দুই দু’গুণে পাঁচ-আইনজীবী সমীপে by আতাউর রহমান

গল্প আছে: আদালতে একটি ক্ষতিপূরণ মামলার শুনানি হচ্ছিল—এক বহুজাতিক কোম্পানির কর্মচারী আনা নেওয়ার কাজে নিয়োজিত গাড়ি একটি বাচ্চা ছেলেকে চাপা দিয়ে তার দুই বাহুকে আহত করায় সে আর বাহুদ্বয় মাথার ওপর তুলতে পারে না, তাই।


বিবাদীপক্ষের অর্থাৎ কোম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত আইনজীবী একপর্যায়ে ছেলেটিকে জেরা করার কালে কণ্ঠে খুব দরদ ফুটিয়ে তাকে বললেন, সে যেন হাকিম সাহেবকে দেখায় দুর্ঘটনার পর থেকে হাত কতটুকু উঁচুতে তুলতে পারে। ছেলেটি দেখাল, সে কষ্টেসৃষ্টে হাত দুটো কাঁধ পর্যন্ত উঠাতে পারে। অতঃপর উক্ত আইনজীবী কণ্ঠে ততোধিক দরদ ফুটিয়ে ছেলেটিকে বললেন, ‘বৎস, এবারে দুর্ঘটনার পূর্বে হাত কত উঁচুতে তুলতে পারতে, সেটা মাননীয় আদালতকে দেখাও তো।’ এটা বলতেই বাচ্চার হাত দুটো সোজা মাথার ওপরে উত্থিত হলো। ফলাফল—মামলা ডিসমিস।
এভাবে বুদ্ধির জোরে আইনজীবী মহোদয় কোম্পানিকে বিরাট আর্থিক ক্ষতি থেকেই শুধু বাঁচালেন না, আইনের শাসন প্রচেষ্টায়ও অবদান রাখলেন। তাই আমার মতে, আইনজীবীদের যে বাংলা ভাষায় ব্যবহারজীবীও বলা হয়, সেটা না বলে তাঁদের বরং বলা উচিত বুদ্ধিজীবী, আর সেসব কথিত বুদ্ধিজীবী মাঝেমধ্যে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েই খালাস, তাঁদের বরং বলা উচিত ব্যবহারজীবী। বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না হয় নাই-বা গেলাম। আর বলা হয়ে থাকে যে দুনিয়ার মানুষেরা যদি ঠিকঠাকমতো চলত ও প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ না করত, তাহলে উকিল সাহেবদের জীবিকা নির্বাহই কঠিন হয়ে পড়ত, এ কথাটায়ও যথেষ্ট সারবত্তা আছে বৈকি।
তবে উপরিউক্ত ঘটনার বিপরীতে পত্রিকার পাতায় যখন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে ঢাকা শহরে সংঘবদ্ধ গাড়িচোর চক্রের সদস্যদের কেউ পুলিশ কর্তৃক পাকড়াও হয়ে কোর্টে নীত হলে পর একদল আইনজীবী আছেন, যাঁরা তার জামিনের জন্য উঠেপড়ে লেগে যান এবং জামিনপ্রাপ্ত হয়েই সে পুনরায় পুরোনো ধান্ধায় প্রবৃত্ত হয়, তখন আমরা যারা অনন্ত একবার গাড়ি হারিয়েছি এবং অতঃপর অনেক তাবিজ-কবচ ও চেষ্টা-তদবিরের পর কেউবা আংশিক পেয়েছি আর কেউবা আদৌ পাইনি, তারা মনে মনে শঙ্কিত না হয়ে পারি না। উপরন্তু আরও প্রত্যাশা করি, ওই উকিল সাহেবদের কারও কারও অবশ্যই গাড়ি আছে; গাড়িচোরেরা কেন তাঁদের গাড়ি চুরি করে না, তাহলে তাঁরা বুঝতেন কত ধানে কত চাল। তাই তো জনৈক উকিল সাহেব এক সিঁদেল চোরকে আদালতে চুরির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ানোর পর সে যখন বলল ‘পরে বাসায় গিয়ে দেখা করব’, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘দয়া করে দিনের বেলায় যেয়ো, রাতে না।’ বারান্তরে আরেক উকিল সাহেব এক পকেটমারকে আদালতে পকেট কাটার অভিযোগ থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার পর সে তাঁকে যে কী প্রদান করেছিল, সেটা যে কোন ফাঁকে সে আবার তাঁর পকেট থেকে নিয়ে নিয়েছে, তা তিনি টেরই পাননি।
প্রসঙ্গক্রমে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের উপাখ্যানটা মনে পড়ে গেল, তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে যখন আইন ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন ঘটনাটা সে সময়ের: আব্রাহাম লিংকনের কাছে একবার একটি মামলা আসে, যেটি হাতে নিলে তাঁর অনেক অর্থাগমন হতো। কিন্তু লিংকন খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন, তাঁর মক্কেল মামলায় জিতলে একজন বিধবা ও তাঁর দুজন সন্তান একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। অতএব তিনি মামলাটি হাতে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পত্র লিখে পাঠালেন, ‘আমি আপনার মামলাটি নেব না, যদিও আমি জানি যে নিলে জিতব। কিছু ব্যাপার আছে আইনগতভাবে সঠিক, কিন্তু নৈতিকভাবে সঠিক নয়। তবে আমি কোনো ফি না নিয়েই আপনাকে একটা পরামর্শ দিচ্ছি—আপনার মতো কর্মঠ ব্যক্তি ইচ্ছে করলে অন্য যেকোনো উপায়ে ৬০০ ডলার উপার্জন করতে পারেন।’
