চারদিক-মায়া হরিণের মায়া by আকমল হোসেন
দেখলেই মায়া পড়ে যায়। গোবেচারা, নিরীহ একটা প্রাণী। ভাসা ভাসা চোখ দুটিতে ভয়, বিহ্বলতা, নাকি বিস্ময়—মনে হয় তার সবকিছুই তখন এই মায়াবী চোখ দুটিতে। বনে যার ছুটে বেড়ানো, মানুষের হাতে বন্দী হলে তার তো এমন ভয়কাতুরে হওয়ারই কথা।
খুবই সংবেদনশীল এক প্রাণী, মায়া হরিণ। দলবেঁধে বনের ভেতর ঘুরতে পারলেই যে স্বস্তিতে থাকে।
কিন্তু সেই বনের দশাটা কী! বনগুলো তার প্রাণ হারিয়ে শূন্য হচ্ছে। বন তো বৃক্ষ ও বন্য প্রাণীর সংসার। সেই সংসারে কত কিসিমের গাছপালা, লতাপাতা, ফলমূল থাকার কথা। সেই লতাপাতা, ফলমূল বন্য প্রাণীরা খাবে, গাছপালার নিবিড় আড়ালে শরীর ঢেকে ঘুরে বেড়াবে, বিশ্রাম নেবে। সেই বন কোথায় এখন! গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে। যারা বন বাঁচাবে, যারা বনের প্রাণীর রক্ষাকবচ দেবে, ক্ষমতার সেই শক্তির কেন্দ্রে এখন নগদ বাণিজ্যের জয়জয়কার। মানুষই যেখানে শুধু ক্ষমতার সিঁড়ি, শুধুই হাতিয়ার, সেখানে বন্য প্রাণী, পশু-পাখির কথা ভাবার মতো সময়, আন্তরিক উদ্যোগ কতটা প্রত্যাশা করার ভিত্তি আছে! তবু আশার ছায়াপথ ধরে এগিয়ে চলেছে মানুষ। কিন্তু বনের প্রাণী, তারা তো সেই আঁকাবাঁকা পথ আর বোঝে না। মানুষই পারে তাদের বাঁচার সুযোগ, নিরাপদ প্রশ্রয়ভূমি ও জল-জংলার বিচরণক্ষেত্র দিতে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রাণিকুলের এই নিরাপদ বিচরণভূমি এখন দস্যুকবলিত। আবাসস্থল তছনছ। তারা পড়েছে খাদ্যসংকটে। হয়তো এ কারণেই বন থেকে লোকালয়ে বেরিয়ে পড়ে। ৭ মে মৌলভীবাজার শহরতলির পাহাড় বর্ষিজুড়া এলাকায় একদল শিশু খেলা করছিল। হঠাৎ করেই তাদের চোখে পড়ে একটি হরিণ। শিশুদের চোখেমুখে হরিণ দেখার বিস্ময়। এরপর তাদের চিৎকারে বড়রা ছুটে এলে শুরু হলো হরিণটিকে ধরার উৎসব। যেন বনের এই প্রাণীটিকে ধরা না গেলে মানুষের আদিম গুহাজীবনের সেই শিকার পর্বটির কথা কারও আর মনেই থাকবে না। মানুষের সঙ্গে এসে জোটে কুকুরের পাল। বন্য প্রাণী দেখে উন্মাদ কুকুরের দল হরিণটিকে আঁচড়ে-কামড়ে আহত করে। একসময় ক্লান্ত-শ্রান্ত মায়া হরিণটি ধরা পড়ে যায়। তবে কিছু মানুষ হরিণটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। তারা স্থানীয় কবির মিয়ার বাড়িতে হরিণটিকে রেখে খবর দেয় বন বিভাগকে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজার বিট কর্মকর্তা চন্দন কুমার মজুমদার জানান, উদ্ধারের সময় হরিণটি আহত ছিল। চোখ, মুখ ও পিঠ হিংস্র প্রাণীর আঁচড়ে চিরে গিয়েছিল। লাউয়াছড়া ও বর্ষিজুড়া ইকোপার্ক থেকে মায়া হরিণটি হয়তো দলছুট হয়ে বেরিয়ে আসে। এটি দেড় থেকে দুই বছরের একটি পুরুষ মায়া হরিণ। উদ্ধারের পরই শুরু হয় আহত হরিণটিকে সুস্থ করার পালা। হরিণটিকে সরাসরি মৌলভীবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে নিয়ে যায় বন বিভাগের লোকজন। সেখানে দেখা গেল, হরিণটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছড়ে যাওয়া স্থানে অ্যান্টিসেপটিক মেখে দিচ্ছেন চিকিৎসক। দেওয়া হলো ব্যথানাশক ইনজেকশন। যাকে নিয়ে এত ব্যস্ততা, সেই মায়া হরিণটি ধুকপুক বুকে সবার চোখের দিকে কেমন মায়াজড়ানো একজোড়া ভীতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে।
