নিতে হয় তার কোনো ব্যাখ্যা এখনো বিরোধী পক্ষ দেয়নি। সম্ভবত তারা তার প্রয়োজনও বোধ করে না। হরতালে দলীয় লোক নিহত হলে নেতারা অন্তত শোক প্রকাশ করেন, নিরপরাধ সাধারণ মানুষ হরতালের শিকার হলে, প্রাণ হারালে তা উল্লেখ করারও সামান্য প্রয়োজন হয় না!
দুই পক্ষের এসব আচরণ মোটেই নতুন নয়, কিন্তু এখন এটা এত স্পষ্ট এবং অশোভন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে তা অস্বীকার করার আর উপায় নেই। এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার কারণ, দুই পক্ষই এটা ভাবছে যে ২০০৭-০৮ সালের ঘটনাবলির পর সাধারণ নাগরিকদের সামনে আর বিকল্প নেই, ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটাররা এই দুই দলেরই শরণাপন্ন হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে রাজনীতিবিদেরা কোনো শিক্ষা নেন না বলে যাঁরা প্রায়ই অভিযোগ করেন তাঁদের জন্য সুখবর যে রাজনীতিবিদেরা এই শিক্ষা নিতে ভুল করেননি। দোষটা দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার না দলগুলোর সেটা বিবেচনার ভার নাগরিকদের হাতে থাকল। কিন্তু ইতিমধ্যে এটা বলা কি অতিরঞ্জন হবে যে, দুই দলই সাধারণ মানুষকে তাঁদের জিম্মি বলে ভাবছে?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments