জয়ললিতা-করুণানিধি নয়, সবাই তাকিয়ে বুদ্ধ-মমতার দিকেই by সুব্রত আচার্য্য
বেজে উঠল ভারতের পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী যুদ্ধের দামামা। বুদ্ধদেব-মমতার পশ্চিমবঙ্গ, অচ্যুতানন্দ এবং পিপি থানকাচনের কেরল, জয়ললিতা ও এম করুণানিধির তামিলনাড়ু কিংবা তরুণ গগৈ বনাম প্রফুল্ল কুমার মহন্তর আসামসহ পণ্ডিচেরিতেও বিধানসভার নির্বাচন শুরু হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনার ঘোষিত নির্ঘণ্ট অনুযায়ী ৪ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত ভোট অনুষ্ঠিত হবে বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাগে নির্বাচন হবে পশ্চিমবঙ্গে_ছয় দফায়। ২০০৬ সালে নির্বাচন হয়েছিল পাঁচ দফায়। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিধানসভা নির্বাচন 'পশ্চিমবঙ্গ'। সবচেয়ে নিরুত্তাপ নির্বাচন 'পণ্ডিচেরি'। তবে টেলিকম কেলেঙ্কারিতে এম করুণানিধির ছেলে এ রাজার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তামিলনাড়ুতেও ক্ষমতাসীন দল ডিএমকের সঙ্গে এআইএডিএমের জয়ললিতার যুদ্ধটাও জমে উঠবে তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে। জমি কেলেঙ্কারি নিয়ে সিপিআইয়ের মুখ্যমন্ত্রী অত্যুচানন্দের কারণেও ঘুরেফিরে বিশ্লেষকদের মুখে কেরল বিধানসভার নির্বাচন প্রসঙ্গটিও আসবে। বামরা কেরল বিধানসভায় হারতে চলেছে বলে শোনা যাচ্ছে।
১৯৭৭ সালের পর আবার পরিবর্তনের বাতাস জোরালো হওয়ায় ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট। ৩৪ বছর পর দীর্ঘ তিন দশকের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্যাপক জনমত জেগে ওঠায় তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ফলে স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘদিন পর আবারও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন তাপ-উত্তাপে বলীয়ান হয়ে উঠেছে।
এত দিন পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন ছিল প্রায় একতরফা। নিরুত্তাপ। বিরোধী দলবিহীন। নামেমাত্র বিরোধী দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। বামফ্রন্টের ভোটবাঙ্ েএর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ত না। অন্তত গত বিধানসভার নির্বাচন পর্যন্ত পড়েনি। আর এ কারণেই ২৯৪ আসনের বিধানসভায় ক্ষমতাসীনরা ২৪৪টি আসন পেয়েছিল। তৃণমূল ও কংগ্রেস মিলে পেয়েছিল ৫৪টি। প্রধান বিরোধী দল হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩০টি আসন পেতে হয়। তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি আসনে আটকে যাওয়া বিধানসভা প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাও পায়নি বেশ কিছুদিন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাই এমন ছিল যে ক্ষমতাসীন দল ঢেঁকুর তুলে বলতে পারত, পঞ্চম বামফ্রন্ট সরকার গড়ব। যষ্ঠ অথবা সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়তে যাচ্ছি। এবারও অবশ্য বামফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের মুখে 'অষ্টম বামফ্রন্ট' সরকার গড়ার ডাক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেই ডাকের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের গন্ধ উড়ছে না। বরং সংশয়, সন্দেহ কিংবা বিরোধীদের সঙ্গে কঠিন যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে; শরীরী ভাষায় সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে বিমান বসু, বিনয় কোঙ্গার ও শ্যামল চক্রবর্তীর মতো পোড়খাওয়া কমরেডদের।
যখন লেখাটি লিখছি, এর ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরেশি পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেছেন। ছয় দফা নির্বাচন ঘোষণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কোট আনকোট তিনি বলেছেন, 'সাম ডিজার্ভেন্স হেজ। ফর দ্যাট, পোল ডিক্লেয়ার্ড সিঙ্ ফেজেস্।' অর্থাৎ খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজের মুখে স্বীকার করেন, 'পশ্চিমবঙ্গে কিছু সমস্যা আছে। এর জন্যই ছয় দফা ভোট করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।' মঙ্গলবার দিলি্লতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমও বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন রাজনৈতিক সংঘর্ষ ঘটছে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করতে হবে। সবচেয়ে চমক দেওয়ার মতো কথা বলেন এদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গে মমতা ক্ষমতায় আসছেন। তাঁকে অগ্রিম শুভেচ্ছা।'
ভোটের দিন-তারিখ ঘোষণা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক থেকে ইংরেজি কিংবা হিন্দি দৈনিকগুলোতে যে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, সেটা দেখেই স্পষ্ট বুদ্ধ-মমতার নির্বাচনী যুদ্ধটা যে কত ঝাঁঝালো হবে, রক্তক্ষয়ী হবে। যেমন_বাংলা দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন শিরোনাম করেছে, 'মহাকরণ কার, ঘোষণা ১৩ মে'। স্লোডার শিরোনাম, 'বাংলায় ছয় দফায় ভোট, শুরু ১৮ এপ্রিল। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী'। বর্তমান পত্রিকায় শিরোনাম 'বিহারের মতো ছয় দফায় ভোট বাংলায়'। সকালবেলার শিরোনাম 'ভোটের দামামা বেজে গেল'। আনন্দবাজারের শিরোনাম 'এপ্রিলেই ভোট রাজ্যে'। টেলিগ্রাফের শিরোনাম 'ওয়েট ফর ফ্রাইডে-থার্টিন্থ'। প্রতিটি সংবাদপত্রে এদিন দিলি্লতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার খবরও এসেছে প্রথম পাতায়, নির্বাচনী নির্ঘণ্টের খবরের পাশে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারও নিশ্চিত, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থেকে অভ্যস্ত বামরা নির্বাচনের পরাজয় মেনে নেওয়ার আগে মরণকামড় দেবেই। আর নির্বাচনের জয় পাওয়ার ইঙ্গিত পেয়ে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে যেকোনো অঘটনও ঘটিয়ে দিতে পারে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট। ফলে সহিংসতা যে অনিবার্য সেটা নিশ্চিত সব পক্ষই। এখন শুধু সময় গোনার পালা।
পত্রিকার শিরোনামে যা-ই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো_এবার পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী যুদ্ধ হবে সেয়ানে-সেয়ানে। তিন দশক যেভাবে বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে নির্বাচনে জয় পেয়েছে বামফ্রন্ট। এবার ঠিক উল্টোটাই হতে যাচ্ছে। অন্তত ২০০৮ সালের পর পঞ্চায়েতের ফলাফলের পর এ বার্তাই পাওয়া গেছে। কারণ পঞ্চায়েতে এককভাবেই তৃণমূল ৯ হাজার ৩৭৫ গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে। ২০০৯ সালে ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ১০টি বিধানসভার উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট মাত্র একটি আসনে জয় পায়। অন্যগুলো তৃণমূল ও কংগ্রেসের দখলে যায়। একই বছর লোকসভার নির্বাচনে ১৯টি আসন পেয়ে তৃণমূল রেকর্ড গড়ে। এমনকি সর্বশেষ রাজ্যজুড়ে পৌরসভা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের কাছে গো-হারা হয়েছে।
শুধু লোকসভার নির্বাচনে বিরোধীদের বাঙ্ েযাওয়া ভোটের হিসাব ধরলে ২৯৪ আসনের মধ্যে ২০০টিতে তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়ে রয়েছে ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে। রাজ্যের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট মিলে ২৬টি আসন পেয়েছে। পুরসভা নির্বাচনের নিরিখেও প্রায় ১০০ বিধানসভায় এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবির।
এবারের বিধানসভায় রাজ্যের প্রধান দুই বিরোধী দল তৃণমূল এবং জাতীয় কংগ্রেস জোট করে নির্বাচন করছে। ফলে বিরোধীদের ভোট একটি নির্দিষ্ট বাঙ্ েপড়বে। এতেই বামফ্রন্ট আরো বেশি বেকায়দায় পড়বে।
আগের নির্বাচনগুলোতে তৃণমূল এবং কংগ্রেস পৃথকভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। ফলে ভোট কাটাকুটির হিসাবে লাভ হতো বামফ্রন্ট প্রার্থীদের। তা ছাড়া নির্বাচনের আগে ইস্যুভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বিরোধীদের মাঠে নামতে দেখা যায়নি। যেটা সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়ার কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলনেই মূলত তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিক অঙ্েিজন পেয়েছিল। সেটা প্রমাণ করে, লোকসভা নির্বাচনে এককভাবে ১৯টি আসন পাওয়া। কারণ, এর আগের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস মাত্র একটি আসন পেয়েছিল।