সেখান থেকে বন বিভাগের কার্যালয়ে নিয়ে দেওয়া হয় কুকুরের কামড়ের ভ্যাকসিন। হরিণটিকে দেখতে সেখানে ছুটে যান মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল ভূঁইয়া। রাতে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানসহ কর্মকর্তারা হরিণটিকে দুধ ও কলা খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। দলছুট হওয়ার বিচ্ছেদ কষ্ট, নাকি মানুষের তাড়া খাওয়ার ভীতি বা অভিমান—মানুষ থেকে কিছুই সে খেতে চাইছিল না। মাহবুবুর রহমান জানান, রাত প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হরিণটির চিকিৎসা ও শুশ্রূষা চলে। সবার আকাঙ্ক্ষা, মায়া হরিণটি সুস্থ হয়ে উঠবে। তারপর তাকে আবার বনে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পরদিন শনিবার মারা যায় মায়া হরিণটি। আব্দুল আউয়াল ভূঁইয়া বলেন, ‘ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, হরিণটির শরীরে কুকুরের কামড়ের দাগ ছাড়াও মাংসের ভেতরে রক্ত বসে গেছে। যতক্ষণ রক্ত চলাচল ছিল, বেঁচে ছিল। পরে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে।’
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, ‘মায়া হরিণ খুবই সংবেদনশীল প্রাণী। ধরলেই অর্ধেক মারা যায়। বনের পাশে চা-বাগান রয়েছে। বিভ্রান্ত হয়ে হরিণসহ বন্য প্রাণী চা-বাগানে চলে আসে। এরপর লোকালয়ে এসে ধরা পড়ে।’ তবে কারও কারও মতে, আগেও তো চা-বাগান ছিল। এভাবে ঘন ঘন বন্য প্রাণী লোকালয়ে বেরিয়ে পড়েনি। বনেই তাদের খাদ্য ছিল, নিরাপদ আবাস ছিল। বন, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শুধু যে বন্য প্রাণীই বিপন্ন হয়েছে, বিষয়টি তো সেখানেই আটকে নেই, মানুষের বাঁচার, অস্তিত্বের প্রশ্নটাও তো এখন এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বন্য প্রাণী দেখলেই তাড়া নয়, আঘাত নয়, তাকে যে তার বনেই ঠাঁই দিতে হবে। এখন প্রয়োজন সেই মানসিকতার একটি সমাজ তৈরির। একটা-দুইটা হরিণ যদি লোকালয়ে চলেই আসে, তাতে তো ক্ষতি নেই।
কিন্তু সেই বনের দশাটা কী! বনগুলো তার প্রাণ হারিয়ে শূন্য হচ্ছে। বন তো বৃক্ষ ও বন্য প্রাণীর সংসার। সেই সংসারে কত কিসিমের গাছপালা, লতাপাতা, ফলমূল থাকার কথা। সেই লতাপাতা, ফলমূল বন্য প্রাণীরা খাবে, গাছপালার নিবিড় আড়ালে শরীর ঢেকে ঘুরে বেড়াবে, বিশ্রাম নেবে। সেই বন কোথায় এখন! গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে। যারা বন বাঁচাবে, যারা বনের প্রাণীর রক্ষাকবচ দেবে, ক্ষমতার সেই শক্তির কেন্দ্রে এখন নগদ বাণিজ্যের জয়জয়কার। মানুষই যেখানে শুধু ক্ষমতার সিঁড়ি, শুধুই হাতিয়ার, সেখানে বন্য প্রাণী, পশু-পাখির কথা ভাবার মতো সময়, আন্তরিক উদ্যোগ কতটা প্রত্যাশা করার ভিত্তি আছে! তবু আশার ছায়াপথ ধরে এগিয়ে চলেছে মানুষ। কিন্তু বনের প্রাণী, তারা তো সেই আঁকাবাঁকা পথ আর বোঝে না। মানুষই পারে তাদের বাঁচার সুযোগ, নিরাপদ প্রশ্রয়ভূমি ও জল-জংলার বিচরণক্ষেত্র দিতে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রাণিকুলের এই নিরাপদ বিচরণভূমি এখন দস্যুকবলিত। আবাসস্থল তছনছ। তারা পড়েছে খাদ্যসংকটে। হয়তো এ কারণেই বন থেকে লোকালয়ে বেরিয়ে পড়ে। ৭ মে মৌলভীবাজার শহরতলির পাহাড় বর্ষিজুড়া এলাকায় একদল শিশু খেলা করছিল। হঠাৎ করেই তাদের চোখে পড়ে একটি হরিণ। শিশুদের চোখেমুখে হরিণ দেখার বিস্ময়। এরপর তাদের চিৎকারে বড়রা ছুটে এলে শুরু হলো হরিণটিকে ধরার উৎসব। যেন বনের এই প্রাণীটিকে ধরা না গেলে মানুষের আদিম গুহাজীবনের সেই শিকার