বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪০৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। নাসির উদ্দিন, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা রাতের অন্ধকারে নাসির উদ্দিনসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা নিঃশব্দে অবস্থান নিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের অদূরে। তাঁরা সেখানে অপেক্ষা করতে থাকলেন।
একটু পর ভারত থেকে পাকিস্তানি অবস্থানে শুরু হলো গোলাবর্ষণ। একের পর এক গোলা এসে পড়তে থাকল। চারদিকের মাটি ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠছে। বিকট শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। দুই-তিনটি গোলা ভুলক্রমে এসে পড়ল তাঁদের কাছে।
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই প্রস্তুত। অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ামাত্র তাঁরা একযোগে ছুটে গিয়ে আক্রমণ চালাবেন পাকিস্তানি সেনাদের। তার আগে পাকিস্তানি সেনাদের ভীতসন্ত্রস্ত করার জন্য চলছে গোলাবর্ষণ। একটু পর গোলাবর্ষণ শেষ হলো। অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ামাত্র নাসির উদ্দিন তাঁর অধীন সহযোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন পাকিস্তানি অবস্থানের উদ্দেশে।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানি অবস্থান থেকেও শুরু হয়েছে গোলাগুলি। নাসির উদ্দিন ভয় না পেয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেলেন সামনে। তাঁর পেছনে সহযোদ্ধারা। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা পৌঁছে গেলেন পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে।
এমন অতর্কিত আক্রমণে হতভম্ব পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণে তাদের মনোবল ভেঙে পড়ার উপক্রম। তখন নাসির উদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে আরও সাঁড়াশি আক্রমণ চালালেন। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা আবস্থানগুলো ভেঙে পড়তে থাকল। দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান ছেড়ে পেছনে পালিয়ে গেল।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষে। কসবায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত কসবা। সীমান্ত এলাকা। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা দখল করে নেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কসবার প্রতিরক্ষা অবস্থান।
সেদিন যুদ্ধে নাসির উদ্দিন যথেষ্ট বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ২৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহত হয় ১৮ জন। হস্তগত হয় ১১টি এলএমজি, একটি সিগন্যাল পিস্তল, ৪০টি গ্রেনেড (এইচই ৩৬), তিনটি এনারগা গান, ৪৪টি প্লাস্টিক মাইন, একটি ম্যাপ ও দুটি র্যাংক ব্যাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে চারজন শহীদ ও ১৫ জন আহত হন।
পরদিন পাকিস্তানি সেনারা পুনর্গঠিত হয়ে কসবা দখলের চেষ্টা চালায়। তাদের একটি দল একটি ছোট নালার পশ্চিমতীরে দ্রুত অবস্থান নেয়। তখন নাসির উদ্দিন তাঁর দল নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওই দলের ওপর আক্রমণ চালান। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনাদের ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল এসে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তখন পাকিস্তানি সেনারা পুরোপুরিভাবে পিছু হটে যায়।
নাসির উদ্দিন চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে। মার্চ মাসের শুরুতে এই রেজিমেন্টে বেশির ভাগ সেনাকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা বিদ্রোহ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে তিনি প্রথমে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে কে ফোর্সের নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আগস্ট মাসের শেষে নবম ইস্ট বেঙ্গল গঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য নাসির উদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩।
নাসির উদ্দিন ১৯৭৯ সালে হূৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তখন তিনি ৩৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নায়েব সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার আন্দিবাড়ি গ্রামে। বাবার নাম গদু শেখ, মা রূপজান বেগম। স্ত্রী বুলবুলি বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই প্রস্তুত। অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ামাত্র তাঁরা একযোগে ছুটে গিয়ে আক্রমণ চালাবেন পাকিস্তানি সেনাদের। তার আগে পাকিস্তানি সেনাদের ভীতসন্ত্রস্ত করার জন্য চলছে গোলাবর্ষণ। একটু পর গোলাবর্ষণ শেষ হলো। অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ামাত্র নাসির উদ্দিন তাঁর অধীন সহযোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন পাকিস্তানি অবস্থানের উদ্দেশে।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানি অবস্থান থেকেও শুরু হয়েছে গোলাগুলি। নাসির উদ্দিন ভয় না পেয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেলেন সামনে। তাঁর পেছনে সহযোদ্ধারা। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা পৌঁছে গেলেন পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে।
এমন অতর্কিত আক্রমণে হতভম্ব পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণে তাদের মনোবল ভেঙে পড়ার উপক্রম। তখন নাসির উদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে আরও সাঁড়াশি আক্রমণ চালালেন। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা আবস্থানগুলো ভেঙে পড়তে থাকল। দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান ছেড়ে পেছনে পালিয়ে গেল।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষে। কসবায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত কসবা। সীমান্ত এলাকা। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা দখল করে নেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কসবার প্রতিরক্ষা অবস্থান।
সেদিন যুদ্ধে নাসির উদ্দিন যথেষ্ট বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ২৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহত হয় ১৮ জন। হস্তগত হয় ১১টি এলএমজি, একটি সিগন্যাল পিস্তল, ৪০টি গ্রেনেড (এইচই ৩৬), তিনটি এনারগা গান, ৪৪টি প্লাস্টিক মাইন, একটি ম্যাপ ও দুটি র্যাংক ব্যাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে চারজন শহীদ ও ১৫ জন আহত হন।
পরদিন পাকিস্তানি সেনারা পুনর্গঠিত হয়ে কসবা দখলের চেষ্টা চালায়। তাদের একটি দল একটি ছোট নালার পশ্চিমতীরে দ্রুত অবস্থান নেয়। তখন নাসির উদ্দিন তাঁর দল নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওই দলের ওপর আক্রমণ চালান। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনাদের ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল এসে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তখন পাকিস্তানি সেনারা পুরোপুরিভাবে পিছু হটে যায়।
নাসির উদ্দিন চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে। মার্চ মাসের শুরুতে এই রেজিমেন্টে বেশির ভাগ সেনাকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা বিদ্রোহ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে তিনি প্রথমে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে কে ফোর্সের নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আগস্ট মাসের শেষে নবম ইস্ট বেঙ্গল গঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য নাসির উদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩।
নাসির উদ্দিন ১৯৭৯ সালে হূৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তখন তিনি ৩৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নায়েব সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার আন্দিবাড়ি গ্রামে। বাবার নাম গদু শেখ, মা রূপজান বেগম। স্ত্রী বুলবুলি বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments