উন্নয়নের মাপকাঠি বাথরুম by আনোয়ারা সৈয়দ হক

একটি দেশ যে উন্নত আমরা কিভাবে বুঝি? এর উত্তরে অনেকেই হয়তো বিভিন্ন ধরনের কথা বলবেন। কেউ বলবেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা, কেউ বলবেন বার্ষিক জাতীয় প্রবৃদ্ধির কথা, কেউ বা বলবেন মাথাপিছু আয়ের কথা। কিন্তু কেউ বাথরুমের কথা বলবেন না! বাথরুমের কথা যে বলতে হয়, এ ধরনের চিন্তা অনেকের মাথায় আসবেই না।


দেশের উন্নতির সঙ্গে বাথরুমের সম্পর্ক কী_অনেকেই এ প্রশ্ন করবেন এবং আমাকে পাগল বলে চিহ্নিত করবেন।
কিন্তু আমি পাগল নই। শুধু তা-ই না, বরং যারা পাগল হয় তাদের আমি চিকিৎসা করি। জাতীয় প্রবৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয় এসব বড় বড় কথা হলো বিশেষজ্ঞদের কথা, আর আমার কথা হলো বাথরুমের কথা। খেয়াল করে দেখবেন, উন্নত দেশের বাথরুমগুলোর অবস্থা। সেখানে এক পাশে ভাত রান্না করে খাওয়া যায়। এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে আপনার-আমার কল্পনার বাইরে। কী মানুষের ঘরের বাথরুম, কী বাইরের বাথরুম_সব ঝকঝকে-তকতকে। সব ফকফকা, পরিষ্কার। সেসব দেশে একবার পা রাখলে কাউকে খবরের কাগজের পাতায় রচনা লিখে মানুষকে বোঝাতে হয় না যে দেশটা উন্নত, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, খুবই ভালো এবং এত ভালো যে তাদের জনগণের বাথরুমে ঢুকে আমাদের বাংলাদেশের মানুষরা তা কল্পনাই করতে পারে না।
আমি নিয়মিত দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই। আমি আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করি বা কাজের জন্য যাই। রাজধানীতে থাকলে আমি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যাতায়াত করি, সেখানে আমাকে বাথরুমে যেতে হয়, কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেউ সভা করতে পারে না, অন্তত আমার মতো মানুষরা পারে না, তাদের বাথরুমে যেতে হয়।
হাতের কাছেই আছে শিল্পকলা একাডেমী। সেখানে প্রতিদিন কতগুলো যে নাটকের মহড়া হয় এবং নাটক অভিনীত হয়, তা হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। আপনি যদি যেকোনো সময় সেখানে ঢুঁ মারেন তো দেখবেন, কিছু না কিছু অনুষ্ঠান চলছেই। তো পরীক্ষামূলকভাবে সেখানকার একটা বাথরুমে ঢুকুন, দেখবেন দুনিয়ার গজব আপনার ওপর নেমে এসেছে। কমোডের মাথা নেই, ফ্লাশে পানি নেই, পানি ঘোরানোর হ্যান্ডেলটা লুলা মানুষের হাতের আঙ্গুলের মতো ঝুলঝুল করছে! কমোডের গর্তে পৃথিবীর আদি মলের গভীর দাগ। মেঝের টাইলস ফুঁড়ে বের হচ্ছে অনাদিকালের দুর্গন্ধ। কোনো কালে কোনো বাথরুম ক্লিনার একবার ভিম পাউডার ব্যবহার করেছিল, সেই পাউডারের খালি কৌটা আর একটা মলিন ন্যাকড়া জানালার তাকে শোভা পাচ্ছে। হাত ধোয়ার বেসিনে এক ফোঁটা লিকুইড নেই, বেসিনের নব ঘোরালে চর্কির মতো ঘুরতে থাকে; কিন্তু তাতে এক ফোঁটা পানি আসে না, টয়লেট পেপার দূরে থাক। সেদিন শিল্পকলা একাডেমীর বাথরুমে প্রবেশ করে একেবারে হতভম্ভ। এমন কেউ হাতের কাছে নেই অর্থাৎ ক্লিনারদের কেউ, যার কাছে সাহায্য চাওয়া যায়। অথচ আমার দৃঢ়বিশ্বাস, কোনো না কোনো ক্লিনার সেখানে ডিউটিতে থাকার কথা। একই ঘরের ভেতরে তিন-চারটি টয়লেট, সব কয়টারই একই অবস্থা। অথচ আমি জানি, বাথরুম মেনটেন্যান্সের নাম করে প্রতিমাসে টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। শুনেছি ১০০টা বাথরুম নাকি শিল্পকলা একাডেমীতে। কিন্তু একটারই যে অবস্থা, অন্যগুলোর হয়তো এত দিনে রোজ কেয়ামত হয়ে গেছে। অথচ প্রচুর বিদেশি প্রতিদিন শিল্পকলা একাডেমীতে নাটক দেখতে আসেন, তাঁদের সামনে নিজের দেশের বাথরুমের এ রকম করুণ অবস্থা তুলে ধরতে একাডেমী কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই, বরং হয়তো মনে মনে উৎসাহ আছে এই ভেবে যে বিদেশিরা দেখে যাক, আমরা কত গরিব যে একটা হাত ধোয়ার সাবান পর্যন্ত কেনার পয়সা আমাদের সরকারের নেই! এবার আসুন ঢাকা বিমানবন্দরে। অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে একটু ভ্রমণ করে যান। সেখানকার বাথরুমের অবস্থাও সেই একই, অর্থাৎ শিল্পকলা একাডেমীর মতো। এই একই প্রাণ ভেদ করা প্রস্রাব এবং পায়খানার গন্ধ। সাবান নেই, মেঝে নোংরা, কল থেকে একভাবে পানি পড়ে যাচ্ছে, বাথরুমে আগন্তুক কেউ এসে একটু ঝুঁকলেই মানুষের উদোম অবস্থা চোখে দেখা যাবে, টয়লেট পেপার আছে, কিন্তু সেটা ভেজা। অথচ সারাক্ষণ এই বিমানবন্দরে দেশি-বিদেশি মানুষ যাতায়াত করছে। যাঁরা দেশের মানুষের যত্ন নেন না, তারা বিদেশিদের কাছে অন্তত নিজের দেশের ইমেজ ঠিক রাখার জন্য একটু তৎপর হতে পারেন; কিন্তু না, বরং বিদেশিদের নিজেদের দৈন্যদশা দেখাতে পারলেই তাঁরা যেন খুশি। আরো এইড, আরো সাহায্য। শিল্পকলা একাডেমীর বাথরুমের সঙ্গে ঢাকা বিমানবন্দরের বাথরুমের একটা বিরাট পার্থক্য আছে। আর সেটা হলো, বিমানবন্দরের বাথরুমে ঢুকলেই দেখা যাবে কতগুলো মেয়ে ক্লিনার বাথরুমের মেঝেতে বসে ভাত-তরকারি খাচ্ছে। আপনি যখনই যান, তাদের মেঝেতে পা মেলে বসে ভাত খেতে দেখবেন, দেখে মনে হয় তারা যেন সর্বদাই ক্ষুধার্ত, বাথরুমের প্রস্রাব এবং মলের গন্ধ তাদের কাছে কিছুই না! মেঝে নোংরা, পানিতে থৈথৈ করছে, কমোডের ওপর পানির ঢল, ফ্ল্যাশ কাজ করে না বহুকাল থেকে, সর্বত্র একটা খিতখিত ভাব; কিন্তু তাতে কী, জঠরের জ্বালা বিমানবন্দরে চাকরি করতে এসেই তো মেটাতে হবে।
ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবস্থা পাঠক নিশ্চয়ই এখন ভাবতে শুরু করেছেন জানি। কিন্তু হা-হতোস্মি, সেখানেই অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের অবস্থার মতোই। সেখানেও বাথরুমে বসে ক্লিনার মেয়েরা ভাত-তরকারি খাচ্ছে। সেখানেও বাথরুমের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। মনে হয় যেন এদের খবরদারি করার মতো কেউ নেই, কারণ আজকাল শুনি সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাকি দলীয়ভাবে করা হচ্ছে, হয় বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ ।
এরপর আসুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বাথরুমে। হায় হায়, আপনি এখন পর্যন্ত টিএসসির বাথরুম দেখেননি? অবশ্যই সময় করে একবার দেখে আসবেন। এসব বাথরুম চোখে দেখলে আপনি নতুনভাবে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, হোয়াট মাইন্ড ডাজ নট নো, আইস ক্যান নট সি। অর্থাৎ মন থেকে কেউ কিছু না জানলে, চোখের সামনে দিয়ে সেসব ঘটনা ঘটে গেলেও তা বুঝতে পারবে না। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। অর্থাৎ আপনাকে চোখে চেয়ে সব আগে দেখতে হবে, তারপর আপনি চিন্তা করে দেখবেন আপনার দেশ পার ক্যাপিটা ইনকামে কত দূর এগিয়েছে। হয়তো বলবেন, এসব বখোয়াস আমি কেন বলছি, কারণ বাথরুমের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে দেশের সচ্ছলতার কী সম্পর্ক। অবশ্যই সম্পর্ক আছে। আমার কথা বিশ্বাস না হয় তো দেখে আসুন ঢাকা ক্লাব। সেখানে ধনাঢ্যরা যাতায়াত করেন। তাঁদের বাথরুমে ঢুকে দেখুন, সারাক্ষণ একজন একভাবে বাথরুমগুলো পরিষ্কার করে চলেছে। কারণ এটাই, তার সারা দিনের কাজ। তার ডিউটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন এসে হাজির হবে। বাথরুমে সাবান, টয়লেট পেপার, হরদম খরচ হচ্ছে আর তা আবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
যদি দেশের একটা ক্লাবে এ রকম ব্যবস্থা হতে পারে, তাহলে দেশের আপামর জনগণের জন্য এ রকম ব্যবস্থা হবে না কেন?
তারা কি সরকারকে ট্যাঙ্ দেয় না? জাতীয় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কী হচ্ছে না_এটা দেখার জন্য কোনো বড় প্রবন্ধের দরকার নেই, দেশের জনগণের বাথরুমগুলো যেদিন থেকে স্ট্যান্ডার্ডর্ একটা অবস্থায় আসবে, সেদিন বুঝতে হবে দেশ বিশ্বের সভ্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। বুঝতে হবে, এখন অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছে এবং নিজের জাতীয় সম্মান সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী

No comments

Powered by Blogger.