১৮ এপ্রিল থেকে ছয় দফায় নির্বাচন শুরু হবে রাজ্যে। শেষ নির্বাচন ১০ মে। ফলাফল ঘোষণা ১৩ মে। সেদিন জানা যাবে ১৯৯৩ সালের ১০ অক্টোবর যে লালবাড়ি (রাইটার্স বিল্ডিং) থেকে মমতাকে ধাক্কা দিয়ে রাজ্য পুলিশ বের করে দিয়েছিল, ওই লালবাড়িতেই মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ঢুকছেন কি না। নাকি বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে, নিজেদের ভুল সংশোধনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টই অষ্টমবারের মতো ক্ষমতায় ফেরে। তবে বাস্তব পরিস্থিতিতে এমন সম্ভাবনা অবশ্য খুবই ক্ষীণ বলে মনে করা হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলকাতা
subrata.acharjee@gmail.com
১৯৭৭ সালের পর আবার পরিবর্তনের বাতাস জোরালো হওয়ায় ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট। ৩৪ বছর পর দীর্ঘ তিন দশকের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্যাপক জনমত জেগে ওঠায় তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ফলে স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘদিন পর আবারও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন তাপ-উত্তাপে বলীয়ান হয়ে উঠেছে।
এত দিন পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন ছিল প্রায় একতরফা। নিরুত্তাপ। বিরোধী দলবিহীন। নামেমাত্র বিরোধী দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। বামফ্রন্টের ভোটবাঙ্ েএর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ত না। অন্তত গত বিধানসভার নির্বাচন পর্যন্ত পড়েনি। আর এ কারণেই ২৯৪ আসনের বিধানসভায় ক্ষমতাসীনরা ২৪৪টি আসন পেয়েছিল। তৃণমূল ও কংগ্রেস মিলে পেয়েছিল ৫৪টি। প্রধান বিরোধী দল হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩০টি আসন পেতে হয়। তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি আসনে আটকে যাওয়া বিধানসভা প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাও পায়নি বেশ কিছুদিন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাই এমন ছিল যে ক্ষমতাসীন দল ঢেঁকুর তুলে বলতে পারত, পঞ্চম বামফ্রন্ট সরকার গড়ব। যষ্ঠ অথবা সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়তে যাচ্ছি। এবারও অবশ্য বামফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের মুখে 'অষ্টম বামফ্রন্ট' সরকার গড়ার ডাক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেই ডাকের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের গন্ধ উড়ছে না। বরং সংশয়, সন্দেহ কিংবা বিরোধীদের সঙ্গে কঠিন যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে; শরীরী ভাষায় সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে বিমান বসু, বিনয় কোঙ্গার ও শ্যামল চক্রবর্তীর মতো পোড়খাওয়া কমরেডদের।
যখন লেখাটি লিখছি, এর ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরেশি পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেছেন। ছয় দফা নির্বাচন ঘোষণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কোট আনকোট তিনি বলেছেন, 'সাম ডিজার্ভেন্স হেজ। ফর দ্যাট, পোল ডিক্লেয়ার্ড সিঙ্ ফেজেস্।' অর্থাৎ খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজের মুখে স্বীকার করেন, 'পশ্চিমবঙ্গে কিছু সমস্যা আছে। এর জন্যই ছয় দফা ভোট করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।' মঙ্গলবার দিলি্লতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমও বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন রাজনৈতিক সংঘর্ষ ঘটছে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করতে হবে। সবচেয়ে চমক দেওয়ার মতো কথা বলেন এদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গে মমতা ক্ষমতায় আসছেন। তাঁকে অগ্রিম শুভেচ্ছা।'