পর্বটির কথা কারও আর মনেই থাকবে না। মানুষের সঙ্গে এসে জোটে কুকুরের পাল। বন্য প্রাণী দেখে উন্মাদ কুকুরের দল হরিণটিকে আঁচড়ে-কামড়ে আহত করে। একসময় ক্লান্ত-শ্রান্ত মায়া হরিণটি ধরা পড়ে যায়। তবে কিছু মানুষ হরিণটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। তারা স্থানীয় কবির মিয়ার বাড়িতে হরিণটিকে রেখে খবর দেয় বন বিভাগকে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজার বিট কর্মকর্তা চন্দন কুমার মজুমদার জানান, উদ্ধারের সময় হরিণটি আহত ছিল। চোখ, মুখ ও পিঠ হিংস্র প্রাণীর আঁচড়ে চিরে গিয়েছিল। লাউয়াছড়া ও বর্ষিজুড়া ইকোপার্ক থেকে মায়া হরিণটি হয়তো দলছুট হয়ে বেরিয়ে আসে। এটি দেড় থেকে দুই বছরের একটি পুরুষ মায়া হরিণ। উদ্ধারের পরই শুরু হয় আহত হরিণটিকে সুস্থ করার পালা। হরিণটিকে সরাসরি মৌলভীবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে নিয়ে যায় বন বিভাগের লোকজন। সেখানে দেখা গেল, হরিণটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছড়ে যাওয়া স্থানে অ্যান্টিসেপটিক মেখে দিচ্ছেন চিকিৎসক। দেওয়া হলো ব্যথানাশক ইনজেকশন। যাকে নিয়ে এত ব্যস্ততা, সেই মায়া হরিণটি ধুকপুক বুকে সবার চোখের দিকে কেমন মায়াজড়ানো একজোড়া ভীতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে।
সেখান থেকে বন বিভাগের কার্যালয়ে নিয়ে দেওয়া হয় কুকুরের কামড়ের ভ্যাকসিন। হরিণটিকে দেখতে সেখানে ছুটে যান মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল ভূঁইয়া। রাতে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানসহ কর্মকর্তারা হরিণটিকে দুধ ও কলা খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। দলছুট হওয়ার বিচ্ছেদ কষ্ট, নাকি মানুষের তাড়া খাওয়ার ভীতি বা অভিমান—মানুষ থেকে কিছুই সে খেতে চাইছিল না। মাহবুবুর রহমান জানান, রাত প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হরিণটির চিকিৎসা ও শুশ্রূষা চলে। সবার আকাঙ্ক্ষা, মায়া হরিণটি সুস্থ হয়ে উঠবে। তারপর তাকে আবার বনে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পরদিন শনিবার মারা যায় মায়া হরিণটি। আব্দুল আউয়াল ভূঁইয়া বলেন, ‘ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, হরিণটির শরীরে কুকুরের কামড়ের দাগ ছাড়াও মাংসের ভেতরে রক্ত বসে গেছে। যতক্ষণ রক্ত চলাচল ছিল, বেঁচে ছিল। পরে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে।’
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, ‘মায়া হরিণ খুবই সংবেদনশীল প্রাণী। ধরলেই অর্ধেক মারা যায়। বনের পাশে চা-বাগান রয়েছে। বিভ্রান্ত হয়ে হরিণসহ বন্য প্রাণী চা-বাগানে চলে আসে। এরপর লোকালয়ে এসে ধরা পড়ে।’ তবে কারও কারও মতে, আগেও তো চা-বাগান ছিল। এভাবে ঘন ঘন বন্য প্রাণী লোকালয়ে বেরিয়ে পড়েনি। বনেই তাদের খাদ্য ছিল, নিরাপদ আবাস ছিল। বন, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শুধু যে বন্য প্রাণীই বিপন্ন হয়েছে, বিষয়টি তো সেখানেই আটকে নেই, মানুষের বাঁচার, অস্তিত্বের প্রশ্নটাও তো এখন এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বন্য প্রাণী দেখলেই তাড়া নয়, আঘাত নয়, তাকে যে তার বনেই ঠাঁই দিতে হবে। এখন প্রয়োজন সেই মানসিকতার একটি সমাজ তৈরির। একটা-দুইটা হরিণ যদি লোকালয়ে চলেই আসে, তাতে তো ক্ষতি নেই।
No comments