অনুজপ্রতিম সাহিত্যিক, সাংবাদিক আনিসুল হক বহুদিন ধরে ‘অরণ্যে রোদন’ করে আসছেন। জানি, আমার এই প্রচেষ্টাও অরণ্য রোদনই হবে; তবুও ওই সব আইনজীবী ভাইকে আমি সবিনয়ে আব্রাহাম লিংকনের উপাখ্যান থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে অনুরোধ জানাব।
ফিরে আসি প্রথমোক্ত গল্পে। গল্পটিতে উল্লিখিত উকিল সাহেব তো সত্য উদ্ঘাটনের নিমিত্ত কিছুটা কপটতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত নিরেট কপটতার আশ্রয় গ্রহণ কোর্ট-কাচারিতে আমরা প্রায়ই প্রত্যক্ষ করে থাকি। একটি মামলায় বাদী বাচ্চা ছেলে উচ্চতায় খুব খাটো হওয়ায় তার পক্ষের উকিল সাহেব তাকে কাঠগড়ায় দুই হাত দিয়ে তুলে রাখলেন এবং তার কান্নাকাটিতে হাকিম সাহেব বিচলিত বোধ করে তড়িঘড়ি তার পক্ষে রায়ও দিয়ে দিলেন। অতঃপর বাচ্চা ছেলেটিকে কাঠগড়ায় এত কান্নাকাটির কারণ জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দিল, ‘আমি কী করব? উকিল সাহেব যে বারবার আমাকে চিমটি কাটছিলেন।’ বারান্তরে একজন হাকিম সাহেব সাক্ষীকে সত্য বলার জন্য ধমক লাগালে পর সে বলল, ‘আমি কী করব, হজুর? আমি তো সত্য কথাটাই বলতে চাই; কিন্তু উকিল সাহেব ওখান থেকে বারবার চোখের ইশারায় আমাকে নিষেধ করছেন।’
তা অনেক সময় আদালতে উকিল সাহেবদের মেজাজ খারাপ করতেও দেখা যায়। এক উকিল সাহেবের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে তাঁর মক্কেল নির্দোষ ও সে খালাস পাবে। কিন্তু জজ সাহেব ওকে শাস্তি দিয়ে দিলেন। উকিল সাহেব তখন রেগেমেগে জজ সাহেবকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘মাননীয় আদালত, তাহলে আমাকেও শাস্তি দিন।’ জজ সাহেব বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন?’ উত্তর এল, ‘আদালত অবমাননার জন্য।’ জজ সাহেব ততোধিক বিস্মিত হয়ে এবারে বলে উঠলেন, ‘আদালত অবমাননা? আপনি তো অবমাননামূলক একটা শব্দও বলেননি!’ উকিল সাহেব তখন বললেন, ‘আমার অবমাননা হচ্ছে নিঃশব্দ (My contempt is silent)।’
তবে এটা বোধকরি বানানো গল্প; বাস্তব কল্পনার চাইতেও আশ্চর্যজনক (Tৎuth is stranger then fiction)। কিছুদিন আগে, পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, আমাদের দেশের উচ্চ আদালতের এক বিচারক তাঁর রায় যখন পড়ছিলেন তখন বিবাদীপক্ষের প্রবীণ প্রথিতযশা আইনজীবী রায়টি তাঁর প্রতিকূলে যাচ্ছে আঁচ করতে পেরে মাঝপথে বিচারককে বকাঝকা করতে শুরু করে দিলেন। বিচারককে প্রশংসা করতেই হয়, তিনি কোনো উচ্চবাচ্য না করে রায় পড়া বন্ধ করে দিয়ে তাঁর খাস-কামরায় চলে গিয়ে সম্ভ্রম বাঁচালেন।
পরিশেষে সমাপ্ত করতে চাচ্ছি একটি মজার গল্প দিয়ে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে মৃত্যুর পরপারে সেইন্ট পিটার তাঁদের অভ্যর্থনা করে থাকেন। তো এই ধর্মের অনুসারী একজন শিক্ষক, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও একজন আইনজীবী একই দিনে মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে স্বর্গের গেটে উপনীত হলেন। সেইন্ট পিটারের ‘মুড’ সেদিন বিশেষ ভালো ছিল না বিধায় তিনি স্থির করলেন, তাঁদের প্রত্যেককে একটা করে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে তবে স্বর্গে প্রবেশ করতে হবে। সর্বাগ্রে তিনি শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেন, টাইটানিক জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরে কবে ডুবেছিল, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, ‘১৯১২ সালে’; এবং স্বর্গে প্রবেশের অনুমতিও মিলল।
অতঃপর পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে প্রশ্ন করা হলো, মোট কতজন প্যাসেঞ্জারের সলিল সমাধি হয়েছিল? ‘পনেরো শ তেইশ’, পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রত্যুত্তরে বলল, এবং উত্তর সঠিক ছিল বিধায় তাকেও স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো।
এবারে আইনজীবীর পালা। সেইন্ট পিটার বোধকরি আইনজীবীদের ওপর চটা; তাই তিনি আইনজীবীকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘ওই ১৫২৩ জনের প্রত্যেকের নাম কী ছিল?’
আতাউর রহমান: রম্যলেখক, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.