ভোটের দিন-তারিখ ঘোষণা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক থেকে ইংরেজি কিংবা হিন্দি দৈনিকগুলোতে যে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, সেটা দেখেই স্পষ্ট বুদ্ধ-মমতার নির্বাচনী যুদ্ধটা যে কত ঝাঁঝালো হবে, রক্তক্ষয়ী হবে। যেমন_বাংলা দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন শিরোনাম করেছে, 'মহাকরণ কার, ঘোষণা ১৩ মে'। স্লোডার শিরোনাম, 'বাংলায় ছয় দফায় ভোট, শুরু ১৮ এপ্রিল। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী'। বর্তমান পত্রিকায় শিরোনাম 'বিহারের মতো ছয় দফায় ভোট বাংলায়'। সকালবেলার শিরোনাম 'ভোটের দামামা বেজে গেল'। আনন্দবাজারের শিরোনাম 'এপ্রিলেই ভোট রাজ্যে'। টেলিগ্রাফের শিরোনাম 'ওয়েট ফর ফ্রাইডে-থার্টিন্থ'। প্রতিটি সংবাদপত্রে এদিন দিলি্লতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার খবরও এসেছে প্রথম পাতায়, নির্বাচনী নির্ঘণ্টের খবরের পাশে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারও নিশ্চিত, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থেকে অভ্যস্ত বামরা নির্বাচনের পরাজয় মেনে নেওয়ার আগে মরণকামড় দেবেই। আর নির্বাচনের জয় পাওয়ার ইঙ্গিত পেয়ে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে যেকোনো অঘটনও ঘটিয়ে দিতে পারে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট। ফলে সহিংসতা যে অনিবার্য সেটা নিশ্চিত সব পক্ষই। এখন শুধু সময় গোনার পালা।
পত্রিকার শিরোনামে যা-ই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো_এবার পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী যুদ্ধ হবে সেয়ানে-সেয়ানে। তিন দশক যেভাবে বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে নির্বাচনে জয় পেয়েছে বামফ্রন্ট। এবার ঠিক উল্টোটাই হতে যাচ্ছে। অন্তত ২০০৮ সালের পর পঞ্চায়েতের ফলাফলের পর এ বার্তাই পাওয়া গেছে। কারণ পঞ্চায়েতে এককভাবেই তৃণমূল ৯ হাজার ৩৭৫ গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে। ২০০৯ সালে ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ১০টি বিধানসভার উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট মাত্র একটি আসনে জয় পায়। অন্যগুলো তৃণমূল ও কংগ্রেসের দখলে যায়। একই বছর লোকসভার নির্বাচনে ১৯টি আসন পেয়ে তৃণমূল রেকর্ড গড়ে। এমনকি সর্বশেষ রাজ্যজুড়ে পৌরসভা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের কাছে গো-হারা হয়েছে।
শুধু লোকসভার নির্বাচনে বিরোধীদের বাঙ্ েযাওয়া ভোটের হিসাব ধরলে ২৯৪ আসনের মধ্যে ২০০টিতে তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়ে রয়েছে ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে। রাজ্যের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট মিলে ২৬টি আসন পেয়েছে। পুরসভা নির্বাচনের নিরিখেও প্রায় ১০০ বিধানসভায় এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবির।
এবারের বিধানসভায় রাজ্যের প্রধান দুই বিরোধী দল তৃণমূল এবং জাতীয় কংগ্রেস জোট করে নির্বাচন করছে। ফলে বিরোধীদের ভোট একটি নির্দিষ্ট বাঙ্ েপড়বে। এতেই বামফ্রন্ট আরো বেশি বেকায়দায় পড়বে।
আগের নির্বাচনগুলোতে তৃণমূল এবং কংগ্রেস পৃথকভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। ফলে ভোট কাটাকুটির হিসাবে লাভ হতো বামফ্রন্ট প্রার্থীদের। তা ছাড়া নির্বাচনের আগে ইস্যুভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বিরোধীদের মাঠে নামতে দেখা যায়নি। যেটা সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়ার কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলনেই মূলত তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিক অঙ্েিজন পেয়েছিল। সেটা প্রমাণ করে, লোকসভা নির্বাচনে এককভাবে ১৯টি আসন পাওয়া। কারণ, এর আগের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস মাত্র একটি আসন পেয়েছিল।
১৮ এপ্রিল থেকে ছয় দফায় নির্বাচন শুরু হবে রাজ্যে। শেষ নির্বাচন ১০ মে। ফলাফল ঘোষণা ১৩ মে। সেদিন জানা যাবে ১৯৯৩ সালের ১০ অক্টোবর যে লালবাড়ি (রাইটার্স বিল্ডিং) থেকে মমতাকে ধাক্কা দিয়ে রাজ্য পুলিশ বের করে দিয়েছিল, ওই লালবাড়িতেই মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ঢুকছেন কি না। নাকি বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে, নিজেদের ভুল সংশোধনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টই অষ্টমবারের মতো ক্ষমতায় ফেরে। তবে বাস্তব পরিস্থিতিতে এমন সম্ভাবনা অবশ্য খুবই ক্ষীণ বলে মনে করা হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলকাতা
subrata.acharjee@gmail.com
No comments