সংবিধান-পরিবেশ অন্তর্ভুক্তির এটাই সময় by আবু রায়হান মুহম্মদ খালিদ

পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি শুধু সংবিধানে সংযোজিত করলেই তা পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট হবে না, পরিবেশ সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে এমন অংশে ও এমনভাবে সংযোজন করতে হবে যাতে সে বিধানগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো একটি প্রক্রিয়া থাকে, যেমনটি রয়েছে আমাদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য


পরিবেশ আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা হলেও আমাদের প্রজাতন্ত্রের মূল আইন আমাদের সংবিধান, সেই সংবিধানে এ নিয়ে কিছু বলা নেই। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান যখন রচিত হয় পরিবেশগত সমস্যাগুলো তখনও এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি এবং বিশ্বজুড়ে এ সংক্রান্ত সচেতনতাও তখন অতি সামান্য ছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার আমাদের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত এর রায়ে সংবিধানে কতিপয় পরিবর্তন সাধন করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এখন একটি যুগসন্ধিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রজাতন্ত্রের মূল দলিলে সনি্নবেশিত করার এটাই উপযুক্ত সময়। অবশ্য এ প্রয়োজন অনেক আগেই অনুভূত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত ১৯৯৬ সালে এক রায়ে পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করেন, যদিও আমাদের সংবিধানে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য স্পষ্ট কোনো বিধান নেই, তবুও আমাদের সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ, যেখানে সংবিধান নাগরিকের জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা দিয়েছে, সেখানে জীবনের অধিকারের মধ্যে পরিবেশের সুরক্ষা এবং প্রতিবেশগত ভারসাম্যের বিষয়টিও রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের এ উচ্চারণ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, পথ দেখিয়েছে, তবে পরিবেশের সুরক্ষায় তা যে যথেষ্ট নয় তা আজ আমরা স্পষ্ট টের পাচ্ছি। পরিবেশ সংক্রান্ত আমাদের যে আইনগুলো আছে তা অগোছাল, দুর্বল এবং এর কোনো শক্তিশালী ভিত্তি নেই। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ একা এ সমস্যায় ভুগছে না। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, পরিবেশগত সমস্যা একটি অপেক্ষাকৃত নতুন সমস্যা এবং সে কারণে বিশ্বের যেসব দেশে গত এক বা দু'দশকের মধ্যে সংবিধান সংশোধন বা নতুনভাবে প্রণয়ন করা হয়নি, সেসব দেশের সংবিধানে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধান মোটামুটিভাবে অনুপস্থিত। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, যা বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সংবিধান, তাতে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধান নেই, যদিও অনেক রাষ্ট্র সংবিধানে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করেছে।
তবে সংবিধান সংশোধন এবং অন্যবিধ উপায়ে সংবিধানে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করা বিগত বছরগুলোতে ব্যাপক হারে ঘটেছে এবং কারও কারও মতে, বর্তমানে বিশ্বের ১১৭টি দেশের সংবিধানে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ১৯৭৬ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৪৮এ এবং ৫১এ অনুচ্ছেদ যুক্ত করেছে। ৪৮এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র পরিবেশের সুরক্ষায় এবং উন্নতিতে সচেষ্ট থাকবে এবং ৫১এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। ৪৮এ অনুচ্ছেদটি সনি্নবেশিত হয়েছে সংবিধানের চতুর্থ ভাগে যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো আর ৫১এ অনুচ্ছেদটি সনি্নবেশিত হয়েছে নবগঠিত ৪এ ভাগে। পরে ১৯৯২ সালের এক সংশোধনীতেও পরিবেশ বিষয়ক কতিপয় গৌণ বিধান সংবিধানে যুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানের সংবিধানে পরিবেশের উল্লেখ আছে এবং বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকারই এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তির সুস্থ পরিবেশের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। একই সঙ্গে ৩৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতেও পরিবেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এখানে উলেল্গখ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন, পরিবেশের সুরক্ষায় উৎকৃষ্ট বিধান সংবলিত সংবিধানের যদি কোনো তালিকা হয় তবে সে তালিকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো খুব একটা ওপরে অবস্থান করবে না। অতএব এ দেশগুলো আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে না। আরও একটি কারণে আলোচ্য দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বড় অমিল রয়েছে, তা হলো, আলোচ্য দেশগুলোর কোনোটিতেই এখন পর্যন্ত পরিবেশগত সমস্যা দেশের নাগরিকদের জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি, যেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, চার-পাঁচটি নগররাষ্ট্রকে বাদ দিলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জাতীয় জীবনে পরিবেশ অতিগুরুত্বপূর্ণ_ এমন কয়েকটি দেশে পরিবেশ রক্ষায় উন্নততর বিধান সংবলিত সংবিধান প্রণীত হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি শুধু সংবিধানে সংযোজিত করলেই তা পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট হবে না, পরিবেশ সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে এমন অংশে ও এমনভাবে সংযোজন করতে হবে যাতে সে বিধানগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো একটি প্রক্রিয়া থাকে, যেমনটি রয়েছে আমাদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। অর্থাৎ সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রকে শুধু পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করলেই তা যথেষ্ট হবে না, যেমনটি আমরা দেখেছি আমাদের সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদের বেলায় ঘটেছে। পরিবেশ সংক্রান্ত নাগরিকদের একটি অধিকার সৃষ্টি করতে হবে এবং তা সংযোজন করতে হবে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে, আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে। কেবল তবেই নাগরিকরা পরিবেশের অধিকারকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পাবেন।
সংবিধানের পরিবেশ সংক্রান্ত বিধানে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন সেগুলো হলো : নাগরিকদের সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশের মৌলিক অধিকার। সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ রক্ষায় এবং পরিবেশের উন্নতিতে রাষ্ট্রের বাধ্যকরী দায়িত্ব। সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ রক্ষায় সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাধ্যকরী দায়িত্ব। নাগরিকের পরিবেশের মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রের ও ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ রক্ষায় বাধ্যকরী দায়িত্ব বাস্তবায়নে নাগরিকের আদালতের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগের স্বীকৃতি। প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও প্রাণসম্পদকে গণসম্পত্তি হিসেবে স্বীকৃতি। প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও প্রাণসম্পদের সব ব্যবহারে (বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা) পরিবেশের সুরক্ষা ও উন্নয়নকে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ। সব প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পাদিত সব চুক্তি, যাতে কোনো না কোনোভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা, প্রাণসম্পদ বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার জড়িত, চূড়ান্ত করার আগে জনসমক্ষে প্রকাশ ও সংসদের অনুমোদন গ্রহণ। পরিবেশ বিষয়ক সব আন্তর্জাতিক চুক্তি, কনভেনশন ইত্যাদি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করার সাংবিধানিক প্রক্রিয়া।
এগুলো সংবিধানের পরিবেশ বিষয়ক বিধানে অন্তর্ভুক্ত করলে তবেই তা বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস। পরিবেশ যাদের জীবন-মরণ সমস্যা সেসব জাতি_ ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও কেনিয়া এরই মধ্যে তাদের সংবিধানে উপরোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করছে। সবচেয়ে ঘনবসতির দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে থাকাই প্রয়োজন। কেননা বিপন্ন পরিবেশের অর্থ হলো বিপন্ন জাতি।

ব্যারিস্টার আবু রায়হান মুহম্মদ
খালিদ : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
raihan.khalid@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.